‘হিন্দুত্বভা’ ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজ জীবনে এক অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। শুধু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয় বরং বিজেপি তাদের এই রাজনৈতিক ন্যারেশন তৈরি করে আসছিলো বহু আগে থেকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও এই উস্কানিদাতাদের একজন। এই লেখাটিতে প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ দেখিয়েছেন, ভারতের বিজেপি সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী’র তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের উস্কানি দিয়েছেন। এবং তিনি আলোকপাত করেছেন এই উস্কানির সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে। লেখাটি গৌরী লঙ্কেশের কলাম সংগ্রহ ‘কনড়া হেজ’র প্রথম খণ্ড থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সুধাংশু মিত্র। ইংরেজিতে এর শিরোনাম ‘দ্য পলিটিক্যাল ডিসকাশন অ্যারাউন্ড ওয়ান ওয়ার্ড.. হিন্দুত্ব অ্যান্ড ইন্ডিয়াননেস’। এখানে জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।
যে কোন ‘শব্দ’ (Word) সমাজের নিজস্ব ইতিহাস, অর্থ, সংস্কৃতি এবং ভাবাদর্শগত নির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, বরং ওই সম্প্রদায়ের জীবন ধারণের উপায়গুলোও শব্দটির মধ্যে নিহিত থাকে। এই সব কারণে শব্দটি একটি সম্প্রদায়ের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
উদাহরণ হিসেবে, ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি নেয়া যাক। এই শব্দটির পেছনে ধর্ম এবং আধিপত্য অঙ্কনের একটি সংগ্রাম রয়েছে। এটির আছে মানবতার জন্য গৌতম বুদ্ধের ভালোবাসা, আছে বাসাভা ধর্মের সারমর্ম, আছে গান্ধী গুপ্তহত্যার রক্ত এবং এই দেশের সাংবিধানিক প্রণোদনা।
সেকুলারিজম শব্দটি ভারতীয় ‘হিন্দুত্ব’ বা ‘হিন্দুত্ববাদ’ শব্দটির বিপরীত। এমনকি হিন্দুত্ববাদ শব্দটির নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে: বর্ণবাদকে সমর্থন, জাতিগত শাসনের পুনর্বহাল, উচ্চশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা, বিভিন্ন সম্প্রদায়কে বিতাড়ন, সাম্প্রদায়িক চেতনা লালন, নারী এবং শূদ্রদের নিপীড়ন, দলিতদের নপুংসক হিসেবে দেখা— এসবই মনুবাদ বা হিন্দুত্ববাদের অংশ।
ভারতীয়রা এখন এই দুটি বিরোধী শব্দের মধ্য থেকে একটি বেছে নেয়ার পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রত্যেক শব্দেরই তাদের নিজস্ব ইতিহাস, জ্ঞান এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভারতীয়দের সিদ্ধান্তই দেশটির ভাগ্য পরিবর্তন করবে।
এই বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার পেছনে আমার অনুপ্রেরণা ভারতের দশম প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী’র একটি সাক্ষাৎকার, তিনি তার স্বতস্ফূর্ত বলার ভঙ্গিই ব্যবহার করছিলেন। তিনি সেকুলারিজম এবং ন্যাশনালিজম (জাতীয়তাবাদ) বিষয়ক একটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। হিন্দিতে বাজপেয়ী বলছিলেন, “ভারতীয় জাতীয়তা এবং হিন্দুত্ববাদের অর্থ একই। কিন্তু আমি ভারতীয় বলতে পছন্দ করবো। আমাদের এখানে হিন্দুত্ববাদ অনুসারীরাও আছে।”
এমনকি তিনি পূর্বেও এই রকম ভয়ানক পদ্ধতিতে শব্দ উচ্চারণ করেছেন, তিনি একজন স্বঘোষিত কবি, তাই নয় কি? একজন কবি হিসেবে যতখানি শব্দ উচ্চারণের যাদু দরকার বাজপেয়ী তার অধিকারী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবিক অর্থে বাজপেয়ী’র কবির হৃদয়ের বৈশিষ্ট্য নেই।
এর কারণ তার সংকীর্ণ মনোভাব যখন শব্দটির জটিলতার বিষয় আসে। ওই শব্দটি যা ধারণ করে সে তার অন্যান্য সব পরিপ্রেক্ষিতই অস্বীকার করে। সে শব্দটির মধ্যে নিহিত সমস্ত বৈশিষ্ট্য চুষে বের করে এবং সেটিকে নিতান্ত অব্যবহারযোগ্য করে দেয়। বাজপেয়ী, যিনি একটি শব্দের সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্বকে অসম্মান করেন, তিনি কবি হতে পারেন না। এমনকি এরপর তিনি শব্দটির ধারণ করা সমস্ত জটিলতা মুছে ফেলার চিন্তা করতে সক্ষম একজন ব্যক্তি।
যদি তাই হয়, আমি যে জন্ম নিয়েছি এবং এই দেশে বসবাস করছি এবং হিন্দুত্ববাদ গ্রহণ করিনি, তাহলে আমি কোন দেশের? যদি আমার মতো মানুষ ভারতীয় না হয়, তাহলে কে এই দেশের নাগরিক? শুধু তাই নয় বুদ্ধবাদ, জায়নবাদ বা শিখবাদের অনুসারীরা কোন রাজ্যের?
বাক্যটি বোঝার চেষ্টা করুন, হিন্দুত্বাবাদ ভাবাদর্শে “হিন্দুত্ববাদ এবং ‘ভারতীয় জাতীয়তা’ উভয় শব্দ দু’টির অর্থ এক”। হিন্দুত্ববাদের অনুসারীদের বদৌলতে প্রত্যেকেই এ বিষয়ে জানে যে, একজন হিন্দু ধর্মের অংশ নয় অথবা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেনি, একজন যে হিন্দু ধর্মের প্রয়োজনীয়তা গ্রহণ করে না এবং একজন যে হিন্দুত্ববাদের ভাবাদর্শ গ্রহণ করে না, সে কোনোভাবেই ভারতীয় নয়।
এখন বাজপেয়ী এক ধাপ এগিয়ে গেছেন এই বলে যে হিন্দুত্ববাদ এবং ভারতীয় জাতীয়তা’র অর্থ একই। এই বিবৃতিটিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করুন। তার মতে, একজন যে হিন্দুত্ববাদ গ্রহণ করেনি সে ভারতীয় নয়। যদি তাই হয়, আমি যে জন্ম নিয়েছি এবং এই দেশে বসবাস করছি এবং হিন্দুত্ববাদ গ্রহণ করিনি, তাহলে আমি কোন দেশের? যদি আমার মতো মানুষ ভারতীয় না হয়, তাহলে কে এই দেশের নাগরিক? শুধু তাই নয় বুদ্ধবাদ, জায়নবাদ বা শিখবাদের অনুসারীরা কোন রাজ্যের?
শুধু খ্রিস্টান-মুসলমান সংখ্যালঘু নয়, তারা যারা হিন্দু পুরোহিত কর্তৃক ধর্মচ্যূত বা নির্বাসিত জাতি যেমন লিঙ্গায়াৎস, ওক্কালিগা, কুরুবা, দলিত; যদি তারা ভারতীয় না হয়, তবে কোন দেশের?
কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা না জানলে তার না কবি হওয়া উচিত, না রাষ্ট্রপ্রধান। অটল বিহারী বাজপেয়ী তার জীবন্ত উদাহরণ। কারণ একজন কবি এমন কেউ নয় যে শুধু শব্দ উচ্চারণ করে— একজন কবি অবশ্যই ভাষা নৈপূণ্যের বিশেষত্ব জানেন। সে এমন একজন যে ভাষা সমৃদ্ধ এবং রক্ষা করে, একই ভাবে শব্দের পেছনের বোধও। আর শুধু তখনই ভাষার অর্থ অধঃপতনের পরিবর্তে বিস্তৃত হয় এবং বৃদ্ধি পায়। একটি শব্দ তখনই তার জীবন ফিরে পায় যখন এটি তার সম্প্রদায়ের টিকে থাকার অংশ হয়, তখনই যখন এটি মানুষের জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে, ‘ন্যাশনালিজম’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি নেয়া যাক। এটি একই সাথে একটি বিস্তৃত অর্থ এবং একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিকোণ থেকে সংকীর্ণ অনুভূতি প্রকাশ করে। বিস্তৃত অর্থে জাতীয়তাবাদ প্রকাশ করে একটি সম্প্রদায়ের জীবনধারণের উপায়, ধর্মানুষ্ঠান, বিশ্বাস, ইতিহাস এবং অন্যান্য সামাজিক বিষয়। যদিও একে অপরের পরিচিত না, তারপরও এটি তাদেরকে ওই জাতির সমস্ত দিকের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রস্তাব করে। কিন্তু যখন ভারতের মতো একটি দেশে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মধ্য দিয়ে শব্দটিকে সীমিত করা হয় যে দেশটির রয়েছে বহুবিধ ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা এবং অন্যান্য জটিলতা, এটি অবশ্যই সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে পর্যবসিত হয়। যদি আমরা তাই করি, তবে একটি সংস্কৃতির ৯৮ শতাংশ মুছে ফেলা হবে এবং এইভাবে সবকিছু বিপর্যস্ত এবং অবক্ষয়িত হবে।
এটাই ভারতীয় জাতীয়তা এবং হিন্দুত্ববাদের মধ্যে পার্থক্য। ভারতীয় জাতীয়তা একটি বিস্তীর্ণ এবং ব্যাপক অর্থবহ শব্দ যা সবাইকে এবং সবকিছু নিয়ে। এটি যেমন অলৌকিক বিশ্বাস এবং ধারণা নিয়ে গঠিত তেমনি জমি, পানি এবং সম্পদ নিয়ে গঠিত। এর বিপরীত শব্দ হিন্দুত্ববাদ। এটি একটি সংকীর্ণ শব্দ যা মানুষকে বিভক্ত এবং আলাদা করে, একসাথে অনেকগুলো সম্প্রদায়ের বসবাসকে অস্বীকার করে এবং তাদেরকে একই ভাষা ও একই ধর্ম চর্চায় বাধ্য করে।
ভাষার সাথে অসদাচরণ করে এই শব্দ দু’টিকে একই অর্থে ব্যবহার করে স্বঘোষিত কবি বাজপেয়ী হিটলারের পথ অনুসরণ করেছেন। তিনি ‘ভারতীয় জাতীয়তা’ শব্দটিকে কলুষিত করে জাতীয়তা বিরোধী কাজ করে আজ উন্নতি করছেন। বাজপেয়ী’র কর্মের কারণে, মনে হয় তিনি একজন ব্যক্তি যিনি বারবার মিথ্যে বলার কৌশল আয়ত্ত করেছেন যতক্ষণ না তা সত্য থেকে পৃথক মনে হয়। আমাদের জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে যদি ‘ভারতীয় জাতীয়তা’ শব্দটি এক বছরের মধ্যে তার অর্থ হারায়।
এই মতাদর্শিক আক্রমণ বন্ধ করার দ্বায়িত্ব আমাদের সবার মধ্যে নিহিত। আমাদের কাছে সেই অস্ত্র আছে তা আমাদের সামনে ঘটানোর। নির্বাচন। যদি তা বাজপেয়ীর মুখে ছুড়ে দিতে চান যে ‘ভারতীয় জাতীয়তা’ মানে হিন্দুত্ববাদ নয়, তাহলে আমাদের রাজ্যে এবং সমগ্র দেশে সবখানে বিজেপি’কে প্রত্যাখান করা দরকার।
টিকা: গৌরী লঙ্কেশ তার লেখায় ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ স্থানে ‘Indianness’ এবং হিন্দুত্ববাদ’র স্থানে ‘Hindutva’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। ‘মনুবাদ’ শব্দটি হিন্দুত্ববাদ’রই আঞ্চলিক প্রতিশব্দ।
অনুবাদক
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia