বাঙালির ফ্যাসিবাদ চর্চার প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং চলতি সময়ের জরুরী সাংষ্কৃতিক ও অন্যসকল প্রসঙ্গ নিয়ে ফাহাম আব্দুস সালাম– এর মুখোমুখি
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সমাজ চিন্তা ও রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক পর্যালোচনায় ফাহাম আব্দুস সালামের নাম বহুল উচ্চারিত। ‘বাঙালির মিডিওক্রিটির সন্ধানে -খ্যাত বইয়ের এই লেখক প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সমাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়-আশয় নিয়ে লিখেন, মতামত দেন। বাঙালি জীবনের তত্ত্ব তালাশ করতে গিয়ে অনেক অপ্রিয় কথা খুব সরসভাবে তিনি বলে ফেলেন। আন্তরিকভাবে তর্ক তুলেন। চিন্তার নির্মাণে সোচ্চার এই মানুষটি জবানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে আমাদের জন্য জরুরী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। এই সংখ্যার প্রচ্ছদ সাক্ষৎকার হিসেবে এটি পাঠকদের জন্য ছাপা হলো:
জবান: আপনি জানেন, বাংলাদেশে সবকিছুকে মোটা দাগে দেখবার একটা খাসিলত আছে। ‘ফ্যাসিবাদ ‘ শব্দটিকে একটি গালি আকারে ব্যাবহার করা হলেও এটা যে একটা মতাদর্শ তা খুব একটা আলোচনায় থাকে না। এর মধ্যে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ দিল্লীর কাছে পরাজিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ ধারার উপর ভর করে গড়ে উঠেছে। এটার মূল শক্তি সাংস্কৃতিক। এই প্রশ্ন যখন করছি, তখন বলে রাখি সংষ্কৃতিকে আমরা একটা রাজনৈতিক ক্যাটাগরি আকারে দেখছি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে, তাকে আমরা ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ’ বলছি। আপনার অভিমত জানতে চাই?
ফাহাম: প্রথমেই বলে রাখি, ক্লাসিকাল অর্থে আমরা যে ‘ফ্যাসিবাদ’ বুঝি, পলিটিকাল সায়েন্টিস্টরা যেই অর্থে শব্দটা বোঝেন – সেই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে নাই। কারণ, ফ্যাসিবাদ একটা বিশেষ সময়ের ও বিশেষ জায়গার রাজনৈতিক প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের বেশ কয়েকটা ‘কি এলিমেন্ট’ বাংলাদেশে ডেভালাপ করে নাই। কারণ সেই পরিস্থিতি বাংলাদেশে নাই। যেমন মিলেটারি কিংবা জাতির শুদ্ধতা নিয়ে অবসেশান বাঙালিদের মধ্যে নাই, আওয়ামীদের মধ্যেও নাই। তারপরে ধরেন ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসিস্ট ও মার্ক্সসিস্টদের সাথে টম এন্ড জেরী টাইপ শত্রুতা ছিল অথচ বাংলাদেশে যারা মার্ক্সসিস্ট বলে দাবী করেন তারা আবার আওয়ামী লীগের সাথে বেশ লটকালটকি করেন। ঘন প্রেম।
তবে এটাও ঠিক যে ফ্যাসিজমের অনেকগুলো উপাদান বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রবলভাবে উপস্থিত আছে। সেগুলো থাকার পরেও মুসোলিনিকে যদি বলা হয় যে শেখ হাসিনা একজন ফ্যাসিস্ট – তিনি রেগেমেগে মানহানির মামলা করতে পারেন! ফ্যাসিস্টরা অস্বাভাবিক পর্যায়ে ম্যাস মোবিলাইজেশন করতে পারতো। তারা তো অসম্ভব কম্পিটেন্টও ছিল। মুসোলিনি বলবেন যে, বাংলাদেশের এগুলা তো চুরি ছাড়া আর কোন কাজই এফিশিয়েন্টলি করতে পারে না।
ফ্যাসিজম বাংলাদেশে এসে আসলে বাকশাল হয়ে গেছে। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশে ঢুকলে যেকোন মতাদর্শই পায়খানা হয়ে যায়। বাংলাদেশের ফ্যাসিজমটা থার্ড ক্লাস, ডিক্টেটরও থার্ড ক্লাস।
তবে আমি নিজেও আওয়ামী লীগের প্রোগ্রাম ও এদের অনুসারীদের ফ্যাসিস্ট বলেছি। এর কারণ, এদের বহু কর্মকান্ড ও মানসিকতা ফ্যাসিস্টদের সাথে মেলে। আপনি তো পুরাপুরি মুসলমানের মতো আচরণ না করলেও, নামাজ-রোজা-জাকাত না করলেও আপনাকে আমি মুসলমানই বলি, তাই নাহ? এই এপ্রক্সিমেশন ঠিক আছে।
ফ্যাসিজম বাংলাদেশে এসে আসলে বাকশাল হয়ে গেছে। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশে ঢুকলে যেকোন মতাদর্শই পায়খানা হয়ে যায়। বাংলাদেশের ফ্যাসিজমটা থার্ড ক্লাস, ডিক্টেটরও থার্ড ক্লাস।
তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যা হচ্ছে তাকে ফেইল্ড আধিপত্যবাদ বলা যেতে পারে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ বলতে আমার আপত্তি আছে। এর কারণ এরা জাস্ট উচ্ছিষ্ট ভোগী। এদের কোন আইডিয়োলজিই নাই, থাকলেও তার মধ্যে কোন সফিস্টিকেশান নাই। তেমন কোনো ইনফ্লুয়েন্সও নাই। এরা জাস্ট অনেক ভাত খাওয়ার জন্য একটা ট্রাইবালিজমে ভর্তি হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি – আমি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ নিয়ে একটুও দুশ্চিন্তা করি না, কারণ এদের কোন পেনিট্রেশান নাই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এদের কোনই গ্রহণযোগ্যতা নাই। আমার কাছে যেটা দুশ্চিন্তাজনক মনে হয় সেটা হলো, এই ন্যারেটিভকে যারা চ্যালেঞ্জ করছে – সেই ন্যারেটিভও যথেষ্ট পোটেন্ট না। সেই ন্যারেটিভ নির্মাণের জন্য আমাদের মধ্যে যেই একাডেমিক ফাউন্ডেশনটা দরকার – সেটা এখনও গড়ে উঠছে না। এইটা বরং চিন্তার বিষয়।
সংস্কৃতির সাথে একটি জনগোষ্ঠির দার্শনিক ও সাইকোলজিক্যাল মনোভাবের সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের জনগণের সাইকি আপনি অনেকদিন থেকে রিড করে আসছেন। এই ফ্যাসিবাদের পক্ষে এমন সাংষ্কৃতিক বলয় গড়ে উঠবার কারণ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
অর্থনৈতিক!
আপনি যদি খেয়াল করেন দেখবেন যে, এই সাংস্কৃতিক বলয়ের যারা আইডিওলগ মানে ফাউন্ডিং ফাদার্স, এরা প্রায় সবাই ৪০ থেকে ৭০-এর দশকে স্কুলে গিয়েছেন এবং তাদের প্রধান মক্কা ছিল কলকাতা। তারা পশ্চিমবঙ্গের লিটেরারি ক্লাসের মতো লিখতে চাইতেন, বলতে চাইতেন, গান গাইতে চাইতেন। কারণ ‘তাদের’ মতো হয়ে ওঠাটাই ছিল একটা সামাজিক ভ্যালিডেশন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রায় সব আইডিওলগকে এই জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে রি-ইমাজিন করতে হয়েছিল। এই রি-ইমাজিনেশনে মুসলমানের সব অনুভূতি, সব আচার হলো সেলেব্রেশনের অনুপযোগী। মুসলমান তার ধর্মকে বাড়ীতে রাখবে আর বাইরে সে সেলেব্রেট করবে তার বাঙালিত্বকে; কিন্তু এই ‘বাঙালিত্ব’ জিনিসটা কী – সেটা আবার সে ডিফাইন করতে পারে না। ফলে সে বাঙালি ব্রাহ্মণের লাইফস্টাইলকে ‘বাঙালিত্ব’ বলে কল্পনা করে নেয়।
যেই প্রশ্নের মধ্যে বাঙালি মুসলমানকে ক্যাপটিভ করা হয় সেটা হলো, আপনি মুসলমানের আগে তো বাঙালি ছিলেন – নাকি? What does it mean really? চোদ্দ পুরুষ আগে আমার পরদাদা কে ছিল – এটা জেনে আমার কী হবে? আমি নিজে কী ও কে – এই প্রশ্নের চাইতে চোদ্দ পুরুষ আগের মানুষটাকে প্রিমেসি দিতে হবে – এটা এই ননসেন্স বাংলাদেশে খুবই আবেগ উদ্রেক করে!
এখন এই মানসিকতার লোকেরা নিজেরা নিজেরা একটা অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলে। নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়া-চাপড়ি করবে। তারপর সরকার থেকে সুযোগ সুবিধা নেবে। এইটা একটা ইকো-সিস্টেম, যার আসল আঠা হলো টাকা-পয়সা। কোন আইডিয়াল নাই এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের তেমন কোন রেলেভেন্সও নাই। বাংলাদেশ পর্বে যারা আসলেই সাধারণ মানুষের মনোযোগে এসেছিল – যেমন ধরেন আজম খান, হুমায়ুন আহমেদ, আইয়ুব বাচ্চু, রুনা লায়লা, আহমেদ ছফা – এরা কিন্তু কেউই ‘সাংস্কৃতিক অঙ্গন’-কে ঔন করা মানুষ না।
এই সাংস্কৃতিক অঙ্গন একেবারেই মেরিটোক্রেটিক না, বরং কেউ যদি লো আইকিউর শিক্ষিত বোকাচোদা হয় – এই অঙ্গনে সে খুবই ভালো করবে। তাই হয়েছে। এদেরকে শুধু দেখাতে হয় যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ন্যারেটিভে ঈমান তাদের আকাশচুম্বি বাংলা তাদের প্রমিত আর রবীন্দ্রনাথে তাদের অনড় ব্রত! দুয়েকটা বাদ গেলো মনে হয়? এই কয়েকটা ভার্চু সিগনালিং করলে একটা অল্প মেধার মানুষের যদি একটা অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত হয়ে যায়, কোন গাবলু এই ক্লাবে জয়েন করবে না বলেন?
এই দেশে ৯০-এর দশেকে যে নির্মূল কমিটি গঠিত হয়েছিল, শুরুর দিকে লীগের প্রতি তাদের সন্দেহ ছিল যে, লীগ আসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকবে কি না? অনেক অবিশ্বাস সত্তে¡ও তারা একমাত্র লীগকেই এই চেতনা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক এজেন্সি মনে করেছিল। ওদের আন্দোলন লীগ ও জামায়াতের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনের দৃশ্য দেখার পরে হতাশ হতে থাকে! কিন্তু শাহবাগে আবার সেই একই দাবি নিয়ে আরও জঙ্গী রূপে এরা হাজির হয় প্রায় তিন দশক পরে। ফলে সমাজে সাংষ্কৃতিক ফ্যাসিবাদের যে ৩০ বছরের আবাদ তার ফলন ঘরে উঠলো বিনাভোটের ক্ষমতায় লীগ আসীন হওয়ার মধ্যদিয়ে, এই এত দিন পরে। ফলে শাহবাগকে যারা হুট করে গজিয়ে ওঠা আন্দোলন হিসেবে দেখেন তারা এই ইতিহাসটা পাশ কাটিয়ে যান। আবার অনেকে শাহবাগের গ্রে এড়িয়া আবিষ্কার করেন। আপনার মন্তব্য জানাবেন …?
আমি শাহবাগকে যেভাবে বুঝি, সেটা হলো ইভেন্ট হিসাবে শাহবাগ আসলেই হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা। গজিয়ে উঠলে বাঙালির যা কাজ – মানে ঘরে আগুন লাগলে পড়শী এসে ঐ আগুনে আলু পোড়ায় ও মজা নেয়, সেইটাই করে। শাহবাগের ক্ষেত্রে সেটা করেছে আওয়ামী লীগ; কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষতো সেখানে গিয়েছেন, তাই না? তারা কেন গেল?
একটা কারণ হলো, কার্নিভালে মানুষ যায়, যেতে চায়। সন্ধ্যার পর ঢাকায় বেড়ানোর জায়গা কম। গান-বাজনা হয়, ফুচকা পাওয়া যায়, এমন জায়গায় তো বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যাবেই। অনেকের মুখে তখন শুনেছিলাম যে সেখানে সুন্দরী মেয়েদের আনাগোনা আছে শুনে গিয়েছিলেন কিন্তু তারা আশাহত হন। যে কারণে তারা বেশী বেশী ফুচকা খেয়েছিলেন!
কিন্তু এগুলো এক্সটার্নাল বিষয়। আমার কাছে যেটা সব সময়ই হাইলি ডিস্টার্বিং লাগে সেটা হলো, শাহবাগী মানসিকতার মানুষ! আনসফিস্টিকেটেড, গোঁয়ার, অসহিষ্ণু, ম্যানার বোঝে না এবং খুবই প্রাউড বোকাচোদা! মনে রাখবেন, ‘শাহবাগ’ রোগ না, লক্ষণ। যে কোন সময় এই মানসিকতার মানুষদের মিলনমেলা হতেই পারে। এক্ষেত্রে সেটা আওয়ামী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলো, কিন্তু আই ক্যান ইজিলি ইম্যাজিন, অন্য কোন সময়ে, অন্য কোন জায়গায় ইসলামিস্ট কিংবা বিএনপির লোকেরাও ‘শাহবাগ’ করতে পারে। হবেই কিংবা শাহবাগে একাট্টা হলেই সেটা শাহবাগের রেপেটেশান হবে, সেইটা বলছি না; কিন্তু শাহবাগী মানসিকতাটা বিপজ্জনক! যেটা আপনার প্রশ্নে এসেছে।
আমি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ নিয়ে একটুও দুশ্চিন্তা করি না, কারণ এদের কোন পেনিট্রেশান নাই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এদের কোনই গ্রহণযোগ্যতা নাই। আমার কাছে যেটা দুশ্চিন্তাজনক মনে হয় সেটা হলো, এই ন্যারেটিভকে যারা চ্যালেঞ্জ করছে – সেই ন্যারেটিভও যথেষ্ট পোটেন্ট না। সেই ন্যারেটিভ নির্মাণের জন্য আমাদের মধ্যে যেই একাডেমিক ফাউন্ডেশনটা দরকার – সেটা এখনও গড়ে উঠছে না। এইটা বরং চিন্তার বিষয়।
আপনি সম্পূর্ণ সঠিক যে, ২০১৩ সালে শাহবাগ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন আওয়ামী লীগকে লেজিটিম্যাসি দিয়েছিলো এবং বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট প্রবণতাকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছিলো; কিন্তু বাংলাদেশী আরবান য়ুথের মধ্যে যতদিন এই মানসিক বিকার থাকবে – যতদিন তারা প্রচুর গর্ব করার জন্য বোধবুদ্ধি ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে সদাপ্রস্তুত থাকবে, ততোদিন এই ফোর্স থেকে আপনি নিরাপদ থাকবেন না।
একটা চিন্তাশীল মানুষের দলে যদি অ-নে-ক মানুষ হয়ে যায়, তার তো ভয় পাওয়ার কথা। আপনি ব্রুট মেজরিটির পক্ষের মানুষ এটা তো একটা অস্বস্তির বিষয়।
বাংলাদেশে সাংষ্কৃতিক মূলধারা বলে যে বলয়টি বা চক্রটি সক্রিয় আছে তা রাজনৈতিক সংষ্কৃতির প্রশ্নে উলঙ্গভাবে ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর বিরোধীদের নানানভাবে ট্যাগ করা হয়। সব সময়ই অযোগ্য মনে করা হয়, বা অযোগ্য বলে প্রচার চালানো হয়। এই ন্যারেশন তৈরিতে ভারতীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী বামপন্থার একটা বড় ভূমিকা আছে। এরা খুব সহজভাবেই ইসলামের বিষয়ে ঘৃণাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পালন করেন। এই অবস্থায় একটা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ধারাকে কিভাবে মূল বা জাতীয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব বলে মনে করেন? তার আগে গণতান্ত্রিক সংষ্কৃতি নিয়েও আপনার কাছ থেকে একটু শুনতে চাই।
গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ধারাকে মূল বা জাতীয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। তবে সেটার জন্য লিডারশিপ লাগবে। আপনি যদি বাংলাদেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থে রুল অফ ল ও মেরিটোক্রেসি দেয়ার চেষ্টা করেন, চেষ্টা করলেই সফল হয়ে যাবেন, সেটা বলছি না; কিন্তু যদি আপনি আপনার চেষ্টায় সিনসিয়ার হন, আমার মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ সেটা রেকগনাইজ করবে।
আপাতত বিএনপি ছাড়া কোন কন্টেন্ডার নাই। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে বলছি। যদি বিএনপি আওয়ামী লুটপাটতন্ত্রের বদলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী লুটপাটতন্ত্র কায়েম করে তারা এক বছরও টিকতে পারবে না।
বাংলাদেশের বটম-আপ চেইঞ্জ হয় না বললেই চলে, হতে হবে টপ-ডাউন চেইঞ্জ। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ধারাকে মূল বা জাতীয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আপনাকে সেটা লিডারশিপের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। আপনাকে আপনার কাজের মাধ্যমে রেলেভেন্ট থাকতে হবে। না-বাদী কর্মকান্ড মানে আওয়ামী লীগের এই খারাপ- সেই খারাপ, ওকে জেলে ঢোকাও, তাকে চাকরি থেকে বের করো – এই কাজ আপনি ৬ মাস থেকে ১ বছর করতে পারবেন। এরপর কী করবেন? আপনাকে ডেলিভার করতে হবে।
বিএনপি লিডারশিপকে অবশ্যই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আবর্জনা সাফ করতে হবে। এটা করা খুব সহজ; কিন্তু তারপরে কী হবে? আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিএনপি কোন সাফল্যই পাবে না। বিএনপিকে ডিএসএ বাতিল করতে হবে এবং এরপর পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে যে, ফারজানা রুপা যেন নিঃসংকোচে দালালী করতে পারে। আপনি যখন সবাইকে বলতে দেবেন তখন ফারজানা রুপা, মাহফুজ আনাম এনারা ইরেলেভেন্ট হয়ে যাবে। ওনাদেরকে ছাঁটাই করে ইরেলেভেন্ট করা সম্ভব না। ফারজানা রুপার এন্টিডোট সরকার দিতে পারবে না – ফারজানা রুপা কে ও কী করে – সেটা ইলিয়াস সাহেবকে মিডিয়াতে বলতে দিন। লেট পিপল ডিসাইড।
সমস্যা হোল ডেমোক্রেসির এই কাউন্টার-ইনটিউটিভ সত্যটা সবাই জানে কিন্তু ক্ষমতায় গেলে কেউ এটার ওপর আস্থা রাখতে পারে না। ডেমোক্রেটিক ফোর্সের মূল কাজ হোল সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিচ্ছু না করা।
সোশাল মিডিয়ায় আওয়ামীরা কেন পরাস্ত হয়েছে? কারণ এখানে সবাই কথা বলতে পেরেছে। প্রো-ডেমোক্রেসি লিডারশিপকে এই রিয়ালিটিটা বুঝতে হবে। গণতন্ত্র কোন মসৃণ মেকানিজম না। এটা একটা কেওটিক প্রসেস। গণতন্ত্র থাকলেই সেখানে কেওস থাকবে কিন্তু সরকার যদি ইন্টারভিন না করে, সাধারণ মানুষই আওয়ামী সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে রিজেক্ট করবে। আপনি নিয়ম করেন যে, প্রতিটি মিডিয়া হাউজকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি হতে হবে এবং তাদের ৫০% শেয়ার বাজারে ফ্লোট করতে হবে। তখন তারা মানুষের কথা জানাতে ও শুনতে বাধ্য হবে। আপনি শুধু নিয়ম করেন যে, মিডিয়া হাউজগুলোর প্রতিটি পাই-পয়সা রিপোর্ট করতে হবে তাদের ওয়েব সাইটে। সরকারের কোন ইন্টারভেনশনের দরকার নাই। শুধু মেইক শিওর যে, কারা তাদের কত টাকা দেয় এটা যেন মিডিয়া হাউজ ও টিভি চ্যানেলগুলো সাধারণ মানুষকে জানাতে বাধ্য হয়।
মিডিয়া হাউজগুলোকে সাধারণ মানুষের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য করলে এবং সরকার নিজে এই দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে ইন্টারভিন না করলে দেখবেন ৭১ টিভির মতো দালাল প্রতিষ্ঠান টিকতে পারছে না এবং লেট দেম পেরিশ। আপনার মধ্যে এই আস্থা থাকতে হবে যে, আপনি যদি নিজে রুল অফ ল মানেন ও মেনে দেখাতে পারেন, কেবল তখনই আওয়ামী লুটপাটতন্ত্র পরাস্ত হবে।
বিএনপি লিডারশিপকে অবশ্যই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আবর্জনা সাফ করতে হবে। এটা করা খুব সহজ; কিন্তু তারপরে কী হবে? আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিএনপি কোন সাফল্যই পাবে না। বিএনপিকে ডিএসএ বাতিল করতে হবে এবং এরপর পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে যে, ফারজানা রুপা যেন নিঃসংকোচে দালালী করতে পারে। আপনি যখন সবাইকে বলতে দেবেন তখন ফারজানা রুপা, মাহফুজ আনাম এনারা ইরেলেভেন্ট হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক লিডারশিপ যদি গণতন্ত্র প্র্যাকটিস করে, বাকস্বাধীনতা দেয় এবং কাউকেই কোন সুবিধা না দেয় – আপনি দেখবেন যে ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী/সাংস্কৃতিক সমাজ ওভারনাইট কলাপ্স করবে! এই সাংস্কৃতিক লিডারশিপ সম্পূর্ণ নতুন গ্রুপের কাছে সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট বেসিসে চলে যাবে। আমি এটাই চাই। সাধারণ মানুষ ডিসাইড করুক কে তাদের হিরো? তারা যদি হিরো আলমকে তাদের হিরো মনে করে, সো বি ইট।
লেখক, আর্টিস্ট, বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া হাউজ, নিউজ চ্যানেল – এদের কানেক্ট করতে হবে সাধারণ মানুষের সাথে। এখন তারা কানেক্ট করছে মিডিয়া হাউজ ও আওয়ামী চোরদের সাথে। যেই মুহূর্তে আপনি নিশ্চিত করবেন যে সাধারণ মানুষ, পাঠক ও শ্রোতা ছাড়া তাদের ভাত নাই- কেবল তখনই দেখবেন যে দালালীর মৃত্যু ঘটেছে। প্রো-ডেমোক্রেসি সরকারের কাজ হবে এটা নিশ্চিত করা যে কোনভাবেই যেন এরা সাধারণ মানুষকে বাদ দিয়ে স্পনসর, চোর-বদমাইশদের কালো টাকায় টিকতে না পারে। লেট দ্যা পিপল ডিসাইড।
বাংলাদেশের মিডিয়া ও ফ্যাসিবাদী সংষ্কৃতির মধ্যে যে সম্পর্ক আমরা এই গত এক দশক ধরে দেখে আসছি তা এর আগে কখনও দেখা যায় নাই। আধুনিক-সেকুলারিজমের নামে এখানে যে ঘৃণাবাদী সাংষ্কৃতিক ধারা গড়ে উঠেছে তা শিল্প-সাহিত্যের জন্য যে পাইটি বা মেডিটেশন লাগে তার বিষয়ে উদাসীন। শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে চারদিকে মিডিওক্রেসির যে বিপুল প্রবাহ – এটাকে মোকাবেলার জন্য আপনার প্রস্তাবনা বা চিন্তাটা জানতে চাই?
এটার কোন উত্তর আমার জানা নাই আসলে। আপনার অবজার্ভেশানের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত এবং আমি গত ২০ বছর ধরে এই মিডিয়োক্রিটির কারণ কী – সেটা বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমার উপসংহার হলো, আমাদের ভাষা এবং আমাদের পাবলিক মেমোরির মধ্যে নিঃসন্দেহে এমন কিছু আছে যার কারণে এখানে মিডিয়োকার হিসেবে থেকে যাওয়াটা এতো সহজ ও গ্রহণযোগ্য; কিন্তু কিভাবে এই মিডিয়োক্রিটি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, সেটা আমি জানি না।
বাংলাদেশের কথাকথিত নারীবাদী ধারা জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে তাকে মোকাবেলা করার জন্য কী করা দরকার বলে মনে করেন?
প্রশ্নটা এতোই জটিল ও ব্যাপক যে এর উত্তর দেয়া আমি কেন, বাংলাদেশে কারো পক্ষেই সম্ভব না। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশের একটা সাধারণ সমস্যা হলো, এই দেশগুলোর সমাজগুলো আদিম এবং যথেষ্ট ইভলভড না কিন্তু তারা হুট করে পৃথিবীর সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে। এই এক্সপোজার টু টেকনোলজি এন্ড কানেকটিভিটি এক অভূতপূর্ব সমস্যা তৈরী করেছে। সবাই রেগে আছে এবং সবাই প্রতিক্রিয়াশীল কিন্তু আসলে প্রতিক্রিয়া করতে পারছে না, কারণ সার্ভেইলেন্সও ব্যাপক (সরকারী ও অসরকারীভাবে)।
এই অবস্থায় আমরা ঠিক বুঝতেই পারছি না নারীবাদী মূলধারার প্রতিক্রিয়ায় যে এন্টি-ধারা গড়ে উঠেছে তারা কি শুধু অনলাইন ট্রল নাকি কোন অর্গানাইজড চিন্তাধারা। এটা বোঝা আরো কঠিন কারণ, বাংলাদেশে নারীবাদী মূলধারার বেশীরভাগ এক্টরের নারীবাদী টুপি ছাড়া অন্য টুপিগুলো হাইলি প্রবলেম্যাটিক। যেমন ধরেন, মইনুল হোসান সাহেব মাসুদ ভাট্টি নামক একজন আওয়ামী কর্মীকে টিভিতে চরিত্রহীন বলাতে অনেক নারীবাদী রাগে ফেটে পড়লেন, প্রেস কনফারেন্স করলেন, পেছনে লেখা – মাফ চাইতে হবে; কিন্তু এর মাত্র কয়েকদিন পরে সুবর্ণচরের একজন সাধারণ নারীকে ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণে ১৫/১৬টি আওয়ামী ঘরে ঢুকে গণধর্ষণ করলে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। এখন এইসব নারীবাদীকে অনলাইনে যখন ট্রল করা হয় তখন বোঝা মুশকিল যে, অনলাইনে কি তাদের নারীবাদিতা না আওয়ামীবাদিতার প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে? তারা যদি ফেইসবুকে লেখেন যে, মেয়েদের প্রোটিন খেতে হবে, এই সামান্য সত্যের প্রতিক্রিয়াতেও ট্রল করা হয়। হঠাৎ দেখলে আপনার মনে হবে নারীকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে; কিন্তু যিনি কাজটা করছেন তার মাথাতে থাকছে তিনি হয়তো একটি আওয়ামীকে ট্রল করছেন। যেখানে আমরা সমস্যাটাই ঠিক মতন বুঝি না কিংবা বুঝলেও ভাব দেখাই যে ওটা আসল কারণ না, কিভাবে আমি বলবো যে, এর মোকাবেলার উপায় কী?
পপুলিজমের সাথে সাংষ্কৃতিক ফ্যাসিবাদের একটা সম্পর্ক আছে, আপনি জানেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা যেই ধরনের সাহিত্য-সংষ্কৃতিকে জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করেছে। এটা করার জন্য বেশ কিছু মিডিয়া ও সাংষ্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। তারমধ্যে যেগুলোতে তারা সফল হয়েছে সেগুলো সমাজে একটা প্রভাব বিস্তার করেছে আর যেগুলো সফল হয় নাই সেগুলোকে ক্লাসিক ডিকলার করেছে। এই অবস্থাকে কিভাবে দেখেন?
আপনি যেটাকে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ বলছেন সেটা আসলে ঠিক একটা ভাবেই টিকতে পারতো তা হলো সরকারী পেট্রোনেজ, এবং তাই হয়েছে। আপনাকে বুঝতে হবে যে, এটা কিন্তু মূলত শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গন না – ধান্ধাবাজির অঙ্গন। শিল্প সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে কিছু – সত্য, কিন্তু সেটা বাই-প্রোডাক্ট। আসল লক্ষ্য হলো ‘ধান্ধাবাজি’।
আমরা বাঙালিরাও কোন একটা থিওরি অনুযায়ী বদলে যাবো, এটা একটা ফান্ডামেন্টালি রং এজাম্পশন। এখানকার মানুষের মধ্যে ঐ এন্টেনাটাই নাই। বাংলাদেশের মানুষ ‘ইমিটেশনের’ মাধ্যমে শেখে অথবা শেখে ‘ফোর্সের’ মাধ্যমে। এখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একমাত্র রাস্তা হলো, পলিটিকাল লিডারশিপকে গণতন্ত্র এবং রুল অফ ল নিজে মেনে দেখাতে হবে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য আছে, যেমন অনেকদিন পর্যন্তু প্রথম আলো, আওয়ামী-মুক্তিযুদ্ধ এই ন্যারেটিভকে রি-ইনফোর্স করতে সক্ষম হয়েছে। টকিং পয়েন্টস নির্ধারণ করেছে। পহেলা বৈশাখের দুপুরে পিচ-গলা গরমে লাল শাড়ী পরে ঘুরে বেড়ানো – এই জাতীয় গণরুচি নির্ধারণ করেছে। কিছু ভালো কাজও তারা করেছে, যেমন পরিবেশ রক্ষা কিংবা কিছু নারী-অধিকার রক্ষায় তারা বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে।
ইয়েস, তাদের সমাজে প্রভাব আছে কিন্তু এই প্রভাবটা মূলত রাজনীতি-সংক্রান্ত। একচুয়াল সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে বাঙালি জাতিবাদী কর্মীদের মিনিংফুল প্রভাব কিন্তু নগন্য। যেমন ধরেন, আপনার বিচারে যেটা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ তার একজন আগুয়ান সিপাহসালার বা মহানুভব ফাদার-ফিগার বা বরেণ্য লেখক হলেন হাসান আজিজুল হক। এক সময়ে প্রবল জনশ্রুতি ছিলো যে, তিনি একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখক; কিন্তু কে তার লেখা একচুয়ালি পড়েছে – এটা একটা রীতি মতোন গবেষণার বিষয়। আমি আমার অনেক লেখক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউই তার লেখা পড়েন নাই, শুরু করেছেন, কিন্তু ৫-১০ পৃষ্ঠা পরে আর নিতে পারেন নাই। আই মাইট বি রং কিন্তু বাংলাদেশে যদি ২০০জন লোক পাওয়া যায়, যারা তার প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো পড়ে থাকেন, আমি খুবই খুবই আশ্চর্য হবো! অথচ তিনি সব পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেতেন। কারণ তিনি এমন একটি ক্লাবের সদস্য যারা নিজেরাই ঠিক করে – কে ভালো, পুরস্কার দেয়, গলাবাজি করে, নিজেদের গুরুত্ব নিয়ে নিজেরাই রূপকথা লেখে! আজিজুল হক সাহেব অবশ্য ভদ্রলোক ছিলেন। তার মতোন না যারা, তারা একেকজন একেক আশ্চর্য পিস! নির্মলেন্দু গুনের মতো ক্লাসলেস লো লাইফ জাতীয় পুরস্কারও চেয়ে নেবে, নিজের নামে স্কুল-কলেজ দেখতে চাওয়ার আর্জি জানায় পাবলিকলি! সব চেয়ে নিবে।! দাও দাও দাও! মোরে জাঙ্গিয়া দাও! বুকপকেটওলা জাঙ্গিয়া পরিয়ে দাও! কারণ আমি কোবতে লিখি! হা হা!
সমস্যা কি জানেন, রাজনীতিবিদরা মনে করেন যে, এই ক্লাবে আমাদের লোকও ঢুকাতে হবে। ঐ ক্লাবে মতিউর রহমানের বদলে রনি কিংবা ফাহাম আব্দুস সালামকে ঢুকায় আপনি ইয়েটাও ছিঁড়তে পারবেন না। একমাত্র যেই কাজটা করলে আপনি ঐ ক্লাবকে অচল করে দেবেন সেটা হলো মেইক শিওর যে, সাধারণ মানুষের টাকা ও গুণমুগ্ধতা ছাড়া তাদের প্রতিষ্ঠান যেন সারভাইভ করতে না পারে। পাবলিক ডিসাইড করুক – কে ভালো। মিডিয়া হাউজগুলোকে সরকার শেয়ার হোল্ডারদের জবাবদিহিতায় আনেন। ৭১ টিভি, সময় টিভি দিনরাত মিথ্যা বলে। কেননা তারা সাধারণ দর্শকের উপর একেবারেই নির্ভর করে না। এই জায়গাটায় যদি কোন মিনিংফুল চেইঞ্জ আনা যায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের ফেইকপান্তি বন্ধ হয়ে যাবে।
এটার বিপরীতে কাউন্টার পপুলিজমও তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সময়ের রাজনৈতিক সংগ্রামে সেগুলোর বিপুল ভূমিকাও থাকছে। বিশেষকরে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে এটা করা একটু সহজ হয়েছে, কিন্তু একটা গণতান্ত্রিক সাংষ্কৃতিক ধারা নির্মাণে এই কাউন্টার পপুলিজম এবং এর সাংষ্কৃতিক সাফল্য একটা দার্শনিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে না পারলে শেষ পর্যন্ত এগুলো একটা ফ্যানাটিক/হুজুগেপনার মধ্যেই আটকে থাকে। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা সম্ভব হয় না। পাকিস্তান আমলেও এই দেশে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নে সমাজে বিভক্তি ছিল। এখনও একই ধরনের বিভক্তি দেখা যায় বা প্রশ্ন হাজির হয়। এই যে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি, এর থেকে বের হয়ে একটা গণতান্ত্রিক জাতী গঠনের সাংস্কৃতিক প্রবাহ শুরু করা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?
পপুলিজমের বিরুদ্ধে তো কাউন্টার পপুলিজমই জিতবে। সেটাই স্বাভাবিক। দেখেন এই দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কোন ডিসকোর্স বা থিউরির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে না। এটা একটা প্রবলভাবে এন্টি-ইন্টেলেকচুয়াল সমাজ। কার্ল মার্ক্সের চিন্তার কারণে রাশা বদলে গেছে তাই আমরা বাঙালিরাও কোন একটা থিওরি অনুযায়ী বদলে যাবো, এটা একটা ফান্ডামেন্টালি রং এজাম্পশন। এখানকার মানুষের মধ্যে ঐ এন্টেনাটাই নাই। বাংলাদেশের মানুষ ‘ইমিটেশনের’ মাধ্যমে শেখে অথবা শেখে ‘ফোর্সের’ মাধ্যমে। এখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একমাত্র রাস্তা হলো, পলিটিকাল লিডারশিপকে গণতন্ত্র এবং রুল অফ ল নিজে মেনে দেখাতে হবে।
ঢাকার লেখকরা যে খুব ইগোসেন্ট্রিক ও ধান্ধা দ্বারা চালিত, মিথ্যা গর্ব প্রায় প্রত্যেকের স্বাভাবিক স্বভাব। এগুলোকে পাশ কাটিয়ে একজন নতুন বা তরুণ লেখক বা সাংষ্কৃতিক কর্মী কিভাবে নিজেকে বিকশিত করতে পারেন?
দেখেন আমি ঢাকায় থাকি না। সব মিলিয়ে ঢাকায় কাজ করেছিলাম কয়েক মাস মাত্র। সেটাও প্রায় ২০ বছর আগে। আপনি যদি আমার অভিজ্ঞতা জিজ্ঞেস করেন, শুধু সেটাই বলতে পারবো। বাকীদের কথা বলতে পারবো না।
আমি বহু মানুষ চিনি বাংলাদেশে, নিয়মিত যোগাযোগও হয়। আমার অভিজ্ঞতা হলো, আজকের বাংলাদেশে লেখক হওয়ার জন্য আপনার কোনো ধান্ধাবাজি কিংবা কোন ইনস্টিটিউশনাল হেল্প লাগে না। আমার তো লাগে নাই। কোন পত্রিকায় আমি লিখি না, কোন দলগত গুটিবাজিতে আমাকে আপনি পাবেন না। মানুষ তো আমার লেখা পড়ে বলেই মনে হয়। আমি পারলে, আপনি পারবেন না কেন?
আমার কাছে যেটা সব সময়ই হাইলি ডিস্টার্বিং লাগে সেটা হলো, শাহবাগী মানসিকতার মানুষ! আনসফিস্টিকেটেড, গোঁয়ার, অসহিষ্ণু, ম্যানার বোঝে না এবং খুবই প্রাউড বোকাচোদা! মনে রাখবেন, ‘শাহবাগ’ রোগ না, লক্ষণ।
ফেইসবুক আর ইউটিউব তো খুবই খুবই ডেমোক্রেটিক বন্দোবস্ত। বাংলাদেশের তরুণদেরকে এই সম্ভাবনাকে অনুধাবন করার অনুরোধ করবো। আপনার আসলেই আর কোন হেল্প লাগবে না। আপনার যদি বলার মতো কিছু থাকে, কে আপনাকে ঠেকাবে? বাংলাদেশে জাহেদ’স টেইক নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে। উনাকে আমি এক বছর আগেও চিনতাম না। আমার বয়েসী একজন ভদ্রলোক নিজের ঘরে বসে একটা সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও বানাচ্ছেন। এবসোলিউটলি ব্রিলিয়ান্ট। আমি উনার প্রত্যেকটা ভিডিও দেখি। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে। টিভি চ্যানেলের চাইতে বেশী দেখে। বাংলাদেশ বিষয়ে উনার চেয়ে ভালো কোন কমেন্টেটর আমি আর পাই নাই।
উনি পারলে, আপনি পারবেন না কেন?
বাঙালি মিডিওক্রিটির পরে আপনি এখন বা আগামীতে কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে চান?
আমি আসলে নানান বিষয়ে আগ্রহী এবং আমার পড়াশোনার মধ্যে কোন দিনও কোন প্যাটার্ন ছিল না, এখনো নাই। খুবই কেওটিক। যখন মাথায় আসে এটা লেখা উচিত তখন সেটা লিখে ফেলি। পরের বইটাও belles letters ঘরানারই হবে। বেশ কিছু বিষয় মাথায় আছে লেখার জন্য, ভাষা-মনস্তত্ব-রাজনীতি-ধর্ম-সমাজ, এসব নিয়ে তো লিখবই। অন্য কিছু ভাবনাও আছে যেগুলো নিয়ে লেখা যায়। দেখা যাক।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia