Joban Magazineএইধরণের লিট ফেস্ট কেন আমাদের সাহিত্যের কোন কাজে আসবে না

ওয়েব সংস্করণ/সাহিত্য

এইধরণের লিট ফেস্ট কেন আমাদের সাহিত্যের কোন কাজে আসবে না

রেজাউল করিম রনি

এইধরণের লিট ফেস্ট কেন আমাদের সাহিত্যের কোন কাজে আসবে না

প্রতি বছর ঢাকাতে লিট ফেস্ট হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। এবার নিয়ে ১০ম আসর বসেছে। বাংলাদেশে যে কোন বিষয়ে আমরা যেহেতু সহজেই পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে তর্ক করতে বিলম্ব করি না। এই বেলাতেও তাই হয়েছে। একদল লিটফেষ্ট-এর পক্ষে যেমন দাড়িয়ে গেছে বিপক্ষেও দাড়িয়ে গেছে আরেক দল। কিন্তু এই দুই বিভক্তির বাইরে আসলেই এই লিটফেস্ট-এর খাসিলত, বৈশিষ্ট, গুরুত্ব বা সমস্যা খতিয়ে দেখা হয় নাই। সোশ্যাল মিডিয়ার উত্তেজক বিতর্কের বাইরে কোন বিষয়ে মনযোগী হওয়ার পরিসর এতোই সংকোচিত হয়ে গেছে যে, প্রায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হাজির হয় খুবই কৌতুককর ভঙ্গিতে আর গুরুত্ব পাওয়ার কোন কারণ নাই -এমন বিষয় পুরো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কোন সন্দেহ নাই এই সংষ্কৃতি ফ্যাসিবাদের জন্য খুবই সহায়ক।

একটু বাড়তি কথা বলার প্রবণতা, প্রচন্ড দেখানোপনার প্রতিযোগিতা আমাদের জাতীয় খাসিলতের অংশ আর এই স্বভাব পুরোটাই বিপুলবিক্রমে চর্চা করে লিটফেস্ট আয়োজকরা। প্রতি বছরই অনেক নামী-দামী লোকদের নামে বিজ্ঞাপন চাউর করা হয়। পরে দেখা যায় নামি লোকদের সবাই আসলে আসে নাই। এবার ওরহান পামুক আসবে বলে ডিসেম্বর থেকে মিডিয়াতে খবর প্রচার করা হয়েছে। আয়োজকদের মিডিয়া বাংলাট্রিবিউনে পামুকের বইয়ের রিভিউ প্রকাশ করেছে ডিসেম্বরে, সেখানেও অপ্রাসঙ্গিক ভাবে উনার এবার ঢাকার লিটফেস্টে হাজির হওয়ার খবর প্রচার করা হয়েছে শুরুতেই। কিন্তু তিনি এবং এমন আরও অনেকেই আসেন নাই।

কিন্তু তাঁদের নামে মিডিয়াতে রিপোর্ট হয় ঠিকই। পরে না আসার কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তাও আয়োজকরা মনে করেন না। এটা নিয়ে কোন কথাও হয় না। প্রায় প্রতি বছরই এই ঘটনা ঘটে (কোন সমস্যার কারণে কেউ একজন আয়োজনে উপস্থিত নাও থাকতে পারেন কিন্তু তার ব্যাখ্যা তো থাকবে) । এটাকে দেখানোপনার আরাম ছাড়া আর কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ এটার কোন ব্যাখ্যা যেহেতু পরে আর পাওয়া যায় না।

যাহোক প্রথমে এই আয়োজনটার বিরুদ্ধে কিছু লেখক আপত্তি তুলেছিলেন। যদিও শুরুতে এটা ফেস্ট নামে হইতো। মূলত ডেইলিস্টার ও প্রথম আলো সেইটার আয়োজনে ছিল তখন। পরে এইটা কাজী গ্রুপ নিয়ে যায় বা তাদের কাছে চলে যায়। কেন যায় আমি জানি না। জানার দরকারও নাই। আমার পয়েন্ট ভিন্ন। ফাও প্যাচালবাদ রেখে কাজের আলাপ শুরু করা যাক।

বাংলাদেশের সাহিত্য-সংষ্কৃতির জগতও অন্য অনেক কিছুর মতো নানান ভাগে/ঘরানায় বিভক্ত । কিন্তু সবভাগের মধ্যে মূলধারা বলে যেগুলো নিজেদের হাজির করতে চায় তাদের একটা কমন প্রবণতা হলো- সেইসবের গায়ে একটা বামপন্থি গন্ধ ছড়ানো থাকে। রাজনীতির কিছুই বুঝে না। কিন্তু লিখে বিপ্লব করে ফেলার একটা প্রবণতা আছে। এবং এর সাথে যুক্তহয় আধুনিকতার বিকার হিসেবে পাওয়া প্রচন্ড ইগো বা অহংকার। ফলে লেখক-সংষ্কৃতি কর্মিরা সহজেই নিজেদের জাতির ত্রাণকর্তা ভাবতে শুরু করে। নিজেকে হুদাই ক্লাসিক বা মুক্তির অগ্রমানব ভাবতে থাকে। এটাকেই আমি বলি নন-পলিটিক্যাল বামপন্থা। এরা কর্পোরেটের গোলামি করার জন্য সদা প্রস্তুত কিন্তু ভীষণরকম পুঁজিবাদ বিরোধী। যাহোক এমন আরও বহু প্রবণতা খুঁজে পাওয়া যাবে। তো এই বামউত্তেজনা থেকে শুরুতে লিটফেস্টের খুব বিরোধীতা হয়।  পরে যখন বুঝতে পারলেন তাদের আপত্তির বিষয়টা খামাখা ও হীনমন্যতা প্রসূত এবং যেসব লজিক তারা দিচ্ছিলেন তাও হাস্যকর। পরে ধীরে ধীরে এই বিরোধীতার জোয়ার থেমে গেছে। এখন যেটুকু বিরোধীতা আছে সেটা হলো- আয়োজনক গোষ্ঠীর গুড লিস্টে থাকতে না পারার ক্ষোভজনিত বিরোধীতা। আগে ওদের সাথে ঘনিষ্ট ছিল এখন ব্যাক্তিগত কারণে বা গোষ্ঠীগত গ্রুপিং এর কারণে বিরোধ দেখা দিছে ফলে বিরোধীতাও চলছে। এর বাইরে বামপয়েন্ট থেকে এখন বিরোধীতা নাই বললেই চলে।

তবে লিট ফেস্ট নিয়ে আপত্তি যারা তুলেছেন এরা নিজেরা মূলধারার পত্রিকাতে লেখার জন্য সম্পাদকের পায়ে তেল ঘষতে ঘষতে হাতের ছাল উঠায় ফেলায়, কিন্তু যখন বলে লিট ফেস্ট সাম্রাজ্যবাদি কারবার তখন পাবলিক না হেসে পারে না। মাফিয়া মিডিয়া ও সব পুঁজি একই আচরণ করে। প্রথম আলোর ছায়াতে থাকলে ভাল আর লিটফেস্ট খারাপ এমন কুযুক্তি এখন আর টিকছে না। দুইটার বাসনার মধ্যে কোন ফারাক নাই -এটা না বুঝে খামাখা আপত্তি করা লেখকরা এখন একটু লজ্জিত মনে হচ্ছে। তবে অনেকে এখন লিট ফেস্ট এ যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তার পরেও অনেকে নিজেদের ইচ্ছায় বা যোগাযোগের অদক্ষতার জন্য বা গ্রুপ মেনটেইন না করতে পারার জন্য বাদ পড়লে লিট ফেস্টের ১৪ গুষ্টি ধরে গালাগালি করেন।

তার পরেও বিরোধীতা কমার আরও একটা কারণ হলো-  ঢাকার চেতনাবাজ ও গোষ্ঠীবাদী লেখকদের হাওকাও করার জন্য বাইরে একটা জায়গা দেয়া হয়েছে। সেখানে ওরা সাহিত্যের নামে চিল্লা-ফাল্লা করেই মনে করছেন জাতে উঠে গেলাম।

এটা আয়োজকদের ভালো টেকনিক। কিছু হাড্ডি ছিটায়ে কুত্তা ঠান্ডার কৌশলের মতো বিষয়টা কাজে এসেছে। ওরা বাইরের নজরুল মঞ্চে ব্যাপক এনার্জি খরচ করে। সার্কাস হিসেবে ওদের রাখা হয়। এতেই ওরা ব্যাপক খুশি। বুক ফুলায়ে ঘুরে বেড়ায়, ‘আন্তর্জাতিক হয়ে গেলাম’ টাইপের একটা ফিল পেয়ে আপ্লুত হয়ে যায়।

আবদুলরাজাক গুরনাহ আলোচনা করছেন ঢাকা লিট ফেস্টে – মেহেদি হাসান।

 

লিট ফেস্ট আসলে কতটা কাজের:

একটা দেশে লিস্টফেষ্টর মতো এমন আয়োজনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আছে। বাংলাদেশে এমন আয়োজন খুবই দরকার। কারণ, এতে ঢাকার যেসব কবি সাহিত্যিকরা এখনও “কলকাতা সিনড্রমে”( দাদাদের দাশে পরিণত হতে মুখিয়ে থাকে জাতে উঠার জন্য) আক্রান্ত তারা দ্রুত সিন আউট হয়ে যাবেন। কলকাতার কালচারাল উপনিবেশের চেয়ে ইংরেজি ভাষা-ভাষী বিরাট দুনিয়ার প্রভাব বরং বেশি কাজের হবে। যদিও এখন আর সেই দিন নাই। ইংরেজি ভাষা নিজেই একটা ডিসেন্ট্রালাইজেশন (বিকেন্দ্রীকরণ) প্রকৃয়ার ভিতর আছে অনেক দিন থেকেই । কাজেই দাদাদের দাদাগিরির চেয়ে বাইরের দুনিয়ার সাথে যত আনাগোনা বাড়বে ততই এই ফ্যাসিস্ট সংষ্কৃতি চর্চার মঞ্চ দুর্বল হবে। তাই হওয়ার কথা। এই অবস্থান থেকে অল্পকিছু লোক লিট ফেস্টের পক্ষেও না, বিপক্ষেও না। তারা যায়, ঘোরে, কথাশুনে। বইপত্র দেখেন।

অন্যদিকে যারা শাহবাগে ঘুরেই, মহল্লার রাস্তায় আড্ডা মেরেই, যৌন বিকারের কিছু ফিরিস্তি লিখেই নিজেকে বিশাল সহিত্য প্রতিভা মনে করেন তারাও দেখতে পাবেন দুনিয়া আরও বড়। দুনিয়ার সাহিত্যের বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ যে প্রায় শূন্য তাও বুঝতে পারবেন। কাজেই নিজেদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার বিষয়ে আলগা অহংকারের যে দুই পয়সাও দাম নাই এটা পরিস্কার হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

আর যারা মনে করেন ইংরেজি তো সাম্রাজ্যবাদি ভাষা তারা বোকার স্বর্গে আছেন। এরা আসলে কোন ভাষাই ভাল পারেন না। আপনি সাহিত্য যে ভাষাতেই করেন, “সাহিত্যের” শর্ত পূরণ করতে পারলে, সাহিত্যের “সত্য” বা হক আপনার কাজে হাজির হলে তা দুনিয়ার সম্পদে পরিণত হতে এখন আর সময় লাগে না। দুনিয়ার অনেক বেস্টসেলার গ্রেট রাইটার ইংরেজিতে লিখেন না, কিন্তু ইংরেজি ভাষাসহ সব প্রধান ভাষাতেই হাজির থাকেন। যেমন, মুরাকামি, কুন্দেরা। ভারতীয় বাঙালী বংশে জন্ম নেয়া ঝুম্পা লাহিড়ি তো ইংরেজি ছেড়ে ইতালীয় ভাষায় লিখছেন। তিনি এই ভাষা শিখেছেন মাঝ বয়সে। এবং এই ভাষায় লিখছেন। সেখান থেকে অনুবাদ হচ্ছে। সাহিত্যের বা চিন্তার বিস্তার করার জন্য ভাষা এখন আর সমস্যা না।

চিন্তার প্রভাব/গুরুত্ব না থাকলে কোন ভাষাতেই কাজ হবে না। আর নিজে ক্যাপাবল না হলে ভাষা আপনাকে হেল্প করবে না। আপনি হিব্রু ভাষাতে লিখেন তাতেও সমস্যা নাই। রাতারাতি অনুবাদ হবে। ইংরেজিতে লিখেন না কিন্তু ইংরেজি ভাষাভাষী এলাকায় প্রভাবশালী এমন লেখক এখন অনেক। কাজেই খামাখা ভিন্ন ভাষাকে ঘৃণা আর বাংলা বর্ণমালা পূজা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে না -এটা মনে রাখতে হবে। আর একাধিক ভাষা শিখতে পারা সব সময়ই কাজের। এটাকে খুবই গুরুত্ব দেয়া দরকার। তবে ভাষার সাথে, সংস্কৃতির সাথে কলোনিয়াল আচরণ ও রুচি রপ্ত করার চেষ্টা করা গভীর অসুখ। এটা হীনমন্যতা। আশা করি এটা নিয়ে ডিটেল বলার দরকার নাই। যেমন এই লিট ফেস্টের আয়োজকদের অনেকেই ইংরেজিতে লিখেন। নামি প্রকাশনা থেকে বই ছাপা হয়। কিন্তু দুনিয়ার সাহিত্যে এগুলার প্রভাব প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কাজেই ভাষার তর্কটা যারা সামনে আনেন তাদের বুঝতে হবে ইংরেজি একটা ভাষা মাত্র। জাতে উঠার সিঁড়ি না।

যে কোন ভাষা ও সংষ্কৃতির হেজিমনির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। এটাও মনে রাখা দরকার। কোন কিছু পূজারীর মানসিকতা নিয়ে দেখার দরকার নাই। দেখতে হবে ক্রিটিক্যালি। ক্রিটিক একটি ইমানেন্ট মানে চলমান প্রসেস মানে ক্রমাগত ভাবে নতুন নতুন পথ তৈরি হয় ক্রিটিক করার ক্ষমতা তৈরি হলে।

তো ভাষা নিয়ে এইসব ফালতু যুক্তির কোন মানে হয় না। আর ইংরেজি তো মিনিমাম অর্থে পারাও উচিত, আমাদের শিক্ষা জিবনে বাধ্যতামূল ভাবে অনেক বছর এটা পড়তে হয়। যেটা বলছিলাম, লিট ফেস্টে আরেকটা ভাল জিনিস হয় তা হল, দুনিয়ার অনেক নতুন রাইটারের বই পাওয়া যায়। হুম, অনেক দাম। তো দাম কোন ব্যাপার না। সাহিত্য মাগনা হয় না। সময়, মেধা, সাথে টাকা, এর সবই লাগে। আপনি যদি মনে করেন কোন রাইটারের বই আপনাকে পড়তে হবে (নিজেকে গড়ে তুলতে হলে) তাইলে রিকশা চালায়া হলেও বই কিনবেন। ভাতের টাকা বাঁচায়া বই কেনা অনেক পাবলিক আমি নিজেই দেখছি। আমি মূলত যাই বই কিনতে। সারা বছরে আমার আয়ের সিংহ ভাগই বই কেনার জন্য রাখি। সেই জন্য গত ৪/৫ বছর ধরে বই কেনাতে আমার কোন অভাব হচ্ছে না।

অন্যদের খবর জানি না। তবে অনেক নতুন বই লিট ফেস্ট উপলক্ষে ঢাকাতে আসে এটা খুবই ভাল দিক। অবশ্য এখন পিডিএফ এতো সহজ হয়ে গেছে যে ঘরে বসেই আপনি সেগুলা পড়তে পারেন।

 

মধ্যমেধাসর্বস্ব এমন অনুষ্ঠান কেন সাহিত্যের উন্নতিতে কোন কাজে লাগবে না:

কিছু ভাল দিক থাকার পরেও আমাদের সাহিত্যের জন্য লিট ফেস্ট কোন কাজে আসবে না। এতো বছরেও (একদশক) এই অনুষ্ঠানের ফলে আমাদের সাহিত্যে কোন পরির্বতন লক্ষ করা যায় নি। আশা করা যায় সামনেও যাবে না। কেন? খুলে বলি…

এক.

যারা আয়োজন করেন তারা এই বিষয়টার জন্য, মানে সাহিত্যের জন্য খুব যোগ্য লোক বলে মনে হয় না। সাহিত্যের জন্য যেটা দরকার সেটা হলো মেধা। মানে সাহিত্য এক কথায় ওয়ার্ক অব জিনিয়াস। এখন আপনি মেধাবী কি না তা বুঝতে না পেরে যে কাজের যোগ্য না তাও করতে শরু করলে তো কিছু বলার নাই। এটা বুঝতে পারার জন্য একটা সততা লাগে। আপনি অন্যের উপর নির্ভর করলে ভুল হতে পারে। আপনি কোন বিষয়ে প্রতিভা রাখেন কি না তা আপনার ব্যাসিক ইনিসট্রিঙ্কট বা স্বহজাত প্রবণতা দেখে বুঝতে পারবেন। পরে সেটা চর্চা, সাধনা, পরিশ্রম ইত্যাদির সহযোগে বিকশিত হতে পারে। কিন্তু সহজাত প্রবণতার বাইরে শখে, জাতে উঠতে, অমর হতে বা অন্য কারণে আপনি করতে পারেন। সেটাতে ভাল সাহিত্যও হয়ে যেতে পারে কিন্তু তাতে পারফর্মেন্স থাকলেও প্রতিভার বিষ্ময় থাকে না। এই দিকটা বাংলাদেশে যারা লেখা-লেখি করেন তাদের বেশির ভাগই বুঝতে পারেন না। তাই প্রচুর লেখক কিন্তু সাহিত্যের দুনিয়ায় এদের কোন প্রভাব ও সম্মান নাই।

তেমনি লিটফেষ্টের এরাও কিছু টাকা বানাইছেন। দেশের কিছু বিরাট প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাদের দখলে আছে। নিজেদের টাকা দিয়ে, মিডিয়া করার পাশা-পাশি, বিদেশে অনেক যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন এবং দেশের কিছু পোষ্য লেখক-কবি আছে তাদের হাতে। যারা খুবই অশিক্ষিত ও গোয়াড় টাইপের নেইম/ফেইম পাইতে কাঙ্গাল। তাদের সহযোগিতায় বিদেশী নামি-দামি লেখকদেরকে এনে নিজেদের “এলিটিজম” প্রদর্শন করার জন্য এরা কয়েকটা দিন খুব পরিশ্রম করেন। এরা জানে না, যিনি জ্ঞানগত ভাবে “এলিট” না তার যতই টাকা থাক একজন পিওর থিংকার তাদের লাফালাফিকে অবুঝ রাম ছাগলের উল্লাসের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবে না। দেয়ার কোন কারণ নাই। আমাদের অনেকেই সেটা দেয়া না।

“একটা জাতির অধঃপতনের কোন রহস্য নাই। এটা শুরু হয় তার লেখকদের অধঃপতনের মধ্য দিয়ে।”

-বেন ওকরি

যারা হীনমন্য তারাই ভড়কে যায় এই সব জাকজমক দেখে। এরা যে সব গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের নিয়ে আসেন তাদের কে খাঁচায় বন্দি করে রেখে পাবলিককে দেখায়। অনেকটা চিড়িয়াখানায় খাঁচার ভেতর যেমন চিড়িয়া থাকে এরাও সম্মানিত অতিথিদের তেমন ভাবেই রাখেন।

ঢাকার কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের সাথে তাদের কোন ইন্টারেকশনের সুযোগ দেয়া হয় না। বিদেশীদের সাথে সেশনগুলো পরিচালনায় থাকে বেশির ভাগই বাইরের লোকজন। এর একটা কারণ হতে পারে ঢাকার লেখকদের আসলেই সেই যোগ্যতা নাই। আয়োজকদের ডাকে হাজির হওয়া দেশীয় মধ্যমেধাসর্বস্ব বা পুরাই পারর্ফমার লেখকরা এই আয়োজনে পাল ধরে এক সাথে থাকা ও শব্দদূষণ ছাড়া আর কোন কাজে লাগে না। যত বড় লেখকই হোক, নোবেল, বুকার কুকার যাই জিতে আসুক না কেন, যেই ভাষাতেই কাজ করুন না কেন একজন বিদেশী লেখককে ঢাকার লেখকরা কলিগ ভাবগে পারেন না। তাদের সেলিব্রেটি মনে করেন। এটা তাদের সমস্যা। আসলে তো তারা কলিগ। এটা ভাবতে না পারার কারণে এখানে পেশাদার অর্থেও কাজের লেখক গড়ে উঠে নাই।

অমিতাভ ঘোষ, বা আবদুল রাজ্জাক গুরনাহ এর সাথে কথা বলার মতো ঢাকার সাহিত্যিকদের চিন্তার হাইট নাই- এটাই ধরে নিতে হবে। ভাষা কোন সমস্যা না। তারা আগ্রহী হলে আয়োজকরা দোভাষি রাখতে পারেন। অনেক বিখ্যাত লেখক দোভাষির মাধ্যমে সেমিনারে কথা বলেন। এটা কোন সমস্যা না। ঢাকার কবি-সাহিত্যরা যদিও আয়োজনকের গুডবুক থেকেই লিট ফেস্টে জায়গা পান তারপরেও এরাই যেহেতু এই দেশের লেখক ফলে তাদের এতোদিনেও কেন লজ্জা হয় না যে, এখানে তাদের আলাদা করে সেশন দেয়া হয়। বিদেশী লেখকদের সাথে তাদের এক মঞ্চে বসার আয়োজন থাকে না। এই বিভাজন নিয়ে কোন কথা বলতে শুনি নাই। ফলে এটা তাদের যোগ্যতার বাইরের বিষয় হিসেবে এরা মেনে নিছে এতো দিনে -এটা বলাই যায়। না হলে ১০ বছরে এই পদ্ধতীর পরির্বতন কেন হবে না?

নিজেদের মালিকানা ও পছন্দের মিডিয়ার লোকজনদের ছাড়া অন্য মত ও চিন্তার মিডিয়ার সাংবাদিকদের কোন সুযোগ নাই বিদেশী লেখকদের সাথে কথা বলার।  এই কয়দিন তারা নিজেদের মিডিয়ায় প্রাণ উজাড় করে খবর ছাপায়। এর বাইরে অন্যরা বা গোষ্ঠির বাইরের লেখকদের এবং মিডিয়া কর্মিদের ইন্টারেকশনের কোন সুযোগ এখানে থাকে না। অথচ আগতদের অনেকের সাথে কথা বলে বা যাদের চিনি তাদের মূল আগ্রহ থাকে ভিন্ন চিন্তার এবং ক্রিটিক্যালি এঙ্গেজ হতে পারে এমন মানুষদের সাথে সংযোগ তৈরির। এটাই তো একজন লেখক ও চিন্তককে হেল্প করে। অনুষ্ঠানকে গুরুত্ববহ করে তুলে। কিন্তু নানান কাহিনী তৈরি করে এরা একটা বলয় তৈরি করে রাখেন। ভিন্ন চিন্তার লোকদের এখানে কোন জায়গা নাই। কেউ কেউ নিজের মতো চেষ্টা করলে এরা আসলে দেখাতে চায় এতো সহজ না, এতো বড় রাইটারকে আনা। কাজেই এটাকে তো নিজের হাতে রাখতে হবে। মানে কিছু ইতর লোক যেমন, গরিবের সামনে মুরগার রান চিবায়ে মজা পায়, গরীবদেরকে নিজের চাক-চিক্য দেখাতে আরাম পায় ঢাকা লিট ফেস্টে এই একই ফকিন্নিপনার ব্যাপক হাজিরা আছে। ফলে এইভাবে ৫০ হাজার বছর ধরেও আয়োজন চলতে থাকলে আমাদের সাহিত্য পরিমন্ডলে তার কোন প্রভাব পড়বে না। বরং হীনমন্যতা বসত কিছু লোক ওদের দলে ভিড়ে যাবে। কিছু লোক খামাখা বিরোধিতাও করবে।

কিন্তু ইন্টারেকশনের সুযোগটা এই গোষ্ঠিবদ্ধতা এবং ওদের গন্ডির বাইরে না আসলে এর কোন সুফল ঢাকার সাহিত্য পাবে না। সাহিত্য কোন দিন শুধু দলবাজি করে হয় না। যারা আয়োজন করেন এবং অনেক মহান লেখককে নিয়ে আসেন কিন্তু তার সম্পর্কে ভাল করে জানেনই না।

ফলে খুব হতাশাজন সেশন হতে দেখেছি। অথচ ঐসব লেখকদের শতশত দরকারী লেকচার ইউটিউবে আছে। সেইদিক থেকে ঢাকার এলিটদের দেখছি করুণ অবস্থা। এদের টাকা থাকলেও চিন্তা করার ক্ষমতা ও পড়াশোনার দিক থেকে খুবই পিছিয়ে আছেন। ফটফট করে ইংরেজি বলে দেখে ঢাকার অনেক কবি-সাহিত্যিক হয়তো ওদের দেখলে ঘাবড়ে যাবেন কিন্তু যেসব সাহিত্য তারা সৃষ্টি করেন (একজন/দুইজন ব্যতিক্রমবাদে) তা দুনিয়ার সাহিত্য বাজারে কোন পাত্তাই পায় না। বাংলায় যারা লিখেন তাদের ইংরেজি অনুবাদ হওয়ার পরেও চলে না। কারণ এরা খুবই গড়পড়তা লেখক। এই সব ১৯ শতকী আইডিয়ার গল্প এখনকার দুনিয়ায় অচল। অথচ এরাই বাংলা সাহিত্যের তারকা রাইটার। ইংরেজিতে লিখলেও এদের সাহিত্যের কোন কদর হইত না। কাজেই ইংরেজিতে লিখলেই যে সে মহাপন্ডিত আর আপনি কিছুই না এটা মনে করার কোন কারণ নাই। ঢাকার এলিটরা বেশির ভাগই হাইব্রিড এলিট। এদের কোন জ্ঞানতাত্বিক বা সাহিত্যিক সম্মৃদ্ধির সংগ্রাম নাই। এরা খুব কমই পড়াশোনা করেন। একটা উদাহরণ দেই,

২০১৭ সালে এই লেখাটা প্রথম শুরু করেছিলাম। সেই বছর বেন ওকরি এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে। বেন ওকরি গ্রেট রাইটার। ৯১ সালে বুকার পাইছেন। ঢাকাতে উনার বই পত্র কিছু দিন হল আসতে শুরু করেছে। তো একটা অনুষ্ঠানে দেখা গেল উনার যেই বইটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটা কোন অডিয়েন্সই পড়ে নাই। সঞ্চালক কয়েকবার জিগাইলেন কে কে পড়ছেন একটু সাড়া দেন। হলটা ভরা ছিল। কেউ সাড়া দিলো না। অথচ এই অডিয়েন্সকে ঢাকার এলিট বলা যায়।

কিন্তু আয়োজকরা দেখলাম এমন একজন রাইটারকে ঠিক মতো ট্রিটই করতে পারছেন না। এটা তাদের দোষ না। দোষটা তাদের চিন্তার। বেন ওকরি ফাংশন করেন পোষ্টকলোনিয়াল ও পোষ্টমর্ডান চিন্তার জগতে। আর এরা এখনও তথাকথিত সেকুলারিজম, প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও কলোনিয়াল প্রতিষ্ঠান ও অবৈধ ক্ষমতাধর প্রভুর পায়ে চুমা খাইতে ব্যাস্ত।

বেন ওকরি তার,”এ টাইম ফর নিউ ড্রিমস” বইয়ে লিখেছেন-

“একটা জাতির অধঃপতনের কোন রহস্য নাই। এটা শুরু হয় তার লেখকদের অধঃপতনের মধ্য দিয়ে।” (পৃষ্ঠা-১৫)

বাংলাদেশ এর জলন্ত সাক্ষী। স্মরণ করুন শাহবাগে তাদের উল্লম্ফন ও এখনকার রাজনৈতিক কৌতুকে শামিল হওয়ার প্রতিযোগিতা। তো এইসব শাহবাগের পরাজিত শক্তি ও অধঃপতিত লেখকরা কি ভাবে তাকে বা তার মতো মহান লেখক/চিন্তকদের ডিল করবেন?

এমন অনেক মহান লেখদের সাথে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের কোন ইন্টারেকশনই হল না। হোটেল থেকে অনুষ্ঠানে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছেন আবার অনুষ্ঠান শেষে হোটেলে নিয়ে ঘুম পাড়ায়ে রাখছেন।

ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের বিজি রাখা হয়েছে তাদের গ্রুপবাজিতে। আর সাথে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে কলকাতার কিছু দাদাদেরও এদের সাথে। দেশি লেখকদের দৌড়ও দেখলাম কলকাতা পন্তই। অন্য লেখকদের নিয়ে সেলফি তোলার বাইরে কোন আগ্রহ দেখলাম না। যে যত গ্রেটই হোক। ওরা বিজি ওদের লবিং নিয়ে। যে ওর প্রসংশা করে তার কাছে যাবে। সেও তার প্রসংশা করবে। এভাবে ওরা গ্রেট লেখক হবে?

তারমানে আগে যেটা কইলাম, ওদের পোষ্য অশিক্ষিত লেখকরা এমন গ্রেট রাইটাদের সাথে একটা আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করারও যোগ্যতা রাখে না। ফলে এমন অনেক গ্রেট লেখককে ঢাকাতে পেয়েও কোন কাজের কাজ হচ্ছে না। ফলে ঐসব লেখকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দরকারী টক সোশ্যাল মিডিয়াতে পাওয়া গেলেও ঢাকা লিটফেস্টের কোন টক পাওয়া যায় না। আয়োজকরা কেন সোশ্যাল মিডিয়াতে দেন না জানি না। তাইলে যারা অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারে নাই তারাও শুনতে পারতেন। এখানে কোন লেখক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলে সেটা বিশ্ব মিডিয়াতেও আসতো। তখন ঢাকার সাহিত্য নিয়ে একটা আগ্রহ অন্যদেশে তৈরি হওয়ার সুযোগ হইতো। কিন্তু এগুলা কিছুই হয় নাই ১০ বছরে।

২০১৭ সালেই কবি আদোনিসকে দেখলাম ঢাকা ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাপক সেল্ফি তুলছেন লোকজন। ওখানে কোন সাহিত্যবোদ্ধা বসেন আমি জানি না? কবির তো কবিদের সাথে, পাঠকদের সাথে সময় কাটাবার কথা। ক্লাবের মাতলামি/মাতামাতিতে কি কাজ?

আয়োজকদের নিজেদের প্রমোশনের জন্য এমন অনুষ্ঠান হলে ঠিক আছে। এটা নিয়ে কোন কথা নাই। তারা বিদেশি নামি-দামি লেখক আনবে। নিজেরা কত দূর পারেন তা অশিক্ষিত ও গরিব কবি-সাহিত্যিকদের দেখাবেন। বেশ।

দুই.

এবার আসল কথাটা বলেই লেখা শেষ করি। এবার দেখি এদের রাজনৈতিক অবস্থান কেমন। যারা লিটফেষ্টের আয়োজক এবং ভোক্তা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? এরা যে দলই করুন না কেন, মোটাদাগে চেতনার লোক, প্রগতীর লোক, এনজিওবাজি প্রসূত মানবতাবাদি লোক, নারী স্বাধীনতাবাদি লোক, অসাম্প্রদায়িক লোক সব মিলে এক কথায় এরা জয় বাংলার লোক। এদের পোষ্য ফকিন্নি দেশী লেখকরাও এই ধারার সৈনিক। ঢাকা লিট ফেস্ট প্রচুর চেতনায় ভরা। বাঙালি জাতীয়তাবাদি চেতনাকে ইতিহাসের অমোঘ সত্য ধরে নিয়ে সাহিত্য করার পরিনাম ভোগ করছে বাংলাদেশ। এটার বড় ব্যাখ্যা না করে সহজে ও যতটা সংক্ষেপে পারা যায় বিষয়টা বলতে চেষ্টা করি।

একবালতি দুধে একফোটা গোমূত্রের মতো হলো এই বাঙালি জাতীয়তাবাদি চেতনা। মোটাদাগে বাংলাদেশের লেখকরা জানে না যে-

“যে ধারণাগুলো এক কালে মুক্তির প্রতীক ছিল, সেগুলিই পরবর্তী যুগে হিংসা ও শোষণের পথ খুলে দেয়। ভাবতে হবে কীভাবে কখন তুমি অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারকে ন্যায্যতা দিচ্ছ।”

-আশিস নন্দী।

বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকরা মোটাদাগে ঐতিহাসিক ব্ল্যাকমেইলের ফাড়া কাটায়ে উঠতে পারে নাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গুম, ভোট ডাকাতি সব এরা মেনে নিছে। এরা চিন্তায় এখনও ৭১ সালেই পড়ে আছে। ৭১ এ সে ভালো ভূমিকা রাখছে এরপরে সে মহা গুন্ডা হলেও তার সাথেই থাকতে হবে-এমন মানসিকতার আলোকিত লোকরাই কিন্তু অন্যদের মৌলবাদি তকমা দিচ্ছে।

এই দেশের সাহিত্যের উপর চেতনার গজব সেই যে পাকিস্তান আমলে জারি হয়েছে এখনও চলছে। সবকিছুতেই একটা রাজনৈকি দলের বয়ানের ভেতর নিজেদের প্রবেশ করায়ে ফেলেন। তার পরেও তাদের এই অবস্থান নিয়ে সমালোচনা উঠলে বলে বিকল্প তো নাই। এইভাবে এখানকার লেখক-সাহিত্যিকরা মোটাদাগে ফ্যাসিবাদের শরিকে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সংকট হলো আপনি যাই করেন না কেন আপনার সবকিছু করতে হবে মুজিব কোর্টের ছায়ার ভেতরে থেকে। এখন একই সাথে মুজিববাদি ও সত্যিকারের শিল্প-সাহিত্য সম্ভব না। আপনি আওয়ামী লীগার ও গ্রেট রাইটার এক সাথে হতে পারবেন না। দল করা অপরাধ না। কিন্তু আপনি যেই জিনিসকে আইডিয়াল ধরে আগাবেন তার ট্রু এসেন্স থাকতে হবে। ফলে লীগ করা অপরাধ না। অপরাধ হলো ফলস/মিথ্যা জিনিসকে এসেন্সিয়াল করা, আইডিয়ালাইজ করা, গ্লোরিফাই করা। এগুলা অনেকবার লিখেছি। তাই এখন আর বিস্তারিত রিপিট করছি না। কেন সম্ভব না এটা বলেই শেষ করবো।

“যে ধারণাগুলো এক কালে মুক্তির প্রতীক ছিল, সেগুলিই পরবর্তী যুগে হিংসা ও শোষণের পথ খুলে দেয়। ভাবতে হবে কীভাবে কখন তুমি অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারকে ন্যায্যতা দিচ্ছ।”

-আশিস নন্দী।

যে লেখক এই দলের সবকিছুকে ঐতিহাসিক ‘সত্য’ ধরে নিয়ে নিজের চিন্তা ও কল্পনার প্রকল্প ঠিক করেন সূক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যাবে এইসবের মধ্যে কোন ট্রুথ নাই। যা আছে সত্যের অভিনয় বা সত্য ক্লেইম করার রাজনীতি। মিথ্যার সত্যিকারের রুপায়নের প্রকল্প। এবার এই প্রকল্পের উপর কোন মহান চিন্তা ও সাহিত্য হবে না। ফলে মিডিওকারগুলোই এই দেশে জিনিয়াস হিসেবে হাজির হয়। আপনারা দেখেছেন, আনিসুল হক, জাফর ইকবার, সৈয়দ হক এমন বহু তারকা টাইপের লোকদের খুব দ্রুতই এই ফ্যাসিবাদের দোস্ততে পরিণত হতে। এরাই লিট ফেস্টের দেশীও তারকা লেখক। তবে এই ফ্যাসিবাদ আপনাদের এমন হিরোদের ক্লউনে পরিণত করে ছেড়েছে। এই প্রবণতার বাইরে লিটফেস্টও যাইতে পারে নাই। চেতনার জোয়াল কাঁধে নিয়ে কিছু করা সম্ভব না। ফ্যাসিবাদের ফ্যান বয় যদি চিন্তার স্বাধীনতা, লেখককের মতপ্রকাশের অধিকার ইত্যাদি জরুরী বিষয় নিয়ে দুনিয়ার সব নোবেল জয়ীদের নিয়েও অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, হোমার, পুশকিন, টলস্টয় টাইপের মহানদের হাজির করলেও তাতে অবস্থার কোন উন্নতি হবে না।

আরেকটা ধাপ্পাবাজির কথাও বলতে হয়। বিদেশী অতিথিরা হয়তো এই ঝমকালো আয়োজন দেখে মনে করছেন, এটাই গোটা দেশের বা জাতীর সাহিত্য মনষ্কতার চিহ্ন বহন করে। বাইরে থেকে তো এটা বুঝতে পারার সুযোগ নাই এখানে এই জাতীর একটা বিশেষ অংশ মাত্র হাজির। এবার তো টিকেটের সিসেটেম চালু করে আম-পাবলিকদের যাওয়ার পথটা একটু কঠিন করে দিছে। তাবে তাতে সমস্যা হয় নাই, যাদের পা বাংলাদেশে থাকলেও মাথা এবং হাত বিদেশে এমন লোকজন দেশে এখন প্রচুর, এরা গেছে।

এখনও যারা শ্রেণীর তর্ক তুলে সাহিত্য আলোচনা করেন তাদের মূর্খতা নিয়ে কথা বলার কোন মানে হয় না। সাহিত্য কোন শ্রেণী চর্চার মিটারের নিরিখে হয় না। যেহেতু ঢাকার সব কিছু অরাজনৈতিক বামপন্থা বা সাংষ্কৃতিক বামপন্থার গ্রাসে আক্রন্ত ফলে সব কিছুতেই শ্রেণীর তর্ক হাজির হয়। এই গুগল আমলে কালচারাল মবিলাইজেশন ক্লাসিক শ্রেণীর সব হিসাব উল্টা-পাল্টা করে দিছে। লম্বা আলাপে না গিয়ে শুধু বলি, দুনিয়ার সব সমাজেই সাহিত্য সব শ্রেণী থেকে আগত লোকই করে। গরীব লেখকও আছে ধনি লেখকও আছে। সেইসব সাহিত্যকে বিচারের পদ্ধতী শ্রেণী না। খোদ সাহিত্যের নিরিখেই সেগুলোকে দেখতে হয়। সেই লেখক, পান্তাভাত খায় না বার্গার খায়, সে খাটে ঘুমায় না গাছ তলায় ঘুমায় এটা জরুরী না। ফলে আমি শ্রেণীর এই কুতর্ক করে সময় নষ্টের পক্ষে না। সমস্যা হলো, বিদেশীরা মনে করতেছে লিটফেস্টে হাজির দর্শকই বাংলাদেশের সাহিত্যের দর্শক। এবং চিন্তাশূণ্য একপাল বিপুল মানুষ সেখানে হাজির হয়ে তাদের যে বার্তা দিচ্ছে তাতে তারাও প্রতারিত হচ্ছেন। ওরা বাংলাদেশকে প্রেজেন্ট করে না। ওরাও বাংলাদেশের অংশ কিন্তু দেশীয় সাহিত্যের প্রতিনিধত্ব করে না, বিদেশী সাহিত্য হয়তো ভালই পড়েন। পোষ্যদেশী লেখকরা তো চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে। আয়োজক যারা তারও ফ্যাসিবাদের শরিক। কাজেই দুই অংশ মিলে যে বাংলাদেশকে বিদেশীরদের কাছে তুলে ধরে তার অবস্থা চেতনা জর্জরিত, ফ্যাসিবাদ মুখরিত এই স্বপ্নহীন জাহেলিয়াত নিয়ে গর্বিত ভূমি। বিদেশীদের সবাই যে চেতনাময় গর্বে গর্বিত এমন না। জিয়া হায়দার রহমানের মতো ক্রিটিক্যাল লেখকও এখানে এসেছিলেন। যিনি এই দেশকে,’ল্যান্ড অব ডেড আইডয়াস’ বলেছিলেন। খুবই যথার্থ। কিন্তু এটা নিয়ে চেতনাবাজদের খুব মন খারাপ হয়েছিল তখন। যাহোক রাজনৈতিক ভাবে ফ্যাসিবাদের গোলাম হওয়ার কারণে এই অনুষ্ঠান একটি স্বৈরশাসন কায়েমকারী দলের গুনগান প্রচারের সহায়ক ভূমিকা রাখলেও সাহিত্যের কোন উপকারে আসে নাই। আসবে না।

অনুষ্ঠানে বিপুল তরুণদের (বেশির ভাগই ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া) দেখে বাইরে থেকে আশাবাদি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এরা যে গোটা জাতী থেকে চরম ভাবে বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, চিন্তাশক্তির দিক থেকে দরিদ্র তা বাইরের অতিথিদের বুঝবার সুযোগ নাই। ফলে বাইরের যারা এই আয়োজনে আসছেন, এই আয়োজন দেখে আশাবাদি হচ্ছেন দেশের লোকদের রচিত সাহিত্য (যেগুলা অনুবাদ হইছে) পড়তে গেলে মাথা ঘুরে যাবে। হিসেব উল্টে যাবে। আপনি যা না তা শো করার প্রবণতা সব দিক থেকেই বিদজ্জনক।

এই আয়োজনের সবকিছু ঠিক থাকলেও মূল জিনিস ঠিক নাই। রাজনৈতিক ভাবে এরা ফ্যাসিবাদি সংষ্কৃতির দোসর। যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন। এরা চিন্তার দিক বাঙালি জাতীয়তাবাদিম বাবু সংষ্কৃতির আদলে তৈরি এই ফ্যাসিবাদি ঐতিহ্য বহন করে। চরম ফ্যানাটিক প্রবণতা পদে পদে লক্ষ্য করা যায়। ফলে তারা আয়োজন করতেছে করুন। কিন্তু এই দাবিটা মনে হয় করা অন্যায় যে, তারা সাহিত্যের আগ্রগতিতে, উন্নতিতে ভূমিকা রাখছেন। অবশ্য মিথ্যা বলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য রাক্ষার ধারাবাহিকতায় এটা তারা বলতেই পারেন। কিন্তু দশ বছরে বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে এদের অবদান তো আমরা দেখলাম। কাজেই আসল কথা হলো- এমন আয়োজন হাজার বছর ধরে চালু থাকলেও এইটার কোন কিছুই আমাদের সাহিত্যের জন্য কোন কাজে আসবে না -এটা এতোদিনে পরিস্কার।

একটা রাষ্ট্র হিসেবে এমন আয়োজন আমাদের জন্য সত্যিই কাজের হবে যখন আমরা রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হতে পারবো। তা না হতে পারলে এই আয়োজন স্বৈরতন্ত্রকে সহযোগিতাই করে যাবে। এবং এমন আয়োজন একাধিক প্রাইভেট কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেয়ার কোন মানে হয় না। কোম্পনিগুলো সম্পন্সর করবে কিন্তু আয়োজন হতে হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রী প্রতিষ্ঠান বা কমিটির দ্বারা। যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবে ভিন্ন মতের, বিরুদ্ধ মতের লেখক-চিন্তকদের। তাদের হাতে পায়ে ধরে হলেও হাজির করবে। কেন না এইসব অনুষ্ঠানের গুরুত্ব মূলধারার কেরানি লেখকরা তৈরি করেন না, তৈরি করেন বিরুদ্ধ চিন্তার লেখকরা। এবং কোন কর্মসূচি প্রনয়ণ বা এইটার জন্য কোন সংকল বা অঙ্গিকার ঘোষণা ছাড়াই অনুষ্ঠান শেষ করে পরের বছর আবার হাওকাও শুরুর জন্য অপেক্ষা করা হয়। এতো খাপছাড়া কোন অনুষ্ঠান করা কাজের কাজ না। তবে অবশ্যই  এটার জন্য দরকার রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন অবস্থা। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, স্বাধীন নাগরিক।

সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।

মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
Paypal https://paypal.me/jobanmedia

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নাম *