কোন কোন কালে ব্যক্তি মানুষ বা গোটা জাতির জীবনে এমন সময় আসে যখন সে বা তারা আর বুঝতে পারে না প্রকৃতই তার অস্তিত্ব বিরাজমান আছে কি না? আমাদের গোটা জাতির জীবনে এখন যে সময় বিরাজ করছে তাতে আমাদের দেশের মানুষ আদৌ ‘অস্তিত্ববান’ কি না সেই প্রশ্ন উঠছে। আমরা কি বিরাজ করি? আমাদের কি কোন অস্তিত্ব আছে? অস্তিত্বকে উপলব্ধি করার জন্য দুনিয়ার সাথে সত্যের সম্পর্ককে আগে রক্ষা করতে হয়। সত্য নিহত হলে আমরা যে মিথ্যার মধ্যে নিপতিত হই তাতে আমাদের অস্তিত্ব বিষয়ক কোন বোধ থাকে না। পশুর মতো হয়তো বেঁচে থাকা হয়, কিন্তু মানুষ হিসেবে অস্তিত্ববান থাকার যে গৌরব তা আর থাকে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনী যখন ফ্রান্স দখল করে নেয়, যখন চারদিকে ফ্যাসিবাদি চিন্তার জোয়ার তখন গোটা সভ্যতা ও জাতীয়তাবোধের এমন এক সংকট ফ্রান্স ও ইউরোপের মানুষের জীবনে হাজির হয়েছিল যে, মানুষ নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে ফ্যাসিবাদের যে জোয়ার তাতে ভেসে গিয়েছিল। জনজোয়ারের সুবাদে ফ্যাসিবাদ শুধু ক্ষমতাই দখল করে না। দখল করে মানুষের মনোজগতও। গোটা জার্মান জাতির মনোজগতের এই দখল কায়েম করেই উত্থান ঘটেছিল একজন হিটলারের। ফলে মনোজগতের উপর নিয়ন্ত্রণটা দূর করা না গেলে, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার বোধই উপলব্ধি করার ফুসরত হয় না। কারণ তখন ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার বোধ নষ্ট হয়ে যায়। মিথ্যাকেই আদর্শ ও গৌরবজনক মনে হয় এবং এর মধ্যেই কোন রকমে বেঁচে থেকে যতটা পারা যায় দুনিয়াবি বা বস্তুগত বাসনা পূরণ করে নিজেকে সুখী করার চেষ্টা করে মানুষ। এই স্বার্থপরের মতো চিন্তা গোটা সমাজে যে পচন ধরায় সেটাই অত্যাচারের ধারাকে স্বাভাবিক করার সংস্কৃতি চালু করে। এটা করার জন্য সমাজের একটা গোষ্ঠী বা কমিউনিটিকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে দমন বা বিনাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্মতি ও সংহতি পয়দা করা হয়। এতে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াও দরকারি ভূমিকা পালন করে। তাদের সহযোগিতায় সমাজের একটা অংশকে জাতি বিরোধী বা রাষ্ট্র বিরোধী, ঘৃণিত ও শত্রু হিসেবে হাজির করে বিপুল মানুষের সংহতি তৈরি করে গণহত্যার যে পরিবেশ তৈরি করা হয় তাতে মানুষের নিজের অস্তিত্বের বোধ নষ্ট হয়ে যায়। যখন সে গোটা প্রক্রিয়াটা বুঝতে পারে এবং নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়ায় তখন সে আসলে বুঝতে শুরু করে যে, সে নিজের জীবন যাপন করে না। সে ক্ষমতার নীতির আলোকে যে হুজুগে জীবনবোধকে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে -সেই জীবনকেই নিজের জীবন মনে করে নির্বিকার ছিল। কখনও বা অন্যায়ের নীরব বা সরব সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ফলে এটা যত দেরিতে মানুষ অনুভব করে ততই ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। নিজের অস্তিত্বহীনতার বোধ মানুষকে তখন এতোটাই বিপন্ন করে যে জীবনের আর কোন অর্থ থাকে না। চারদিকে নেমে আসে হতাশার কালো ছায়া। ফলে আমাদের প্রধান সংগ্রাম হলো এই অস্তিত্বের বোধ ও মর্যাদাকে যা কিছু মুছে দেয়, ভুলিয়ে দেয় তার বিরুদ্ধে চিন্তাশীল সংগ্রাম জারি রাখা। এটাই জবানের অত্যতম প্রধান কাজ।
বিষয়টা আরও একবার অন্যভাবে বলি, ফ্যাসিবাদি শাসন আমাদের সমস্ত মূল্যবোধ ও নীতির ধারণাকে এমন ভাবে হত্যা করে যে, তাতে একটাই মাত্র বাস্তবতা তখন মানুষের মনোজগত দখল করে। সেই বাস্তবতা হলো, শাসনের সহায়ক যুক্তি। সন্ত্রাসবাদী যুক্তিকেই আদর্শ হিসেবে প্রচার করা হয়। এই প্রচারকে সত্যে পরিণত করতে যতপ্রকার মিথ্যা দরকার সবই নিষ্ঠার সাথে উৎপাদন করা হয়। এই অবস্থায় গণ-মনোজগতেরও একটা ফ্যাসিবাদি রূপান্তর ঘটে। আর এমন অবস্থাতেই মানুষ হারিয়ে ফেলে তার অস্তিত্বের দায়-বোধ। মানে আমরা যে আছি সেই বোধই মরে যায়। দুর্নীতিই তখন নীতি হয়ে যায়। আমরা মনে করি, আমি যেটা ভাল মনে করি এর বাইরে আর কোন ভাল নাই। আমি যেটা মন্দ মনে করি সেটাই একমাত্র মন্দ। এই ভাবে মোরাল ব্লেইমের এক খেলাতে আমরা প্রকৃত বাস্তবের বহুমূখীন যে উপস্থিতি তার বোধই হারিয়ে ফেলি। হয়ে উঠি একচোখা প্রাণী।
আমরা শাসনতন্ত্রের বাস্তবতার ভেতরই কেবল বেঁচে থাকি। নিজেদের কোন জীবন থাকে না। ফলে এই যে চৈতন্যহীন, অস্তিত্বহীন অবস্থা এটাকে বুঝতে পারার জন্য দরকার চিন্তাশীল কর্ম-তৎপরতা।
যে বিপুল আয়োজন ও প্রতাপের মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্বের বোধকে নাই করে দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া এমন সময়ে ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকার কোন সুযোগ নাই।
ফলে জবানের প্রথম কাজ হলো, আমাদের অস্তিত্বের বোধকে সজাগ করা। আমরা যে বেঁচে আছি এই সংবাদটি আপনাদের জানিয়ে দেয়া। যে ফ্যাসিবাদি বাস্তবতায় আমাদের নিজেদের সব ‘রিয়েলিটি’কে হত্যা করে আমাদের আস্তিত্বহীন, চৈতন্যহীন করে দেয়া হয়েছে তাকে দার্শনিকভাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করা। এটা খুব সহজ কাজ নয়। এই কাজ করতে গিয়ে আমাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। আরও হবে হয়তো। কিন্তু এই সংগ্রাম তো আপনার-আমার সবারই।
বাংলাদেশের মানুষ নিজের ‘অস্তিত্ব’ নিয়ে আজ টিকে থাকার সামর্থ্য হারিয়েছেন। অস্তিত্বের যে গভীর বোধ দরকার তাও আমাদের চারপাশে গরহাজির। এই করোনার সময়েও আমরা দেখলাম আমাদের জীবন মৃত্যুর ভয় ও প্যানিকে বা শঙ্কায় ভরে উঠেছে। আমরা আমাদের জীবের জীবন নিয়ে এমনভাবে ব্যস্ত ছিলাম যে মানুষের অস্তিত্বময় উপস্থিতির চর্চা এই সময়েই বরং খুব বেশি দরকার ছিল তা বারবার মনে হচ্ছে। এই বোধ জারি থাকলে আমরা মৃত্যুর বোধ দ্বারা চালিত না হয়ে জীবনের সংগ্রামের জন্য এক মানবিক মর্যাদাময় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারতাম যা এই কঠিন সময়কে মোকাবেলা করতে খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করতো। তখন হয়তো এই মহামারিই তৈরি হওয়ার সুযোগ পেত না। আমরা জীবনের জন্য পরিবেশ ও প্রাণের যত্ন নিতে শিখতাম। ফলে আমাদের মানুষী অস্তিত্বের অনুভবকে প্রতিমুহূর্তে চর্চার যে চিন্তাশীল অনুশীলন দরকার তার প্রয়োজন এখন আরও ব্যাপকভাবে হাজির হয়েছে।
জবানের প্রথম কাজ হলো, আমাদের অস্তিত্বের বোধকে সজাগ করা। আমরা যে বেঁচে আছি এই সংবাদটি আপনাদের জানিয়ে দেয়া। যে ফ্যাসিবাদি বাস্তবতায় আমাদের নিজেদের সব ‘রিয়েলিটি’কে হত্যা করে আমাদের আস্তিত্বহীন, চৈতন্যহীন করে দেয়া হয়েছে তাকে দার্শনিকভাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করা। এটা খুব সহজ কাজ নয়। এই কাজ করতে গিয়ে আমাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। আরও হবে হয়তো। কিন্তু এই সংগ্রাম তো আপনার-আমার সবারই।
সবাই একধরণের চলতি ট্রেন্ডে ডুবে আছে, নিজের প্রাণের সত্যের সাথে আপোষ করে ফ্যাসিবাদি সত্য যা মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর তার সাথে আপোষ করে বেঁচে থাকাই নিরাপদ মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ। এই জন্য জবানের পথ কঠিন। এই কঠিন পথে খুব কম মানুষ নিজেকে পরিচালিত করতে রাজি হন। ফলে অনেক মানুষ আমাদের এই গভীর সংগ্রামকে উপেক্ষা করে গোলামির জীবনের ভেতর দিয়ে নিজের সাথে প্রতারণার পথকে বেছে নিয়ে আমাদের সাথে শত্রুতার সম্পর্ক চর্চা করতে শুরু করে। অকারণে আমাদের শত্রু মনে করে। ফ্যানাটিক বাস্তবতার গোলামীতে নিজেকে হাজির করে আত্মতৃপ্তিতে মজে থাকার বিরোধিতা করাই যেন আমাদের অপরাধ!
কিন্তু জবানের কোন শত্রু নাই- সত্যের শত্রু ছাড়া। আমরা আমাদের অস্তিত্বের বোধ নির্মাণের সংগ্রামে নিয়োজিত। এর জন্য ইতিহাস, সংষ্কৃতি, জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে আমাদের ব্যক্তি জীবনের ধরণকেও আমরা প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করি। চারদিকে যে জনপ্রিয়তাকামী ফ্যানাটিক সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও রাজনীতিহীন রাজনৈতিক বিশ্লেষণের বিপুল বাণিজ্য তৈরি হয়েছে এর বিরুদ্ধে নতুন করে আরম্ভ থেকে শুরু করার কাজটি করতে চায় জবান। এবং সারা দেশের ও বিদেশের অনেক তরুণ-তরুণী জবান ফোরামে যুক্ত হয়ে নিজেদের বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবেন। এবং দেশ ও জাতিকে জ্ঞানগতভাবে সেবা করার জন্য একটা সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ে তুলতে এই প্লাটফর্ম দরকারি ভূমিকা পালন করবে আশা করি।
কেন না- এই কাজটি একটি সম্মিলিত কাজ। এই লেখাটাকে তাত্ত্বিক জটিলতার বাইরে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিষয়টা পরিস্কার করার জন্য ছোট করে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। বিং/অস্তিত্বময়তা অথবা এক্সিসটেন্স ও এসেন্সের সম্পর্কটা দার্শনিক ভাবেও বুঝতে পারা দরকার। এক্সিসটেন্স বা অস্তিত্বময়তাকে সহজে বুঝতে পারা যায় যদি এভাবে বলতে চেষ্টা করি, being( what is) আর essence(isness)- যদি এই ভাবে বুঝি তা হলে জটিল বিষয়টাও সহজে বুঝতে পারা সম্ভব। বিং/অস্তিত্বময়তা বলতে বুঝায় আমরা কি (হোয়াট ইজ) আর আমাদের এসেন্স হলো এই ইজনেস মানে আমরা যা তাই আমাদের এসেন্স। এখন যখন আমরা নিজেদের চোখের সামনে ঘটতে থাকা মিথ্যা ও অন্যায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচালিত করতে থাকি, একটার পর একটা প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে দিতে থাকি তখন বিং বা আমাদের অস্তিত্বময়তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, হোয়াট ইজ? এই প্রশ্নটা করলে তার উত্তর যেটা সমানে আসে, সেটা পুরাই ফেইক বা মিথ্যার দ্বারা আপদমস্তক পরিবেষ্টিত এক আমি। আসল বা প্রকৃত আমিকে পাওয়া যায় না। এবং আমির এসেন্স বা ইজনেসটাও হয় মিথ্যা। এভাবে আমাদের অস্তিত্বই নাই হয়ে যায়।
অর্থাৎ মনে রাখতে হবে, আমাদের অস্তিত্বময়তা মানে আমরা খোদ/প্রকৃতভাবে যা সেই মৌল বোধকে ধারণ করে বাঁচা। এসেন্সের ভাল বাংলা না করে এটার অর্থ আমরা এভাবে করতে পারি, যেমন আমরা যে কারণে মানুষ সেই ‘কারণ’টা কে বলা যায় মানুষের এসেন্স। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের অস্তিত্বময়তার এসেন্সকে রক্ষা করতে হলে সত্যকে রক্ষা না করে তা করা সম্ভব না। ফলে যখন মিথ্যার মধ্যে মানুষ থাকে তখন সে অস্তিত্ববান (what is) থাকে না। কিন্তু যখন যে অস্তিত্ববান থাকার সংগ্রাম করেন তখন তার এসেন্স (isness) মানে যে কারণে সে মানুষ এই বোধটিকে ধারণ করতে সক্ষম হয়। ফলে সত্যের সাথে সংযোগ ছাড়া মানুষের অস্তিত্বময়তা যেমন কোন অর্থ বহন করে না তেমনি এসেন্সও থাকে না। সরল করে এখানে এতটুকুই থাক।
আমাদের অস্তিত্বরক্ষার ধারণাটার দুটি ধরণ আছে। যেটাকে অস্তিত্ববাদি ফরাশি দার্শনিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার জাঁ পল সার্ত্র ১. ‘Being-for-itself’ (Poursoi; consciousness, cogito) এবং ২. ‘Being-in-itself’ (En-soi) -বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথম ধারার অস্তিত্বের ধারণা সমৃদ্ধ মানুষ একজন মুক্ত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে ভাবেন। এবং সচেতন ও স্বাধীনভাবে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করেন। এটা নিজের মধ্যেই নিজেকে নির্মাণের একটা প্রক্রিয়া। অন্যদিকে দ্বিতীয়ত, জগতের সাথে তার অস্তিত্বের সম্পর্ক তিনি অনুভব বা প্রতিষ্ঠিত করতে সজাগ থাকেন। অপরের সাথে এই অস্তিত্বের বোধটাকে তিনি সম্পর্কিত করতে সচেষ্ট থাকেন। তাইলে এটা কোনভাবেই সাবজেক্ট-অবজেক্ট সম্পর্কের মতো না। এটাই মার্কসের শ্রেণির আলোচনা থেকে এই তর্ককে আলাদা করেছে। এবং সহজ করে বললে এই যে, প্রথমে নিজেই নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে সজাগ হওয়া এবং পরে জগতের সাথে সম্পর্কের আলোকে এই অস্ত্বিত্বকে পরখ করে দেখা- এটা একটা যৌথ প্রক্রিয়া। কারণ, যে আমি বা সাবজেক্ট এটা করে সেও জগতেরই একটা অংশ। ফলে তার আছে এক নিজের আমি, আর আছে এই আমির সামনে একটা জগত। যেই জগতে তার মতো আরও বহু মানুষ আছেন। যেই মানুষগুলোও তার মতো এই জগতে আগে থেকেই হাজির আছে। তাদের নিজেদের মতো করে হাজির আছে। ফলে এখানে নিজেকে আলাদা বা সেরা মনে করার কোন কারণ নাই।
তাই এই অস্তিত্বের সংগ্রাম কোন ব্যক্তি মানুষের একার সংগ্রাম না। এখানে একটা যৌথতা বা টুগেদারনেস আছে দেখতে পাচ্ছি। ফলে যারা ভিন্নতা দেখেই অপরকে ঘৃণা করেন, নিজেকে সেরা মনে করেন তারা এই বৈচিত্র্যময় অস্তিত্বের ঐক্য ও এর রাজনৈতিক সম্ভবনাকে বুঝতে অক্ষম। অন্যদিকে সিলেক্টিভ মানবতাবাদও অস্তিত্বের হক আদায় করতে পারে না। এই জন্যই অস্তিত্ব সচেতন মানুষ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ দ্বারা চালিত না হয়ে বরং জগতের অন্যান্য সবার অস্তিত্বের মর্যাদার ব্যাপারে সজাগ হয়ে ওঠেন। ফলে এই বিষয়টি দার্শনিকভাবে বুঝতে পারা খুব জরুরি।
এই অস্তিত্বের বিষয়টিকে গোটা জগতের সাথে জীবনের সম্পর্কের মূল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় পোষ্ট হাইডেগারিয়ান দর্শনের আলোচনায়। যাক এই জটিল তাত্ত্বিক আলাপ উস্কে দিয়ে এখানে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না। তারপরেও এটা এখানে বলার কারণ হলো, এটা বুঝতে চেষ্টা করা যে, আমরা যা করতে যাচ্ছি সেই বিষয়ে আমাদের চিন্তাশীল, দার্শনিক ও ম্যাথডোলজিক্যাল ইনভেসটিগেজশন/নিরীক্ষণ সব সময় জারি আছে।
শেষ করার আগে আরও একটা প্রসঙ্গ ছোট করে বলি, তথ্যকে যারা সত্য নিরূপণের হাতিয়ার মনে করেন তারা জানেন এই তথ্যকে জন্ম দেয়া যায় জালেমি সত্যকে নির্মাণ করার জন্য। এবং একদল দলদাস ও চিন্তার নামে ছদ্ম বুদ্ধিজীবী দিয়ে একটা ন্যারেশন/বয়ানও তৈরি করা যায় খুব সহজে। সেই বয়ানের মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠীর চৈতন্যকে শাসন করে কায়েম করা হয় ফ্যাসিবাদ। তথ্য বা ফ্যাক্ট মানে ট্রুথ না। তাই আমরা এই বায়না বা ইন্টারপ্রিটেশন এর রাজনীতিকে ডিকনসট্রাক্ট বা অবিরাম নির্মাণ করতে চাই। এই নির্মাণের জন্য আগে দরকার আমরা আমাদের অস্তিত্বের যে বোধ হারিয়েছি তাকে উদ্ধার করা। আমরা যে আসলেই বিরাজ করি তা জানান দেয়ার জন্য দরকার যে বয়ান আমাদের অস্তিত্বকে নাই করে দিয়েছে তাকে দার্শনিকভাবে পরাজিত করা। এটা একটা যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের জন্য দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সততা। জবান এই সততার পরীক্ষায় আপনাদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে ইতোমধ্যে।
উপরের আলোচনা থেকে আশা করি এতক্ষণে এটা পরিস্কার যে কেন জবান দরকার। কেন এই সময়ে জবান অ-বিকল্প। মিডিয়া হিসেবে যেগুলো আছে তার মূল সমস্যা হলো, এগুলো সবগুলোই ক্ষমতার প্রচার যন্ত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে কম বেশি। কারণ বৃহৎ পুঁজির মিডিয়া ক্ষমতার সাথে আপোষ করতে বাধ্য। ফলে কর্পোরেট মিডিয়া কখনও গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে না। জনগণের আস্থা যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য যতটা দরকার ততটা সাংবাদিকতা করতে চেষ্টা করে- এর বাইরে জনগণের প্রতি তাদের কোন কমিটমেন্ট থাকে না, সেটা দরকারও নাই। তাই জবান কোন বৃহৎ পুঁজির মিডিয়া না। এটা জনগণের টাকাতেই গড়ে উঠেছে। জনগণই এটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আগামীতে মানুষ জবানকে আরও শক্তিশালী হতে তাঁদের সাহযোগিতার ধারাকে আরও বেগবান করবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
এখানে যেহেতু জবানের প্রয়োজনীয়তা ও নীতিগত দার্শনিক অবস্থান আলোচনা করছি তাই ছোট করে জবানের পরিচিতিটাও একটু দেয়া দরকার।
জবান প্রথম ২০১৩ সলে ২ টাকা দামের ট্যাবলয়েড পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। মাত্র একটা সংখ্যা প্রকাশের পরেই সেই প্রিন্ট পত্রিকা বন্ধ করতে আমরা বাধ্য হই। তারপরে আমরা অনলাইনে দ্বিভাষিক ম্যাগাজিন হিসেবে কাজ শুরু করি। অল্পদিনেই চিন্তাশীল পাঠকদের কাছে এটা গ্রহণযোগ্যতা পায়, সেটা একটা ব্লগ সাইট ছিল। এবং ২০১৮ সালে জবান আবার নতুন করে বিশ্লেষণী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে কাজ শুরু করে। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চের ২১ তারিখে আমাদের সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের উপর নেমে আসে অনিরাপত্তার কালো হাতছানি। এটা শুরু থেকেই ক্ষুদ্র উদ্যোগের মিডিয়া ছিল। কোন বড় ইনভেস্টমেন্ট আমাদের নাই।
এর পরে আমরা চেষ্টা করি নতুন করে আবার প্রকাশের। এবং ২ বছর প্রচেষ্টার পরে অবশেষে আমরা মাসিক পত্রিকা হিসেবে নিবন্ধন পাই এবং বর্তমানে প্রিন্ট ও অনলাইন ফরমেটে জবান আপনাদের সামনে হাজির হয়েছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন একটি মিডিয়াকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই জনগণের কাতারে দাঁড়িয়েই টিকে থাকতে হবে। নতুন জবানের শ্লোগান হলো- ‘চিন্তাশীল পাঠকদের প্রথম পছন্দ জবান’ । আমরা মতামত উৎপাদন ও ব্যাখ্যার রাজনীতির যে পরিমণ্ডল বিরাজ করছে তাকে বিনা প্রশ্নে ছেড়ে দিতে চাই না। ফলে যারা অতি ক্ষুদ্র স্বার্থে আমাদের বিরোধিতা করেন। বিভিন্ন নামে আমাদের ট্যাগ করেন তাদের বলব- অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। চিন্তাকে চিন্তা দিয়েই লড়তে হয়। সেইটার জন্য যে পরিশ্রম ও সততা দরকার হয় তা না থাকলেই মানুষ নোংরা পথ বেছে নেয়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না।
বাংলাদেশের মুক্তিকামী, চিন্তাশীল পাঠকরা আমাদের সাথে আছেন। এমন মিডিয়া কেবল মাত্র জনগণকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে পারে, টিকে থাকতে পারে। আমরাও তাই বিশ্বাস করি যারা আমাদের অস্তিত্ব উদ্ধারের সংগ্রামের সাথে একমত তারাই জবানের অংশীদার। আপনারা প্রিন্ট পত্রিকার গ্রাহক হতে পারবেন যে কোন স্থান থেকে। এবং অনলাইনে প্রিন্টের এবং অনলাইনের লেখা পড়তে পারবেন। আশা করি, আপনারা জবানের পথ চলাকে সহজ করতে যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন। এই সংগ্রাম আমাদের নতুন ইতিহাসকে নির্মাণের পথকে সহজ করুক -এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia