পশ্চিমে ‘নো মিনস নো’ কিংবা ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ এবং সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের তাত্ত্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচিত দার্শনিক স্লাভো জিজেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। এছাড়া আমাদের দেশেও নারীবাদের নামে স্থানীয় সমাজ সংস্কৃতি বিরোধী এক ধরণের পশ্চিমা বিকার লক্ষ্য করা যায়। খোদ নারীবাদ ধারণাটির বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনাও এই সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিকে এইসব তথাকথিত নারীবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। এসব দিক বিবেচনায় লেখাটি আমাদের চিন্তাশীলতার চর্চায় সহযোগী হবে বলে আশা করা যায়। লেখাটি গত ৪ মার্চ ২০১৮ তারিখে আরটি ডটকম-এর মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়। লেখাটি জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন জুনায়েদ আহমেদ এহসান।— বিভাগীয় সম্পাদক
বর্তমান যুগের নারীবাদীদের কাছে ‘নো মিনস নো’ (না মানে না-ই) স্লোগানটি খুব জনপ্রিয়। কিন্তু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জায়গায় এই স্লোগানটি একটি সুখী যৌনজীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। এই স্লোগানটি পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগের জায়গাটিকে খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘হ্যাঁ’ এর অর্থ অনেক সময় ‘না’ হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাইলেও একজন নারী ‘না’ বলতে পারে না। সেক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ এর অর্থ স্পষ্টতই ‘না’। তাই ‘নো মিনস নো’ স্লোগানটি তাত্ত্বিক আলোচনায় একটি জটিলতা তৈরি করে। ২০১৮ সালের এই সময়ে ‘নো মিনস নো’ এর কোনো তাৎপর্য নেই, বরং এই স্লোগানটি বর্তমান সময়ের বিবেচনায় একটি সেকেলে ধারণা। একই সাথে এটা একজন নারীর ওপর অযাচিত চাপ তৈরি করে তাকে আরো অসহায় করে তোলে। এটা এক প্রকার মেনে নেয়া যে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার আত্নবিশ্বাস কিংবা সক্ষমতা না থাকলে যৌননির্যাতনের শিকার হতে হবে। আমেরিকান ‘ডেটিং কোচ’ এরিন টিলম্যান মনে করেন, ‘কেউ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে ‘হ্যাঁ’ না বলে, কারো ‘হ্যাঁ’ এর মধ্যে যদি সংশয় থাকে তাহলে সেই ‘হ্যাঁ’ এর অর্থ দাঁড়ায় ‘না’।
ভাষার সংকট
ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, চাপের মুখে পড়ে বলা ‘হ্যাঁ’ এর অর্থ ‘না’ এর সমান। এখানে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, স্বপ্রনোদিত ‘হ্যা’ এর উপস্থিতি সংকটে পড়ে যায়। একজন নারী যদি আসলেই কোনো পুরুষের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে চায় তাহলে তাকে সরাসরি বলতে হয় যেটা অনেকটা ‘প্লিজ ফাক মি’ বলার সমান। এটা খুবই অপমানজনক একজন নারীর জন্য।
পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে যখন কোনো এক পক্ষ যৌনকার্য চলাকালে যেকোনো মূহুর্তে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। এটাকে নতুন ধরণের ভায়োলেন্স বা সহিংসতা বলা যায়। যৌনতার বিশেষ মুহূর্তে যদি কেউ তার সঙ্গীকে উপহাস করে চলে যেতে বলে তাহলে এর চেয়ে অপমানজনক পরিস্থিতি আর কি হতে পারে?
কেউ যদি সুখী যৌনজীবনের অনুসন্ধান করে তাহলে এই সূক্ষ্ম অস্পষ্টতার কারণে তা নিরর্থক হয়ে যায়। পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে যখন কোনো এক পক্ষ যৌনকার্য চলাকালে যেকোনো মূহুর্তে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। এটাকে নতুন ধরণের ভায়োলেন্স বা সহিংসতা বলা যায়। যৌনতার বিশেষ মুহূর্তে যদি কেউ তার সঙ্গীকে উপহাস করে চলে যেতে বলে তাহলে এর চেয়ে অপমানজনক পরিস্থিতি আর কি হতে পারে? এটা পরিষ্কার যে, এইসব পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, যেটা কোনো নিয়মের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। স্লোগানের মাধ্যমে যৌন সহিংসতা নিরুপনের চেষ্টা যৌন সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্যকেই নষ্ট করে দেয়। যৌনতার চর্চার সময়টাতে হাজারো রকমের ভিন্নতা থাকে, যার নির্দিষ্ট কোন ভাষা নাই। এটি নিরবতার ভাষা, বোঝাপড়ার ভাষা। এই ভাষার মধ্যে মেকি ভদ্রতা থাকে না, বরং ইমোশনাল চাওয়া পাওয়ার উন্মত্ততা থাকে, সহনীয় ভায়োলেন্স এখানে নিজেই যৌনতাড়িত হয়ে হাজির হয়।
ওভাল অফিস অর্গাজম এবং মনিকার ভিক্টিম কার্ড
মনিকা লিউনেস্কির ‘হ্যাঁ’ আড়াল করে রেখেছিল বিদ্যমান সময়ের সহিংসতা এবং কর্তৃত্বপরায়ণতাকে। ২০১৪ সালে মনিকা বলেছিলেন, তার এবং বিল ক্লিনটনের শারীরিক সম্পর্ক ছিল সম্মতিসূচক। কিন্তু তাদের এই সম্মতির নেপথ্যে ছিল দুইজনের ক্ষমতার পার্থক্য। তিনি একই সাথে বলেন, ওই সময়ে পরিস্থিতির ফলাফল সম্পর্কে তার ধারণার ঘাটতি ছিলো। অনুতপ্ত মনিকা ‘সম্মতি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘সম্মতি’ শব্দের অর্থ কাউকে কোনো কিছুর জন্য অনুমতি দেয়া। কিন্তু এই অনুমতি দেয়ার পেছনে অনেক কারণই থাকতে পারে। মনিকার ক্ষেত্রে ছিলো ক্ষমতার পার্থক্য, বিল ক্লিনটনের তখনকার রাজনৈতিক অবস্থান, এবং মনিকার নিজের বয়স। এটা নিয়ে মনিকা আত্মসমর্পণের সুরে বলেন, ‘বিল ছিলেন আমার বস, তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যাক্তি এবং আমার চেয়ে ২৭ বছরের বড়’। এটা সত্য যে মনিকা শুধুমাত্র সম্মতি দিয়েছেন তা নয়, তিনি সরাসরি যৌন সম্পর্কেও জড়িয়েছেন। এবং ক্লিনটন নিজেও এতে সম্মত ছিলেন এবং তা আদায় করেছিলেন। হতে পারে ক্ষমতার পার্থক্য একটা বড় কারণ ছিলো এই আকর্ষণের পেছনে। তাহলে এই সম্মতি দেয়ার পরও নিজেকে অনভিজ্ঞ ভিকটিম দাবি করা হিপোক্রেসি কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার একজন প্রথম সারির ঈমাম বিতর্কিত হন ধর্ষণ নিয়ে তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে কয়েকজন মুসলিম যুবকের কারাদণ্ড হলে শেখ তাজ দিন আল-হিলালী নামের ওই ইমাম বলেন, “যদি আপনি এক টুকরা মাংস রাস্তায় খোলা অবস্থায় রেখে দেন, তাহলে বিড়াল আসবে এবং খাবে। তাহলে দোষটা কার? বিড়ালের নাকি মাংসের টুকরার? মাংসের টুকরাটাই এখানে দায়ী।” নারীদের সিক্রেট সিডিউসিং কিংবা চলাফেরার মধ্য দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে উত্তেজিত করার কারণেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে কট্টরপন্থি মুসলিমরা মনে করে। তাদের দাবি, পুরুষরা সিডিউসিং এর শিকার হন বলেই সমাজে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমরা এখানে কট্টরপন্থি মুসলিম এবং মনিকা লিউনেস্কির বক্তব্যের মধ্যে এক ধরণের মিল খুঁজে পাই।
মনিকা যদিও নিজে থেকেই ক্লিনটনের সাথে সম্পর্ক করেছিলেন, তারপরও তিনি দায়ভার ক্লিনটনের উপর চাপান। একইভাবে কট্টরপন্থি মুসলিমদের মতে, নারীদের সিডিউসিংয়ের সামনে পুরুষরা আসলে অসহায় ভুক্তভোগী। এমনকি ধর্ষণের মত ভয়াবহ কাজ করলেও তারা এটাকে এই যুক্তিতে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন। ক্লিনটনের ক্ষমতার কারণে মনিকা মোহগ্রস্থ হয়েছিলেন, এই কারণে তিনি নিজেকে ভুক্তভোগী দাবি করেন।
উপরোক্ত দুই ধরণের যুক্তিই ত্রুটিপূর্ণ। যদিও সামাজিক ক্ষমতার বিবেচনায় পুরুষরা এগিয়ে, সমাজে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদিতা এখনো বিদ্যমান, তারপরও অসহায়ত্বের ভিক্টিম কার্ড খেলা আত্ম-অপমানজনক। আর এই ধরণের ভিক্টিম কার্ড নারী মুক্তির ক্ষেত্রে কোন অবদান রাখবে না, বরং এর মাধ্যমে পুরুষদের কর্তৃত্বকে মেনে নেয়া হয়।
অনুবাদক
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia