আমেরিকার যেমন একটা ইসরায়েল আছে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে চায়নার আছে ইরান- এমন কথা মার্কিনপন্থি চিন্তাসংঘগুলো সম্প্রতি জোর দিয়ে প্রচার করছে। বিভিন্ন চিন্তাসংঘ ইরান-চিন সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে।
মাইলস মাওচুন ইউ (Miles Maochun Yu) হচ্ছেন হুভার ইনস্টিটিউশনের (Hoover institution) ভিজিটিং ফেলো। হুভার ইনস্টিটিউশনের কাজ হলো আমেরিকার স্বার্থ, কর্তব্য ও কর্মের রিসার্চ করা। মার্কিন অন্যতম থিংকট্যাংক এই প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে গবেষণা করছে। তিনি (মাইলস) ১৫ই জুন চায়না ইরান গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এক নিবন্ধ লিখেছেন। যা হুভার ইনস্টিটিউশনের সাইটে ছাপা হয়েছে।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মূলত মার্কিন স্বার্থের জায়গা থেকে যেমনটি হওয়ার কথা তেমনই। তবে তিনি মাও বিপ্লবের সাথে ইসলামী বিপ্লবকে এক কাতারে দাড় করিয়েছেন। যদিও শুরুটা করেছেন সম্পূর্ণ উল্টো জায়গা থেকে। তিনি কথা শুরু করেছেন এখান থেকে,
China does not have a fixed Iran doctrine. And Iran does not have a historic China doctrine.
চীনের নির্দিষ্টভাবে কোন ইরান ডকট্রিন ছিলো না এবং ইরানেরও কোন ঐতিহাসিক চীন ডকট্রিন ছিলো না।
তিনি এই সরল তথা Affirmative বাক্য দিয়ে সাম্প্রতিক ২৫ বছর মেয়াদি চীন-ইরান চুক্তিকে সাধারণ একটা বৈষয়িক চুক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। যদিও পাশাপাশি থাকা এই দেশ দুটির সভ্যতার ইতিহাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের অনেক আগে থেকেই সমৃদ্ধ এবং প্রভাবশালী। ঐতিহাসিক রেশম সড়ক বা silk road এর সাথে তৎকালীন অনেক দেশই সংযুক্ত ছিলো এই পথে। নতুন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক হলেও যোগাযোগ পুরোনো। তিনি বলছেন চীন মাও সেতুং এর ধারার মার্কিস্ট আইডোলজি দিয়ে বিশ্বের একটা অংশকে লিড করতে চাইছে আর উল্টোদিকে এন্টি কমিউনিস্টকে লিড করছে আমেরিকা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী দুনিয়ার বিভক্তি মূলত কমিউনিস্ট আর এন্টি-কমিউনিস্ট এলায়েন্সে। অথচ তাদের মিলিটারী থিংকট্যাংকরা ইসলামোফোবিয়াকে সামনে রেখে কমন শব্দ উচ্চারিত করেন ওয়ার অন টেরর। এই এলাইয়ে ইরানকে চীনের সহযোগী হিসেবে একটা টার্ম ব্যবহার করেছেন Occupie regim যার কাছাকাছি ভাবার্থ হতে পারে সাম্রাজ্যবাদী গোছের কিছু যারা বৈধ আমেরিকান শাসনের অবৈধ প্রতিদ্বন্দ্বী। পুরো আর্টিকেলের মধ্যে ইরান এবং চীনের বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ দিয়ে বিশ্বের একটা অঞ্চলকে চীনের বেঁধে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে একই সাথে উষ্মা আর ভীতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
পরোক্ষভাবে ইরানকে ইসরাইলের বিকল্প হিসেবে দেখছে। অনেকটা এরকম ইরান মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ইসরাইল।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক পতনের পরে ইউনিপোলার গ্লোবাল সিস্টেম মডিফাইড কলোনিয়ালিজমকে হাজির করেছে। কোন বিকল্প পথ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা কিছু, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর স্বার্থের সাথে সংঘাতপূর্ণ নয় মনে করে ততক্ষণ পর্যন্ত একটা নিশ্চয়তা থাকে। ব্যত্যয় ঘটলেই জাতিসংঘ নামক নিজস্ব হাইকোর্টের মাধ্যমে তার বিচার করে দেয়। এতে রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব কিছুর উপর তার একক শাসন করার অধিকার নিজেই প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। মার্কিন ব্লকের এই একাধিপত্য কোল্ড ওয়ার জমানায় ছিলো না। তখন একটা বৈশ্বিক ব্যালেন্স ছিলো তিনটি আলাদা জোটের মাধ্যমে। একটা মার্কিন পন্থী, দ্বিতীয়টি সোভিয়েতপন্থী এবং অপরটি জোট নিরপেক্ষ । মিঃ মাওচুন চীন -ইরান জোটকে সোভিয়েতের জোটের বিকল্প বলেন নাই তবে ইঙ্গিত করেছেন। এটা তাদের জন্য একটা আতঙ্ক বটে। মিঃ মাওচুন পরোক্ষভাবে ইরানকে ইসরাইলের বিকল্প হিসেবে দেখছে। অনেকটা এরকম ইরান মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ইসরাইল। অথচ ইসরাইলের প্রতি তাদের সর্বাত্মক সমর্থনকে বৈধ আর ইরানকে Rogue state বলছে। যদিও ইরান আর ইসরইল মধ্যকার তুলনা করা বা উভয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা এক ধরনের অজ্ঞতা। ইসরাইলের শুধুমাত্র রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেই এ রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে এতটা ঠুনকো রাষ্ট্র আর একটাও নাই। তাই তাদের টিকে থাকতে হলে টেরোরিজমের রাস্তা ধরেই হাটতে হবে।
চীন-ইরান ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিতে উভয় দেশের জন্য আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই কথাটি বারবার উচ্চারিত হলেও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে একটা ওয়ার্ল্ড অর্ডারের চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব নাগরিকের কাছে যেন এই বার্তা না পৌছায় যে এই চুক্তি বিআরআই বা বেল্ট এন্ড রোড ইনেশিয়টিভ (মেরিটাইম সহ) বেগবান করবে। বিশ্বের প্রায় ৬৮ টি দেশের সংযুক্তি ৭০ শতাংশ জনগণ আর প্রায় ৪০ শতাংশ বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারিত হওয়ার মহা পরিকল্পনা আছে এই রুটে।
এতবড় মহা উন্নয়ন প্রকল্প গোটা গ্লোবাল অর্ডারে কোন প্রভাব ফেলবে না শুধুই বাণিজ্যিক প্রকল্প এবং একমাত্র কমিউনিস্ট আইডোলজি ছড়ানো এর একমাত্র উদ্দেশ্য এই কথা আমলে নেয়ার কোন যুক্তি নেই। বরং এই মহাসড়ক বর্তমান ওয়ার্ল্ড অর্ডারের রাশ টেনে ধরবে। মার্কিন স্যাঙ্কশনের প্রভাবে কোনো রাষ্ট্র আর অচল হয়ে পড়ে থাকবে না। বিকল্প রাস্তা খুলে দেবে বৈশ্বিক জীবন ব্যবস্থার সামনে নয়া দিগন্ত।
এতবড় মহা উন্নয়ন প্রকল্প গোটা গ্লোবাল অর্ডারে কোন প্রভাব ফেলবে না শুধুই বাণিজ্যিক প্রকল্প এবং একমাত্র কমিউনিস্ট আইডোলজি ছড়ানো এর একমাত্র উদ্দেশ্য এই কথা আমলে নেয়ার কোন যুক্তি নেই। বরং এই মহাসড়ক বর্তমান ওয়ার্ল্ড অর্ডারের রাশ টেনে ধরবে। মার্কিন স্যাঙ্কশনের প্রভাবে কোনো রাষ্ট্র আর অচল হয়ে পড়ে থাকবে না। বিকল্প রাস্তা খুলে দেবে বৈশ্বিক জীবন ব্যবস্থার সামনে নয়া দিগন্ত।
ইরানের গত শুক্রবারের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে নির্বাচিত নয়া প্রেসিডেন্টকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন। ইমরান খান ইরানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান। নবনির্বাচিত ইরানি প্রেসিডেন্ট (আগস্ট থেকে অফিস করবেন) ইব্রাহিম রায়িসি তাঁর স্বাগত ভাষণে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যার মধ্যে অন্যতম প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নির্মাণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। আশা করা যায় ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে গভীর ও বিশ্বস্ত সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। ইরান-চীন সিকি শতাব্দী চুক্তির বিষয়ে ইরান কিছু না জানালেও চীন পাকিস্তানকে অনেক বিষয়ে অবহিত করেছে। চীনের সাথে ইরানের তেল ও গ্যাস সংযোগ, অবকাঠামো উন্নয়নে পাকিস্তান অঘোষিত অংশীদার। বিশেষ করে স্পর্শকাতর বেলুচিস্তান এর সাথে বেশি সংযুক্ত হবে। বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্টের নিরাপত্তার জন্য চীনের লক্ষ্য থাকবে স্থিতিশীল, নিরাপদ ও গতিশীল পরিবেশ যা পাকিস্তানেরও কাম্য। ইরানের ভিতরে প্রায় বিশ লাখ বেলচু বসবাস করে। ইরানও চাইবে তার প্রজেক্টকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে রাখতে। এই প্রজেক্টের বড় পাওয়া হবে পাকিস্তানের জন্য উন্নয়নের অংশীদার বেলুচিস্তান যা ইমরান খান ও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে।
পাকিস্তান-চীন এবং চীন-ইরান চুক্তি মূলত চীনের উচ্চাভিলাষী প্রজেক্ট বিআরইকে আরো গতিশীল করবে। বিআরআইয়ে বৃহৎ মেরিটাইম প্রজেক্টের মূলত দুটি রুট একটি সড়ক আরেকটি সাগরপথ। সাগর পথে ভারত মহাসাগরের আন্দামান সাগর থেকে শ্রীলংকা-আরব সাগর-পারস্য সাগর- এডেন সাগর-লোহিত সাগর-ভারত মহাসাগর ঘেষে আফ্রিকান কোস্ট দিয়ে চায়নার সাথে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা, মধ্য প্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা এবং গোটা ইউরোপ যুক্ত হবে। আর সড়ক পথে চীনের সাথে যুক্ত হবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপ।
মূলত পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই মহা পরিকল্পনা।
১. স্বমন্বিত নীতি
২. অবকাঠামোগত সংযুক্তি
৩. নিরবচ্ছিন্ন বানিজ্য
৪. আর্থিক সংহতকরণ
৫. জন যোগাযোগ
প্রত্যেকটি পয়েন্টই এ অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ফলে মার্কিন অর্থনৈতিক স্যাংকশন এখানে ধোপে টিকবেনা। তার উপর বিআরআই তার আর্থিক নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই ডলারের বিকল্প রাখবে। ফলে একটা দুই দুনিয়াভিত্তিক ব্যবস্থাপনার কাউন্টডাউন কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। সেই শুরুর কুশীলব চীনের সহযাত্রী হচ্ছে ইরান এবং পাকিস্তান। এতে এই রাষ্ট্রগুলোর নতুন বিশ্বব্যবস্থায় একটা প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা থাকবে ধারণা করা যায়। এই মহাপ্রজেক্ট তার নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্য আলাপ তবে এ অঞ্চলে নতুন করে অস্থিতিশীল ঘটনা ঘটুক বা কোন অংশীদার রাষ্ট্রে বাইরে থেকে আঘাত আসুক সেটা নিশ্চয়ই কেউ মেনে নেবে না। তাই এই প্রজেক্টে অর্থনীতির সাথে কৌশলগত নিরাপত্তা ও সামরিক বিষয়য়টি থাকবে।
হুভার ইনস্টিটিউশন থেকে প্রকাশিত তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিবন্ধের শিরোনাম করেছে,
(Relations between China and the Gulf States: Opportunities and Risks for Israel)
চীন এবং উপসাগরীয় দেশের মধ্যে সম্পর্কঃ ইসরাইলের সুযোগ ও ঝুঁকিসমূহ।
নিবন্ধের গভীরে গেলে ইসরাইলের সম্ভাবনা আর সুযোগের বিপরীতে ভীতি ও আশংকা বেশি। মধ্যপ্রাচ্যে এবং এর বাইরে ইসরাইল-আমেরিকার সম্পর্কের বিপরীতে দেখা হচ্ছে তেহরান-বেইজিংয়ের সম্পর্ককে। আবার বেইজিংয়ের মুখোমুখি যেমন ওয়াশিংটন তেমনি তেল আবিবের মুখোমুখি তেহরান। মধ্যপ্রাচ্যে জালের মত ছড়িয়ে আছে ইরান সমর্থিত যোদ্ধারা যারা ভবিষ্যতে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেই সাথে চীনের ইনভেস্টমেন্ট এবং ট্রেডের ব্যাপ্তি, বেল্ট এন্ড রোডের সংযুক্তি যা পশ্চিমা স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ। সময়ের পরিক্রমায় আরব রেজিমগুলোর টিকে থাকতে পশ্চিমের প্রতি একক আনুগত্য পূনর্বিবেচনা করে নীতি সাজাতে অনেকটা বাধ্য হবে। তেলের বিকল্প ক্রেতা, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বসবাসের বিষয়টি মাথায় রেখেই গাল্ফ স্টেইটগুলো নিশ্চই সামনের দিনগুলোতে নীতি নির্ধারণ করবে। ফলে চিন-ইরান সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যে শুধু ইসরায়েলকেই নয়, গোটা পশ্চিমা নীতির দখলদারি ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia