আমেরিকাতে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরে মার্কিন-চীন সম্পর্ক কি রুপ নিতে যাচ্ছে তা নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে সম্প্রতি দ্যা কনভারসেশন ডটকমে লিখেছেন যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়ান-উ এবং একই বিভাগের জ্যোষ্ঠ প্রভাষক রিচার্ড থমাস। লেখাটির অনুবাদ জবানের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
-বিভাগীয় সম্পাদক
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জো বাইডেনের নির্বাচনে বিজয়কে সতর্ক আশাবাদের সাথে কাভার করেছে। সে যাই হোক, ইংরেজি পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ যখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ অভিবাদন জানিয়েছে, তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-পন্থী ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘পিপলস ডেইলি’ বলেছে, আত্মনির্ভরতা বাড়ানোর সঠিক পথে চীনকে অবশ্যই সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
২০১১ সালে বারাক ওবামার শাসনামলে, চীন সফরকালে বেইজিং শহরের একটি রেস্টুরেন্টে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের ভ্রমণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে পুরোনো বন্ধু হিসেবে আখ্যা দিয়েছে পত্রিকাটি।
তখন এটি নুডল কূটনীতি (Noodle diplomacy) নামে পরিচিতি পেয়েছিলো। এটিকে চীন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন এক সঞ্জীবনী বলে মনে হয়েছিলো।
পত্রিকাটি বলেছে, একটি বাস্কেটবল ম্যাচ দেখা এবং সিচুয়ান প্রদেশে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিদর্শন করাসহ সে সময়ে বাইডেনের চীন সফর সেখানকার কিছু মানুষের স্মৃতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলো। কিন্তু সেই সময়ে বাইডেনের চীন সফর যতটা উৎসাহের বিষয় হিসেবে মনে করা হয়েছিলো, তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি।
বেইজিং-এ অবস্থিত রেনমিন ইউনিভার্সিটি অফ চাইনার স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী ডিন জিন ক্যানরন-কে উদ্বৃতি করে পিপলস ডেইলি বলেছে, বাইডেনের কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করা আমাদের উচিত হবে না। কারণ চীনকে মোকাবেলা করা ও চীনের প্রভাব প্রতিহত করা যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি রাজনৈতিক দলেরই (রিপালিক ও ডেমোক্র্যাট) কৌশলগত ঐক্যের জায়গা।
চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে আপনি কীভাবে দেখবেন? তা মোটাদাগে নির্ভর করে পৃথিবীর কোন জায়গায় আপনি বসবাস করছেন -তার উপর। উদাহরণস্বরূপ, উন্নয়নশীল দেশগুলো এটাকে সমৃদ্ধির জন্য অনুকরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচনা করে। চীনের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ইমরান খান সম্প্রতি বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য তাঁর সরকার চীনের শিল্পোন্নয়ন থেকে শিখতে চায়।
অন্যদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে চীনকে একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চীনকে হুমকি হিসেবে বিবেচনার প্রবণতা স্পষ্টতই তীব্র হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে চীনের বলিষ্ঠ ও কৌশলগত বিনিয়োগ এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’-এর উদ্যোগকে ব্যাপকভাবে মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্য থেকে দুনিয়াতে আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় চীনকে এখান প্রতিযোগী খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়া, অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়েও দুই দেশের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘাতময় অবস্থান বিরাজ করছে। যেমন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ভৌগলিক হস্তক্ষেপ, আঞ্চলিক খবরদারি, নতুন প্রতিরক্ষা আইন, কিংবা হংকং-এর অনাপত্তির বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনের মতো অনেক বিষয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে। করোনা মহামারির কারণ কোভিড-১৯ ভাইরাসকে ডোনাল ট্রাম্পের ‘চায়না’ ভাইরাস আখ্যা দেয়া -এই অবস্থার উত্তরণে কোন ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেনি।
১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে চীনের রাষ্ট্রীয় কূটনীতির কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিলো- ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’র নীতি। এবং এরই প্রেক্ষিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল- যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক ও আদর্শগত ভিন্নতার সত্ত্বেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কেবল অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেয়া। তবে ২০১২ সালে শি জিন পিং চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ গ্রহণের পর থেকে তিনি একটু আগ্রাসী ভঙ্গিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক চর্চার দিকে মনযোগ দিয়েছেন। নিজেদেরও বড় ক্ষমতাধর হিসেবে বিবেচনায় রেখে আমেরিকার সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী।
কমরেডস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস:
শি জিন পিং-র অধীনে চীনের রাষ্ট্রীয় কূটনীতি সম্পর্কে ধারণা পেতে তার দেওয়া নববর্ষের বক্তৃতার দিকে তাকানো যেতে পারে। তাঁর অধীনে চীনের রাষ্ট্রীয় কূটনীতির অবস্থাটা বোঝার জন্য এগুলো খুবই কাজের হতে পারে।
বাকপটু নেতা হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের প্রথম জাতীয় নেতা হিসেবে টেলিভিশনে প্রকাশিত ও স্ট্রিমড বক্তব্যে ২০১৪ সাল থেকে শি তাঁর এসব বক্তৃতায় কেবল চীনের জনসাধারণ ও মিত্রদেশগুলোকে নয়, বরং বৃহৎ আন্তর্জাতিক জনগোষ্ঠীকেও সম্বোধন করেছেন।
আমাদের গবেষকরা শি জিন পিং-এর এই নতুন ধরনের বক্তব্যের ক্লু বের করার জন্য বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। শি জিন পিং অনেকটা অপরিবর্তিতভাবে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন— কমরডেগণ, বন্ধুগণ, ভদ্রলোক ও মহিলাগণ —এই সমস্ত শব্দাবলির মাধ্যমে।
এখানে ‘কমরেডগণ’ হলো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের মধ্যে প্রচলিত অভিবাদন- রীতি। বন্ধুগণ শব্দটি দ্বারা সম্মান ও অনুরাগ নির্দেশ করা হয়। এদিকে ‘ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলাগণ’—এই শব্দগুলোর মাধ্যমে মূলত ব্যবসায়িক অভিজাত ও বাইরের দেশ থেকে আগত অতিথিদের সম্বোধন করা হয়।
উনার বক্তব্যে- আমরা, আমাদের, প্রভৃতি সর্বনামমূলক শব্দের বারংবার ব্যবহার তার সমন্বয় বাদি মনোভাবকে চিহ্নিত করে। এইসব শব্দ সংঘবদ্ধতাকে ইঙ্গিত করতে ব্যবহার ক হয়। যা একই সাথে শ্রোতা ও বক্তার মধ্যেও পারস্পরিক সংযোগকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়।
২০২১ সালে নববর্ষে শি জিন পিং-এর ভাষণে, মহামারির অন্ধকার দূর করতে এবং আরও ভালোভাবে বাসযোগ্য দুনিয়া নির্মাণে সংগ্রাম করতে, নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন হাত বাড়িয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করার জন্য।
শি তার বক্তব্যে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চীনের সকল প্রচেষ্টাকে একসাথে তুলে ধরেন এবং খুব সাবধানতা অবলম্বন করে এই অর্জন চীনের সাধারণ জনগণের অবদান হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সাধারণের মাঝেই আছে ‘অসাধারনত্ব’। তিনি আরও যোগ করেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই এইক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
গ্লোবাল পাওয়ার স্ট্যাটাস:
চীনের উন্নয়নের কৌশল সম্পর্কে আরও বিশদভাবে বলতে গেলে—শি তার দেশের পরিকল্পনাগুলো জাতিসংঘের বিশ্ব-শান্তি বজায় রাখা এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন বৃদ্ধির মিশনের কাঠামোর আলোকে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করেছেন। চীনের গ্লোবাল পাওয়ার স্ট্যাটাস দেশটিকে এই সাধারণ লক্ষ্যগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়তা করবে। এটি বারবার দেখা গেছে। ২০১৮ সালে নববর্ষের ভাষণে শি জিন পিং উল্লেখ করেন, আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব, সমুদ্র-অধিকার ও নিজেদের স্বার্থকে দৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত রেখে চীন শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অব্যহত ভাবে কাজ করে যাচ্ছে…
শি-র এসব বার্তা কেবল দেশীয় শ্রোতা বা বিদেশী নেতৃবৃন্দ ও অভিজাতদের উদ্দেশ্য করে নয়। শি ও তাঁর পরামর্শদাতারা অবগত আছেন যে, বৈশ্বয়িক মিডিয়ার পরিবেশে কেবল সরকারিভাবেই বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয় না। এখন বরং বিদেশী চীনা নাগরিক ও অন্যদেশের নাগরিকদের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমেও এই নীতি পরিচালিত হয়।
নতুন মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান জো বাইডেনের শুরুর দিককার কথাগুলো থেকে তাঁর পুরানা নুডল কূটনীতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মেনুতে পুনরায় ফিরে আসবে কি না—তা বলা বেশ কঠিন।
২০২০ সালের নতুন বর্ষের বক্তব্যের মাধ্যমে শি বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সাথে তিনি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে শি চীনের প্রস্তাবসমূহ, বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করা এবং ঐক্য সুদৃঢ় করার বিষয়সমূহ নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
শি বলেছেন, কয়েকটি দেশ আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পৃথিবীর প্রত্যেক কোণেই আমাদের বন্ধু রয়েছে।
জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে হাত মেলানো এইসকল দেশের মধ্যে আছে কি না—তা আবিষ্কার করতে ২০২২ সালে শি জিন পিং-এর বক্তব্য কাজে দিবে।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia