লঙ্কা সিরিজকে বেহুদা জ্ঞান করে আইপিএল খেলতে চেয়ে সাকিব আল হাসানের করা ছুটির আবেদনে সরগরম ক্রিকেট পাড়া। কেউ সাকিবের দেশপ্রেমের অভাব সামনে এনে পিণ্ডি চটকাচ্ছেন তো কেউ তার সাথে হয়ে যাওয়া ‘অন্যায়’র ফিরিস্তি তুলে চেষ্টা করছেন প্রিয় তারকার সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক সাবুদ করার। সাকিব ঠিক করেছে কি বেঠিক তা নিয়ে আলোচনার চেয়ে আমার আগ্রহ সাকিবের বদৌলতে আবিষ্কার হওয়া এক অপ্রিয় কায়ানাত নিয়ে। যেটি আমার নজরে পুরোটাই আঁধারে ঢাকা।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সোনার ডিম পাড় হাঁস ‘আইপিএল’ এমন অপ্রিয় অবস্থার সামনে এর আগে বহু দলকেই দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে ওয়েস্ট উইন্ডিজ তো বহুদিন ধরেই আইপিএল’র আগ্রাসনের ভুক্তভোগী। সাকিব ইস্যু বাজার হারানোর আগেই শোনা যাচ্ছে আইপিএল’র ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সিরিজ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিতে যাচ্ছেন উইলিয়ামসন-বোল্ট। সুতরাং বিষয়টিকে আমরা যত সহজ করে দেখছি আদতে তত সহজ নয়। এই ধারা যদি চলমান থাকে তবে পুরো ক্রিকেট কাঠামোটাই ভেঙে পড়বে।
আইপিএল’র আধিপত্যকে কবুল করে আইপিএল চলাকালীন সময়ে কোনো বোর্ডই সাধারণত সিরিজের আয়োজন করে না। করতে গেলে কী রূপ অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তা আমরা সাকিব, উইলিয়ামসন ইস্যুতেই দেখছি। আইপিএল প্রভাব এতটাই যে এটিকে জায়গা দেয়ার জন্য ক্রিকেট বিশ্বকাপ পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে হয়েছে! ভারতীয় বোর্ডের এই আগ্রাসনের নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু সুদুরপ্রসারী।
আইপিএল বিসিসিআই-র নগ্ন আগ্রাসনের এক অন্যতম হাতিয়ার। ক্রিকেটটাকে খেলা থেকে বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরে বিসিসিআই-র যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল—আইপিএল হলো এর বাস্তব রূপ। এবং এতে তাল দিচ্ছে অজি এবং ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড। আইসিসির আয়ের সিংহভাগ যোগান দেয়ার গুণে এ ত্রয়ী যা খুশি তাই করতে পারছে। অর্থলিপ্সু আইসিসিও সব জেনে বুঝে চোখ বুজে বসে রয়েছে। কিছু বলতে গেলে কর্তা যদি রুষ্ঠ হয় তবে লাভের গুড় তো জুটবে না! এমন পরিস্থিতির পরও যে ক্রিকেট এখনো বেঁচে রয়েছে এই তো বেশি!
আইপিএল’র বিকল্প হিসেবে আমরা একই ধাঁচের আরো কিছু আসর জন্ম নিতে দেখেছি। যেমন, বিপিএল, সিপিএল, পিএসএল। সেগুলো কিন্তু আইপিএল’র কাছাকাছি মুনাফাও অর্জন করতে পারছে না। কেননা এসব টুর্নামেন্টের সময় কিন্তু আন্তর্জাতিক সিরিজ বন্ধ থাকে না। ফলে এই আসরগুলো ঐ অর্থে বড় তারকাদের সমাবেশও ঘটাতে পারে না। এ দুয়ের যোগফলে স্পন্সরদের কাছ থেকে যা আয় হয় তা আইপিএল’র প্রভাব খর্ব করার জন্য যথেষ্ট নয়।
আপনি আইপিএল বাদে অন্য কোনো আসরে ভারতীয় ক্রিকেটারদেরও দেখবেন না। যেহেতু ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত, তাই ভারতীয় তারকারা খেলা মানেই স্পন্সরদের আগ্রহ। কিন্তু সেটিকে আপনি যদি ঘটতে দেন তবে আইপিএল’র একাধিপত্য তো বজায় থাকবে না। সাম্ভাব্য যত পন্থা অনুসরণ করা সম্ভব তার সবটাই তিন মোড়ল করছে আয়ের প্রবাহ এবং অপর কেউ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে।
এটা তো স্পষ্ট যে আইপিএলকে জায়গা ছেড়ে দিতে গিয়ে বাকি বোর্ডগুলো বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি নিমরাজী হালতে কবুল করে নিচ্ছে। নিজ দলের খেলোয়াড়দের উপর বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ এখন হুমকির মুখে। কেন্দ্রীয় চুক্তিতে না থাকাটাও এখন সে অর্থে খেলোয়াড়দের জন্য বড় কিছু নয়। উইন্ডিজের খেলোয়াড়রা তো এসব আসরের মাঝে সময় পেলে তবেই জাতীয় দলে খেলেন! যেটা আমরা বাংলাদেশ সিরিজের সময়েই দেখলাম। জাতীয় দলের সম্ভ্রমের বদলে উইন্ডিজ তারকাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে টি-টেন নামক পিকনিক ক্রিকেট!
একজন খেলোয়াড়কে জাতীয় দলের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে নিজ নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ড বিশাল একটি বিনিয়োগ করে থাকে। যেমন এই সাকিবের পিছনেই বয়স ভিত্তিক সময় থেকে বেশ বড় একটি বিনিয়োগ রয়েছে বোর্ডের। এ বিনিয়োগের ফলাফল যখন ঘরে তোলার কথা তখন যদি সেই খেলোয়াড় দেশের বদলে অপর দেশের ঘরোয়া আসরকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করেন তাহলে এটা তো নিশ্চিত যে পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই বোর্ডগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। আইপিএল ধাঁচের আসরের জন্মের পর জাতীয় দলের চুক্তিতে থাকার বদলে খেলোয়াড়দের মুক্ত বিহঙ্গ হিসেবে বিচরণ করার যে বাসনা তা থেকে পরিত্রাণের পথও বেশ কঠিন।
পুরো পরিস্থিতিটাকে কেবলই আইপিএল এবং সাকিব ইস্যুতে আটকে না রেখে আমরা যদি আরো বড় করে দেখতে যাই তাহলে যা সামনে আসছে তা ক্রিকেটের জন্য সুখকর নয়। তিন বোর্ডের মিলিত আগ্রাসনে অপর দলগুলো ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে।
পুরো পরিস্থিতিটাকে কেবলই আইপিএল এবং সাকিব ইস্যুতে আটকে না রেখে আমরা যদি আরো বড় করে দেখতে যাই তাহলে যা সামনে আসছে তা ক্রিকেটের জন্য সুখকর নয়। তিন বোর্ডের মিলিত আগ্রাসনে অপর দলগুলো ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। অস্ট্রেলিয়া একক সিদ্ধান্তে আফ্রিকা সফর বাতিল করলো কিছুদিন আগে। করোনায় বিস্তর আর্থিক ক্ষতি কবুল করা আফ্রিকান বোর্ড এ সিরিজটি দিয়ে কিছুটা পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলো। সেটি যে হচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য। এ সিরিজ এর বদলে অজি তারকাদের ব্যস্ত থাকতে দেখা যাবে আইপিএল এ।
অপর বোর্ডগুলো যদি ক্রমশই এ ধরনের ক্ষতি কবুল করে নিতে থাকে তাহলে তাদের অবস্থাই বা কেমন হবে? পুরো ক্রিকেটটাই বা কেমন হবে? এ নিয়ে কিন্তু কিছুদিন আগেই সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন সাবেক আফ্রিকান অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। তিনি স্পষ্টই বলেছেন এ ধারা অব্যাহত থাকলে অপর দলগুলোর হালত হয়ে যাবে কেনিয়ার মত। যে দলটি অপার সম্ভাবনা সত্ত্বেও ক্রিকেট জগত থেকে হারিয়ে গিয়েছে আর্থিক দূর্দশার কারণে।
দেখুন আজ যদি সাকিব না করত বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে কাল হয়ত অন্য কেউ করত। বিসিবি ত ইতোমধ্যে বলেই দিয়েছে যে মোস্তাফিজও ছুটি চাইলে তা মঞ্জুর করা হবে। দেশের শীর্ষ তারকাদের জাতীয় দলের বদলে ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক এটি দেখতে কুৎসিত হলেও নির্মম বাস্তবতা এখন। এ আওয়াজটা কিন্তু বহুদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিলো কিন্তু কোনো বোর্ডই এর সুরাহার পথ বাতলাতে পারেনি।
আমি শুরুতেই বলেছি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বোর্ডগুলো অসহায়। বিসিবি চাইলেও তো সাকিবকে আটকাতে পারত না। তিনি বর্তমান কেন্দ্রীয় চুক্তিতেই নেই। জবরদস্তি হয়ত করা যেত কিন্তু তার ফল আখেরে ভালো হত না। আমি এ জায়গায় অন্তত বোর্ডের তারিফ করি এই জন্য যে, পুরো পরিস্থিতি অনুধাবন করে বিনা তিক্ততায় বিষয়টি তারা সুরাহা করেছে। কিন্তু তাতে যে নতুন পরিস্থিতির সামনে সাকিব দাঁড় করিয়ে দিলেন সে অস্বস্তি কিন্তু কাটছে না।
এখানে আরেকটি আলাপ রয়েছে। অনেকেই বলেন বোর্ডগুলো আইপিএল ধাঁচের আসরে খেলতে না দিয়ে খেলোয়াড়দের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারে কি না? এটা অবাস্তব চিন্তা। আইপিএল’র অযৌক্তিক রকমের পারিশ্রম যদি কোনো বোর্ড দিতে চায় তাহলে তার পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়বে। তিন মোড়ল বাদে কোনো বোর্ডের ঐ সক্ষমতাও নেই। সুতরাং এ চেষ্টা কোনো ফলাফল আনবে না। যেটি আনবে তা হলো বিশৃঙ্খলা।
একাধিক তারকা খেলোয়াড় থাকার পরেও উইন্ডিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এক খর্ব শক্তি এখন। তার কারণ শুরুতেই বলেছি। এখন সে পথে যদি অন্যান্য দেশের খেলোয়াডরাও হাঁটতে শুরু করে তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আবেদনটুকু থাকবে কি না? বাংলাদেশের কেবল দু’জন এ ধরনের আসরের কাঙ্খিত মুখ বলে আমরা হয়ত পুরো ক্ষতিটি এখনো সে অর্থে অনুধাবন করতে পারছি না। সাকিব কর্মে উন্মোচিত নতুন দুয়ার কিন্তু স্পষ্টই বলে দিচ্ছে এ ধারা কেবল শুরু, সামনে এমন আরো বহু দৃশ্যই আমাদের দেখতে হবে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ বিসিবির একার পক্ষে বের করা সম্ভব না। বিসিবির সামনে একটাই পথ অপর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসা।
আমি এটা স্পষ্ট করেই বলছি, পুরো বিষয়টি অনুধাবনে যত বেশি সময় ক্ষেপণ হবে ক্রিকেট তত বেশি হুমকির মুখে পড়বে। আপনি যখন অর্থের ঝনঝনানিতে অন্ধ হয়ে যাবেন তখন বাকি বাস্তবতা আপনার চোখে পড়বে না। যেটা পড়ছে না বিসিসিআই, সিএ কিংবা ইসিবির। সাকিব-বোল্টদের যে পরিচিতি তা কিন্তু জাতীয় দলের কারণেই। সাকিব যদি জাতীয় দলের অংশ না হতেন তবে তাকে নিয়ে এ আগ্রহের কোনো কারণই ছিল না। বিসিসিআই-র অতিলোভে যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তার স্বাভাবিক আবেদন হারায় তখন শুধুই আইপিএল ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কি না?
শুধুই সাকিবে আটকে না থেকে বোর্ডের উচিত বিষয়গুলো তলিয়ে দেখা। আমাদের চিন্তার জগতে সাকিব যে ধাক্কাটি দিলেন তার মূল নির্যাস না নিয়ে আমরা যদি ‘দেশ না টাকা’ কোনটা বড়— তর্কেই আটকে থাকি তবে ক্রিকেটের জন্য বেশ খারাপ দিনই অপেক্ষা করছে বলা যায়।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia