ইমরান খানের অপরাধ একটু চীনের দিকে তিনি ঝুঁকে পড়ছিলেন।সেনাবাহিনীর প্রধান যাকে আইএসআই এর প্রধান হিসাবে নিয়োগ দিতে চাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ না করে কাজটা করায় মিস্টার খান বিষয়টাকে অপমান হিসাবে নিয়ে ছিলেন।মিস্টার খান পাকিস্তানের ‘ডিপ স্ট্যাইট’কে চ্যালেঞ্জ করে বসছিলেন। আফগানিস্তানে মার্কিন নীতির কিছুটা সমালোচক হয়ে উঠে ছিলেন। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রকৃয়ার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনায় বসার জন্য বিশ্ব জনমতকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করতে খানের ভূমিকা আমেরিকা ভুলে যাবে-এটা মনে করার কারণ নাই। সব মিলে খানকে যে কোন মূল্যে আটকানোর মার্কিন প্রচেষ্টা সফল হতে সময় লাগে নাই। যখন দেশের সংবিধানের মধ্যেই খান হটানোর তরিকা মজুদ, ইমরান খান আর যায় কোথায়? তাঁকে হঠাও। ফলে ইমরান খানকে বিদায় নিতে হলো। একটা অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যূত করার প্রক্রিয়ায় জনগণের নুন্যতম কোনো অংশ গ্রহণ নেই! আধুনিক গণতন্ত্রে জনগণকেই রাষ্ট্রের সকল শক্তির উৎস মনে করা হয় কিন্তু পাকিস্তানের ইমরান খানের সাম্প্রতিক অপসারণ প্রকৃয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। শুধু সেনাবাহিনী এবং আমেরিকার সাথে বনিবনা না হওয়ায় ইমরান খানকে পাকিস্তানের ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে- এটা এখন অতি সাধরণ বুঝের জনতাও বুঝতে শুরু করেছেন। মিস্টার খান চীনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বসায় পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টি ও ক্ষমতা পেতে মরিয়া এমন স্টেইক হোন্ডাররা অটোমেটিকালি মার্কিন ( কূটকৌশল) ব্লেসিংসটা হাত ছাড়া করেনি।
ফলে এক সময়ের অন্যতম দুই বিরোধী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের একটি জোট সরকার গঠন করাও সম্ভব হলো! নওয়াজ শরীফের ভাই প্রধানমন্ত্রী আর বেনজির ভুট্টোর ছেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী! অথচ এই দুই পক্ষের মিলন অসম্ভব ব্যাপারই ছিল। আসলেই রাজনীতিতে শেষ এবং অসম্ভব বলে কিছু নাই! ফলে ভোট ছাড়া, জনগণের মেন্ডেট ছাড়া পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পতন হয়ে গেল! যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক হিসেবের নিরিখে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাই বটে।
এখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাষ্ট্রের উপহার জমা না দিয়ে নিজে নিয়ে নেওয়ার অপরাধের একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি চলছে। ইমরান খানের দল যাকে উদ্দেশ্য প্রনোদিত সম্পূর্ণ বানোয়াট মামলা বলছে। পাকিস্তানের রাজনীতির বর্তমান যে বাস্তবতা সেটা হচ্ছে যেকোনো সময় সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই আবারও ইমরান খানের তেহরিক ই ইনসাফ পার্টি সরকার গঠন করবে এবং ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে- এই বিশাল জনপ্রিয়তা কেন ইমরান খানের পতন ঠেকাতে পারেনি? সেটার অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে গুরুত্বপূর্ণ দুইটা কারণ আমলে নেয়া যেতে পারে- এক. তেইরিক ই ইনসাফ পার্টির ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাল পলিসি প্রয়োগে ভুল করে ফেলেছিল। ২. সেনাবাহিনী এবং আমেরিকার ব্যাপারে ইমরান খান কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। শেষে এদের ক্ষেপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন নাই।
জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং বিশাল জনসমর্থন থাকার পরেও ক্ষমতার বাইরে থাকা – এই দুইটা ঘটনাই আধুনিক গণতন্ত্রের একটা বড় ট্রাজেডি বলা যায়। রাষ্ট্রের ভেতরের পাওয়ারফুল স্টেইকহোন্ডার বা ডিপ স্টেইট এবং ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের ক্ষেত্রে স্মার্টলি ব্যালেন্সড করতে না পারলে কিভাবে বিশাল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল গুলোর হাত থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসকের হাতে ক্ষমতা ছিনতাই হয়ে যায় এই সময়ে এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় উদাহরণ তেহরিক ই ইনসাফ,এনএলডি এবং বিএনপি।
এই ধরনের পরিস্থিতি শুধু ইমরান খান নন,যেকোনো রাজনৈতিক দল ও নেতার পক্ষেই ডিল করা খুব কঠিন ব্যাপার। পাকিস্তান ছাড়া আরও দুটো দেশে একই ঘটনা ঘটছে, একই পরিস্থিতি চলছে । তার একটি মিয়ানমার। যেখানে পার্লামেন্টে সংখ্যা গরিষ্ঠ একটি দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি নির্বাচনে জয়ী হয়েও পারলামেন্টে বসতে পারে নাই, সরকার গঠন করতে পারে নাই! নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের শীর্ষ নেত্রী অং সাং সুকি(রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সুকির ভূমিকার জন্য বিতর্কিত কিন্তু সে দেশে তিনি জনপ্রিয় এতে সন্দেহ নেই,যদিও বর্তমানে তার দল রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে অবস্থান পরিবর্তন করেছে) এখন কারাগারে বন্দী! দেশে চলছে এখন গৃহযুদ্ধ! মিয়ানমারে অং সান সুকি যে ভুলটা করলেন সেটা হচ্ছে তিনি চীন এবং সেনাবাহিনীকে প্রোপারওয়েতে ডিলিংসটা করতে পারেন নাই। অথচ এনএলডির সাথেই কিন্তু মিয়ানমারের জনগণ। তারা ভোটও দিয়েছে। জনগণ যেকোনো সময় জনগণের ভোটে সরকার গঠন করার সুযোগ পেলে অং সাং সুকিকেই ক্ষমতায় বসাতে চায়, কিন্তু তা আর হচ্ছে না! এখানে মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানে যেমন আমেরিকা জনগনের অধিকারের তোয়াক্কা না করে নিজেদের অনুগতদের ক্ষমতায় বসাতে খানকে হটিয়েছে। মিয়ানমারে চিনের ভূমিকা আমেরিকার চেয়ে এক কাঠি না বরং কয়েক কাঠি সরস মানে জটিল ও বলপ্রয়োগমূখিন। অবশ্য চিনের সিল্ক রোড প্রকল্পের জন্য মিয়ানমান চিনের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘ওয়ার অন টেরর’ -এর পরে আমেরিকার কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব ঠিক ততটা এখণ আর নাই। চিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট তৃতীয় বাবের মতো দেশের ক্ষমতা নেয়ার পরে সম্প্রতি ইমরান খান টুইট করে তাকে অভিনন্দ জানিয়েছেন। ধারণা করা যায়-
খান যদি আগামী নির্বাচনের পরে পাকিম্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসেন, পাকিস্তান-চিন-রাশিয়া মিলে দুনিয়ার নয়া মেরুকরণ তৈরি হওয়ার যে প্রকৃয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল কয়েক বছর আগে মানে করোনার আগে তা বেশ গতি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এবার একটু নিজের দেশের অবস্থার দিকে মনযোগ ফেরানো যাক-
বিএনপি এই মূহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। যেকোনো সময় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি সরকার গঠন করবে এটা একটা সহজ কিন্তু ( অর্জন করা কঠিন) বাস্তবতা। বিএনপির বিরোধীরাও এটা বিশ্বাস করে। বেগম খালেদা জিয়া যদি সুস্থ্য থাকেন কিংবা তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়াও অসম্ভব নয়। জনগণের এতো বিশাল সমর্থন থাকার পরেও চৌদ্দ এবং আটারো সালে দুই মেয়াদে নিরাপদে ক্ষমতায় বসে আছে একটি অর্নিবাচিত রাতের বেলায় সিল মেরে ভোট চুরি করা সরকার। এবং খোলা চোখে দেখলে মনে হয়- বেশ নিরাপদেই মানে- কোনো বড় ধরনের অভ্যন্তরীন এবং এক্সটার্নাল প্রেসার ছাড়াই পার পেয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এখানেও মানে এই পয়েন্টেও সেনাবাহিনীর সাথে বিএনপির বোঝাপড়ার ঘাটতি আছে। অবশ্য এই ঘাটতির বিষয়টি এক/এগারো -এর সরকার কায়েম ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পথকে পোক্ত করেছে। কিন্তু এতোদিনেও অবস্থার উন্নতি হয়েছে তা বলার সুযোগ নাই। আরও একটি পয়েন্টের দিকে মনযোগ দিতে হবে। সেটা হলো- ভারত এবং চীনকে স্মার্টলি ডিল করতে পারা যায় নাই। এইসব দেশে ক্ষমতার রাজনীতির পথ খুবই বিচিত্র । এখানে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা খুব জরুরী। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার ভারত প্রশ্নে অনঢ় অবস্থান মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশে এখন কার্যত ভারতের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এখন ক্ষমতার লোভে যে নেত্রী এই পথে পা রাখেন নাই তার গ্রেটনেসকেও আমলে নিতে হবে। আজ এটা বুঝতে না পারলেও ইতিহাসে বেগম জিয়ার বাংলাদেশ দরদী অবস্থান অমর হরফে লেখা থাকবে। এখন কথা হলো দল এই নেত্রীর স্পিরিটের মর্যাদা রাখার উপযোগি হয়ে উঠতে পারছে কি না তা একটি বিবেচনার বিষয় হতে পারে। তার পরেও প্রতিবেশি ও বড় শক্তির সাথে ভারসাম্যের রাজনীতি ঠিকঠাক মতো করতে না পারলে সারা দেশের জনগণ,জনসমর্থন এবং ভোট আপনার পাশে থাকার পরেও ক্ষমতা আপনার হাত ছাড়া হতে পারে – এটাই দেখা যাচ্ছে এই তিনটি দেশের অবস্থা বিবেচনা করে।
পাকিস্তান,মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে-তেহরিক ই ইনসাফ, ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি এবং বিএনপির সমস্যার মূল জায়গায় আমরা একটা মিল দেখতে পেলাম। তিনটা দলই দারুণ জনপ্রিয় কিন্তু তিনটা দলই ক্ষমতার বাইরে, ক্ষমতায় নেই!’কেন’নেই? সেই বিচার বিশ্লেষণ করে বাস্তবতা বুঝতে পারাটা এখন খুব জরুরী। জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং বিশাল জনসমর্থন থাকার পরেও ক্ষমতার বাইরে থাকা – এই দুইটা ঘটনাই আধুনিক গণতন্ত্রের একটা বড় ট্রাজেডি বলা যায়। রাষ্ট্রের ভেতরের পাওয়ারফুল স্টেইকহোন্ডার বা ডিপ স্টেইট এবং ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের ক্ষেত্রে স্মার্টলি ব্যালেন্সড করতে না পারলে কিভাবে বিশাল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল গুলোর হাত থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসকের হাতে ক্ষমতা ছিনতাই হয়ে যায় এই সময়ে এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় উদাহরণ তেহরিক ই ইনসাফ,এনএলডি এবং বিএনপি।
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে শুধু ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা নয় বরং জনগনই যে ক্ষমতার মালিক বা পরির্বতনের এখতিয়ার রাখেন সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করাও কঠিন হয়ে উঠেছে।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia