Joban Magazineরোনালদো এবং  মিডিয়ার ফটকাবাজি

রোনালদো এবং  মিডিয়ার ফটকাবাজি

 ‘ট্রান্সফার রিউমার’ শব্দ দুটি থেকে রিউমারের আভিধানিক অর্থকে সচেতন ভাবে পাশ কাটিয়ে, রিউমার বা রটনাকেই সত্যজ্ঞান করার যে আশ্চর্য অভিলাষ আমাদের রয়েছে সে বিষয়ে মিডিয়াগুলো অনেক বেশি সচেতন। ফলে মিডিয়াগুলো আমাদের তাই গিলাচ্ছে যা আমরা গিলতে চাই। এরই সর্বশেষ নমুনা রিয়ালে রোনালদোর আগমন কেন্দ্রিক এক মুগ্ধকর রটনা! যাতে সয়লাব নিউজ ফিড ও বিভিন্ন গ্রুপের ওয়াল।

মুনাফামূখিন পুঁজির এক অনন্য গুণ রয়েছে। যে কোনো বিষয়কেই পণ্যে পরিণত করার বিষয়ে পুঁজিবাদের যে ক্যারিশমা তা বিষ্ময়কর। আর এর খপ্পরে পড়ে খেলা, খেলোয়ার সবই হয়ে গিয়েছে পণ্য। বিক্রির দায়িত্বে রয়েছে ‘সংস্থা’গুলো। যারা খেলার প্রতি মহব্বতের ফাঁকা বুলি ছুড়ে অর্থের কাছে দাসখত লিখে দিয়ে সচেতনভাবে গলা টিপে মারছে খেলার নির্মল আনন্দকে। এটি কেন বলছি তার আগে আরেকটি বিষয় একটু খেয়াল করা দরকার, নতুবা ধোঁয়াশা কাটার বদলে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা রয়েছে।

সাংবাদিকতাকে এক কালে মহান পেশা বলা হলেও বর্তমান বাস্তবতায় এটি হচ্ছে ক্যানভাসিংপ/ প্রোপাগান্ডা। আমার কথা তিক্ত, আক্রমণাত্মক মনে হতে পারে, কিন্তু এ বাস্তবতাকে কবুল না করে উপায় নেই। যেমনটি বলছিলাম, পুঁজিবাদের এক অনন্য গুণ রয়েছে। সে গুণের বদৌলতে খবরও এখন পণ্য! সেটিকে রঙ চঙ মাখিয়ে যতটা সম্ভব চটকদার করে বিক্রি করেন সাংবাদিক নামক ক্যানভাসাররা। আর সে রঙের ভুবনে খেই হারায় পাঠকরা।

এবার আসি রোনালদো প্রসঙ্গে। আলটপকা এমন একটি সংবাদ নিয়ে এতটা হৈ চৈ-র কারণটা কি? রোনালদোর ব্রান্ড ভ্যালু? তা তো অবশ্যই। কিন্তু সেটিকে এভাবে কাজে লাগাতে হলো কেন? আপনি যদি ফুটবলের নিয়মিত অনুসারী হন তবে তো এতদিনে এটি নিশ্চয় জানেন যে, এক যুগেরও বেশি সময় পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টারের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে মেসি-রন যুগলের যাত্রা। আমাদের মতন কিছু অচল আধুলি ছাড়া ফুটবল নামক পণ্যের যারা ক্রেতা তাদের হৃদ-মন্দিরে ক্লাবের বদলে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছেন নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়ার। আরো নির্দিষ্ট করে যদি বলি রন-মেসি সমর্থকরা। এবার আসেন একটু গভীরে দেখতে চেষ্টা করি।

এত বড় একটি মৌসুম এত দ্রুতই যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে ব্যবসায় ভাটা আসন্ন। সে ভাটাকে ঠেকাতেই এমন কিছুর দরকার ছিল যা বেশ লম্বা একটি সময় ধরে বিকোবে। যদি ভেবে থাকেন রনের রিয়াল পর্ব খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে তাহলে আধুনিক ‘মিডিয়া’ যন্ত্রকে চিনতে আপনার আরো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। এটিকে টানা হবে, খেঁচা হবে, পেটানো হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না এই ইস্যু মার্কেট থেকে সরে গেলেও ক্ষতি না হয়! বিশ্বাস হচ্ছে না? এক রামোস ইস্যুতে একই পত্রিকা কত রকমের খবর ছাপে একবার খেয়াল করে দেখিয়েন তবে। শুরুতে রামোস রিয়ালের দ্বন্দ্ব বাজারে আসলো। এটি বিকালো বেশ কিছু দিন। তাতে অরুচি আসার পরপর শোনা গেলো পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের কথা। চুক্তি সই হয় একটি অবস্থা। সেটির জায়গায় এখন ফের শীতল দ্বন্দ্বের কেচ্ছা গেলানো হচ্ছে, আমরা গিলছি, গিলবো।

রোনালদোর রিয়ালে আসা কেন্দ্রিক আলোচনায় মনে হচ্ছে এ পথে একমাত্র বাঁধা তার উচ্চ বেতন। আসলে কি তাই? আমাদের একটু পিছনে ফেরা দরকার। এ বিচ্ছেদ নিয়ে প্রকাশ্যে দু’পক্ষের কেউই সে অর্থে বয়ান না দিলেও মিডিয়ার বরাতেই জানা যায় শেষ দিকে কিছু তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিলো। এর পেছনে দুটি সাম্ভাব্য কারণের কথাও আমরা শুনেছি। রোনালদোর অধিক বেতন দাবী এবং কর ইস্যুতে বোর্ডের তার পাশে না থাকা; যেটিতে তিনি পরবর্তীতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।

সাংবাদিকতাকে এক কালে মহান পেশা বলা হলেও বর্তমান বাস্তবতায় এটি হচ্ছে ক্যানভাসিংপ/ প্রোপাগান্ডা। আমার কথা তিক্ত, আক্রমণাত্মক মনে হতে পারে, কিন্তু এ বাস্তবতাকে কবুল না করে উপায় নেই। যেমনটি বলছিলাম, পুঁজিবাদের এক অনন্য গুণ রয়েছে। সে গুণের বদৌলতে খবরও এখন পণ্য! সেটিকে রঙ চঙ মাখিয়ে যতটা সম্ভব চটকদার করে বিক্রি করেন সাংবাদিক নামক ক্যানভাসাররা।

 

রোনালদোর বিদায়ের পরপরই যে ব্যালনটি দেয়া হয় সে আসরটি একটু ইয়াদ করুন। দীর্ঘ দিনের সতীর্থ লুকা মদ্রিচ সেবার ব্যালন জিতলেও বহু বছরের মধ্যে পয়লাবার গড় হাজির ছিলেন রোনালদো। এবং লুকিতার সে ব্যালন জয়কে ‘কেলেঙ্কারি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন হোর্হে মেন্দেস। সেই লুকিতা এখনো রয়েছেন, এবং সেটি রিয়ালের রুহ হিসাবেই। এ ঘটনার কি কোনো জেরই নেই?

বলা হচ্ছে রোনালদো আরো দু’বছর সার্ভিস দিতে পারবেন। তার মানে যেই তাকে ঘিরে দল সাজাক তাকে দু’বছর পর ফের নতুন করে শুরু করতে হবে। রিয়াল তো দু’বছর পর ফুটবলকে বিদায় জানাবে না। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের জন্য রিয়াল তাদের দু’টি বছর কেন কুরবানী করবে? আর আপনি এটাই বা কি করে নিশ্চিত হচ্ছেন যে, রোনালদো রিয়ালে আসা মাত্রই ট্রফির নহর বইবে? বলবেন তার অতীত সে ভাবনায় সাহস জোগাচ্ছে। তাহলে আমি বলি, তার নিকট অতীত কিন্তু আশা জাগাচ্ছে না।

আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্লাব হুট করেই হয়ে যাই নি। এর একটা লম্বা সিলসিলা আছে। ইতিহাসের পাঁচজন সেরা খেলোয়াড়ের তালিকা করলে তাতে আমাদের কমপক্ষে দুটি নাম নিশ্চিতভাবেই থাকবে। এ ধরনের খেলোয়াড় আমাদের জন্য নতুন না। গ্যালাক্টিকোস এর সময় চারজন ব্যালন জয়ী একই সাথে ক্লাবে ছিলেন। এবং কারো ব্যক্তিগত দিক চিন্তা করে ক্লাব তার দিশা বদলায় নি।

রোনালদো সমর্থকরা বলছেন রন রিয়ালে আসলে আরেকটি ব্যালন জিততে পারেন। হয়তো পারেন। সেটি করতে গেলো পুরো দলেরই সাহায্য লাগবে। কিন্তু যাদের সাহায্যে তিনি আগের চারটি ব্যালন জিতেছিলেন তাদেরই একজনের ব্যালন জয়ের ঘটনাটিকে তারই এজেন্টের কেলেঙ্কারি আখ্যা দেয়ার পর সে আদমি রনের জন্য আগের মতই সব দিতে পারবেন কি না? একটি দল হিসেবে গড়ে উঠার বদলে রিয়াল নিজেদের দু’টো বছর কুরবানি দিবে কি না? আর যদি তিনি না পারেন, তাহলে দায়টা কার হবে? মেসি-রন সমর্থকদের একটি সহজাত স্বভাব তো রয়েছে। জিতলে কৃতিত্ব তাদের প্রিয় খেলোয়াডের হারলে বাকি সবার। তো হারার দায় নিজেরা নিয়ে জেতার কৃতিত্ব কেবল এক জনের হাতেই কেন তুলে দিতে রাজী হবে বাকিরা? বিশেষ করে যখন তাকে ছাড়াই দল অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

রোনালদো ছাড়া রিয়াল পাঁচ বছরেও কিছু জিততে পারবে না বলে শুনেছিলাম আমরা সেই সময়। সেটিকে অসাড় করে রোনালদোকে ছাড়াই রিয়াল লিগ জিতে দেখিয়েছে। এবং মৌসুম সেরার খেতাব জিতেছেন রোনালদোর জন্য নিজের ক্যারিয়ার কুরবান করা বেনজামা। সেটি নিয়ে কিন্তু মিডিয়া খুব বেশি হৈ চৈ করেনি। কারণ- রোনালদো ছাড়া রিয়াল জিতবে না; এ খবর বর্তমানে যতটা বিকোবে রোনালদো ছাড়া রিয়াল জিতেছে সেটি তত বিকোবে না।

রন চলে যাওয়ায় লা লিগা নাকি কোনো টিভি চ্যানেলের কাছে সত্ব বিক্রি করতে পারেনি! একটু মাথা খাটান। রন চলে গেলেও মেসি এখনো লা লিগায় রয়েছেন। যে বাজারে লা লিগা টিভি সত্ব বিক্রি করতে পারে নি বলছেন সে বাজারে কিন্তু মেসির জনপ্রিয়তাই বেশি; তা মানতে আমাদের যত কষ্টই হোক না কেন।

 

একটি হাস্যকর বয়ান বাজারে রয়েছে, রন চলে যাওয়ায় লা লিগা নাকি কোনো টিভি চ্যানেলের কাছে সত্ব বিক্রি করতে পারেনি! একটু মাথা খাটান। রন চলে গেলেও মেসি এখনো লা লিগায় রয়েছেন। যে বাজারে লা লিগা টিভি সত্ব বিক্রি করতে পারে নি বলছেন সে বাজারে কিন্তু মেসির জনপ্রিয়তাই বেশি; তা মানতে আমাদের যত কষ্টই হোক না কেন। সেই মেসি থাকার পরেও লা লিগা তার বাজার হারিয়ে ফেলেছে বলে যারা প্রচার করছেন তাদের অনুরোধ করবো পুরো বিষয়টা জেনে আসতে। কিছুদিন আগেই স্প্যানিশ ফেডারেশনের কর্তা মশাই জানিয়েছেন মেসিও চলে গেলে তার ধাক্কা যাতে সামাল দেয়া যায় তার সমস্ত বন্দোবস্তই তারা করে  রেখেছেন। প্রত্যেকটি বোর্ড পুঁজিবাদের ফটকাবাজি বেশ ভালো করেই রপ্ত করেছে। এত সহজেই তারা খেই হারাবে এটি ভাবলেন কি করে?

পুঁজিবাদ নিয়ে কোন তাত্ত্বিক আলোচনা করবো না। এডাম স্মিথ বা কার্ল মার্কসের দোহাই দিয়ে কঠিন প্রসঙ্গেও যেতে চাই না। কর্পোরেট জমানায় পুঁজির ফটকাবাজির ধরণ করোনার স্ট্রেইনের চেয়েও দ্রুত ভোল পাল্টায় ফলে এটা নিয়ে চূড়ান্ত ধারণা পেশ করা পুঁজির প্রধান তাত্ত্বিক মার্কসের পক্ষেও সম্ভব হয় নাই। এখন মার্কস বেঁচে থাকলে হয়তো এটাকে রুপকথার ভয়ানক আছর হিসেবে দেখতেন। যাক সহজ ও  নির্মম কাহিনী দিয়েই শেষ করি। এক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি পুঁজিবাদের উপর জ্বি-জান লাগিয়ে আমল করতেন। তিনি স্থির ইয়াকিন করতেন সব কিছুরই একটা মূল্য আছে। এবং সে মূল্য দিয়ে তিনি ফি সপ্তাহে নতুন নতুন তরুণীর কুমারীত্ব কিনতেন। যা তাকে একটি পৈশাচিক আনন্দ দিতো। এ ধরনের মানুষদের ক্ষেত্রে যা হয়, তার সংসার জীবন ছিল নামকাওয়াস্তে। সন্তানদের ভরণ পোষণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতেন তিনি। উঠতি বয়সি মন কিন্তু শুধু অর্থ না, মোহাব্বতের কাঙ্গাল হয়। সেটি না পাওয়া থেকে জন্ম নেয় হতাশা যার শেষ হয় ভুল পথে পা বাড়িয়ে।

তো, সে আদমির এক কন্যা সন্তান ছিল। যে হাপিয়ে উঠেছিলো পরিবারের বিষাক্ত পরিবেশে। সেখান থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে পা বাড়ায় অন্ধকার পথে। যা আমাদের মুখোমুখি করে এক নির্মম বাস্তবতার।

অভ্যাস মতন ভদ্রলোক হাজির ব্রোথেলে। নতুন কারো কুমারিত্ব কিনবেন, সে আনন্দেই বিভোর হয়ে অপেক্ষা করছেন তরুণীর। দরজায় টোকা পড়লো, মনের আনন্দে দরজা খুলে ভদ্রলোক যা দেখলেন তা তিনি সহ্য করতে পারেননি। দরজার সামনে দাঁড়ানো তার নিজেরই মেয়ে! মূল্য দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের কন্যার কুমারিত্বই কিনতে চলেছিলেন! পুঁজিবাদের মূল্য তত্ত্বের এক নির্মম নিদর্শনের সমাপ্তি ঘটে এরই পূঁজারী ঐ আদমির আত্মহত্যা দিয়ে।

তেমনি কিছু আদমি খবর দেয়ার নাম করে কিনে নিতে চাইছেন আমাদের আবেগ। আমাদের পরিচালিত করছেন তেমন ভাবেই যেমনটি তারা চান। আমাদের চিন্তার অসাড়তা তাদের ঠোঁটে যে মৃদু মুসকানের জন্ম দিয়ে চলেছে তা হলফ করেই বলে দেয়া যায়।

সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।

মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
Paypal https://paypal.me/jobanmedia

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নাম *