জনপ্রিয়তাবাদ একটি বহুল আলোচিত ধারণা। সোস্যাল মিডিয়ার যুগে এই জনপ্রিয়তাবাদের যে প্রসার ঘটেছে তা সারা দুনিয়াতেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে ২০১৩ সালে শাহবাগেও আমরা কৃত্রিম জনজোয়ার তৈরি এবং এর হাত ধরে সমাজে বিভক্তি আর এই বিভক্তিকে উষ্কে দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েমের সাংষ্কৃতিক দিকটি দেখেছি। বাংলাদেশকে শাপলা-শাহবাগে বিভক্ত করা এবং দুই পক্ষেই জনপ্রিয়তাকামী ফ্যানাটিক বুদ্ধিজিবিতার প্রসার সমাজে যে চিন্তাহীন হুজুগেপনা তৈরি করেছে তার ভুক্তভোগী বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মও। এই লেখায় বিখ্যাত চিন্তক জন ওয়ার্নার ম্যুলারের ‘হোয়াট ইজ পপুলারিজম’ বইটি ধরে বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে – সম্পাদক।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী পপুলারিজম বা জনপ্রিয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গত এক দশকে পপুলারিস্ট নেতাদের আধিপত্য দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কাদেরকে পপুলারিস্ট নেতা বলে মনে করতে পারি? পপুলারিস্টদের রাজনৈতিক ধরণ, তাদের মনস্তাত্বিক গড়ন বিবেচনা এবং পপুলারিস্টদের চূড়ান্ত চেহারা কেমন- এই বিষয়গুলো নিয়ে ধারণা থাকা দরকার। পপুলারিজম আসলে কী? আবার, ডানপন্থী পপুলারিজম এবং বামপন্থী পপুলারিজমের মধ্যে পার্থক্য কী? পপুলারিজম কি একটি সরকারকে জনগণের কাছাকাছি নিতে পারে? পপুলারিজম গণতন্ত্রের জন্য কতটা হুমকি স্বরূপ – এই প্রশ্নগুলোর বিশ্লেষণ খুব জরুরি।
জার্মান ইতিহাসবিদ, পপুলারিজম বিষয়ক গবেষক, জন ওয়ার্নার ম্যুলারের মতে, বহুত্ববাদকে অস্বীকার করার প্রবণতাই হচ্ছে পপুলারিজম। পপুলারিস্টরা মনে করেন, কেবল তারাই জনগণের স্বার্থের দেখভাল করে থাকেন। তবে তাদের এই ‘জনগণ’ – ধারণাটা বেশ মজার। জনগণের মধ্যে যারা তাদের অনুসারী হবে, তাদের গুণগান করবে – কেবল তাদেরকেই তারা প্রকৃত জনগণ বলে মনে করে থাকেন। এসব কারণে দেখা যয়, প্রায় সকল পপুলারিস্ট শাসকই যখন প্রভূত ক্ষমতার মালিক হন, তখনই তাদের কর্তৃত্ববাদি চেহারাটা ফুটে উঠে। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাদের ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয়। এটা করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা জনগণের অধিকারসমূহে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। বাকস্বাধীনতা তথা সর্বরকমের মতপ্রকাশে বাধা প্রদান, ভোটাধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি হয়ে উঠে তাদের শাসন কাঠামোর প্রধান অনুষঙ্গ।
কর্তৃত্ববাদি শাসকদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, চটকদার উপায়ে বিভিন্ন রকম অগ্রগতি ও উন্নয়নের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজেদেরকে সব সময় দৃশ্যপটে হাজির রাখা। এর মাধ্যমে তারা যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়, তেমনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের অপকর্মসমূহকে আড়াল করা। গত এক দশকের বাংলাদেশকে যদি আমরা একটি টেস্ট কেইস হিসেবে নেই, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ভোটাধিকার হরণের নানা তরিকা বিশ্বরাজনীতিতে একটি আলোচ্য বিষয়। সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা, দিনের ভোট রাতে করার মতো বিভিন্ন ভোট চুরির প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশের একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার উপর আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু কর্তৃত্ববাদী চেহারার এমন একটি সরকার তীব্র গণ অসন্তোষ সত্তে¡ও কিভাবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে টিকে রইলো! এ প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসককে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, উন্নয়নকে দৃশ্যমান রাখা এবং উদযাপনের ব্যাপক প্রচারণা চালানো – এবং এই কাজে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে এমন চরিত্রদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো হয়। খেলোয়াড়, চিত্র জগতের তারকা থেকে শুরু করে মিডিয়াতে এমন হাইপ তৈরি করা হয় যাতে স্বৈরশাসকদের দুর্নীতির হাতিয়ার এই ধরনের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। এখানেই আমরা কর্তৃত্ববাদের সাথে সরাসরি পপুলারিজমের যোগসূত্র পেয়ে যাই এবং এটাই এই ধরনের শাসকদের টিকে থাকার রহস্য।
কর্তৃত্ববাদি শাসকদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, চটকদার উপায়ে বিভিন্ন রকম অগ্রগতি ও উন্নয়নের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজেদেরকে সব সময় দৃশ্যপটে হাজির রাখা। এর মাধ্যমে তারা যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়, তেমনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের অপকর্মসমূহকে আড়াল করা। গত এক দশকের বাংলাদেশকে যদি আমরা একটি টেস্ট কেইস হিসেবে নেই, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
ক্ষমতারোহণের পর পপুলারিস্টদের প্রথম কাজ হয়, সাংবিধানিক কাঠামোকে আমিময়/এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করে গড়ে তোলা। অর্থাৎ ব্যক্তি নিজেই শাসনকাঠামোর কেন্দ্রে আবির্ভুত হয়; এবং বাকি সবকিছু তাকে ঘিরেই ঘূর্ণায়মান থাকে। বাংলাদেশও এই মূহুর্তে এর ব্যতিক্রম নয়। রাষ্ট্রকাঠামোতে অবস্থানরত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিভাগকে ভেঙে ফেলার মাধ্যমে, সংবিধানকে সুবিধামতো সাজানোর মাধ্যমে – বর্তমানে বাংলাদেশে এক ধরনের এককেন্দ্রিক শাসনকাঠামো বিরাজ করছে। কেবল তা-ই নয়; রাষ্ট্রকাঠামোর পাশাপাশি রাজনীতিকেও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্র এবং দলীয় রাজনীতি – উভয় ক্ষেত্রেই ‘বিকল্প দেখান’ তত্তে¡র মাধ্যমে একটি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি – সবার মুখেই কেবল এক ব্যক্তির বন্দনা চর্চিত হচ্ছে। এটা দেখতে ও শুনতে যেমন অদ্ভুত; তেমনই রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে এর মন্দ প্রভাবও সুদূরপ্রসারি। এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘায়িত হলে একটি দেশে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠার পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশটি ক্রমেই একটি ভয়াবহ সংকটের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পপুলারিস্ট নেতা ও পপুলারিজমকে এ কারণে গণতন্ত্রের উত্তরণ ও বিকাশের পথে একটি প্রচন্ড বাধা হিসেবে গণ্য করা যায়। মনোবিজ্ঞানে এই ধরনের আচরণকে বিকার আকারে দেখা হয়। নিজেকে সবার চেয়ে সেরা মনে করা ও জোর করে নিজেকে জনপ্রিয় করে রাখার প্রচেষ্টা থেকে দুনিয়াতে জন্ম হয়েছে ভয়াবহ সব ফ্যাসিস্ট শাসকের।
গণতন্ত্রে নানা মত ও পথের মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে, পপুলারিজম সেই পথকে রুদ্ধ করে দেয়। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার বিভিন্ন কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য টিকে থাকাই কঠিন হয়ে ওঠে। এবং আপাদমস্তক করাপ্ট লোকদেরকে রাজনীতিতে উৎসাহী করে তোলা হয়। পপুলারিস্ট শাসক এর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে নিরাপদ ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে চায়। এর ফলেই রাজনীতিতে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল এবং মেধাহীন, প্রজ্ঞাশূন্য ও অনভিজ্ঞ হুজুগে রাজনীতিকদের প্রবেশ শুরু হয়। এরফলে রাষ্ট্র চলে যায় এক ধরনের ক্লাউনদের দখলে। রাষ্ট্র ও রাজনীতির চারপাশ জুড়ে ক্লাউন ও পলিটিক্যাল টাউটদের ভীড় লেগে যায়। বাংলাদেশেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে অবস্থা বিরাজমান।
পপুলারিস্ট রাজনীতিবিদদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। শিল্প-সংস্কৃতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিজেদের মতো উপস্থাপনের একটা ঝোঁক পপুলারিস্টদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ জনমানসে প্রভাব তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হচ্ছে শিল্প ও সংস্কৃতি। পপুলারিস্টরা এই সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায় না। সমস্যা হচ্ছে, এই মাধ্যমে নিজেদের প্রবল উপস্থিতি তথা নিয়মবহির্ভুত নিয়ন্ত্রণ জাহির করতে গিয়ে তারা শিল্প ও সাহিত্যের প্রকৃত ধরনটাকেই নষ্ট করে ফেলে। প্রকৃতঅর্থেই আমরা সংস্কৃতির যে ধারণাকে বিশ্বাস করি, পপুলারিস্টরা সে ধারায় বিশ্বাস করে না। শিল্পের প্রতিটি ধারায়, যেমন – কবিতা, গান, নাটক, সিনেমাসহ সর্বত্রই ব্যক্তিকে পূজনীয় করে দেখানোর সর্বময় প্রচেষ্টার ফলে শিল্প ও সংস্কৃতির আর প্রকৃত চেহারা অবশিষ্ট থাকে না। আসল সংস্কৃতিকর্মীরা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কিংবা কোণঠাসা হয়ে একসময় হারিয়ে যায়। আবার অনেকে আপস করতে গিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে বাজারি ক্লাউনে পরিণত হয়। মূলতঃ প্রকৃত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের শূন্যতা সৃষ্টি হবার ফলে কেবলই কিছু এন্টারটেইনারের আবির্ভাব হয়। যার ফলে একটি রাষ্ট্রের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠার তৎপরতা ব্যহত হয় এবং কার্যত রাষ্ট্রটি বিকলাঙ্গে পরিণত হয়। পুরো সমাজব্যবস্থা জুড়ে একধরনের অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই মেধা ও সৃজনশীলতার অভাবে রাষ্ট্রের কোনো কার্যক ভূমিকা অবশিষ্ট থাকে না।
মোটা দাগে বলা যায়, পপুলারিজমের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে ভঙ্গুর রাষ্ট্র। তবে এর ফাঁকে একটি অলিগার্ক শ্রেণীর উত্থান ঘটে। পপুলারিস্ট শাসনের মৌলিক দর্শন তথা ব্যক্তিকে পূজনীয় করে তোলার ক্রীড়ানকদের মধ্য থেকে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর মধ্যে ছদ্ম এলিট কাঠামো গড়ে উঠে। অনেকেরই আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখা যায়। অর্থাৎ দুর্নীতি, অপশাসনের বাইরেও রাষ্ট্রের যে কতটা ক্ষতি সাধিত হয় সেটা সাধারণভাবে পরিমাপ করা কঠিন হয়ে পরে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফেদেরিকো ট্যারাগনির মতে, পপুলারিজম বলতে সাধারণত অনুদার, অগণতান্ত্রিক ও অনুভূতিকে পুঁজি করে গড়ে উঠা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ একটি চরমপন্থী বিপ্লবের মাধ্যমে গড়ে উঠা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে পপুলারিস্ট শাসকদের উত্থান ঘটে। এ ধরনের প্রতিটি শাসনব্যবস্থায় একজন বিপ্লবের বরপুত্র আবির্ভুত হন। উক্ত বরপুত্র এবং তাকে ঘিরে থাকা পদলেহী সম্প্রদায় সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে অবলম্বন করে চেতনার পসরা সাজিয়ে বসে। নানা ধরনের স্পর্শকাতর ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে নিজেদের মতো বর্ণনা করে চেতনার বিকিকিনির মাধ্যমে একটি সিস্টেম গড়ে তোলা হয় যেখানে সাধারণত প্রশ্নের কোনো জায়গা অবশিষ্ট রাখা হয় না। নিজেদের ইচ্ছেমতো গড়ে তোলা এই তথাকথিত পুতঃপবিত্র চেতনাকাঠামো ঘিরেই রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোর গঠনতান্ত্রিক বিকাশ ঘটতে থাকে, যা ক্রমান্বয়ে ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
গণতন্ত্রে নানা মত ও পথের মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে, পপুলারিজম সেই পথকে রুদ্ধ করে দেয়। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার বিভিন্ন কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য টিকে থাকাই কঠিন হয়ে ওঠে। এবং আপাদমস্তক করাপ্ট লোকদেরকে রাজনীতিতে উৎসাহী করে তোলা হয়। পপুলারিস্ট শাসক এর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে নিরাপদ ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে চায়। এর ফলেই রাজনীতিতে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল এবং মেধাহীন, প্রজ্ঞাশূন্য ও অনভিজ্ঞ হুজুগে রাজনীতিকদের প্রবেশ শুরু হয়। এরফলে রাষ্ট্র চলে যায় এক ধরনের ক্লাউনদের দখলে। রাষ্ট্র ও রাজনীতির চারপাশ জুড়ে ক্লাউন ও পলিটিক্যাল টাউটদের ভীড় লেগে যায়। বাংলাদেশেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে অবস্থা বিরাজমান।
তবে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের এই ধারণার বিপরীতে আর্নেস্তো ল্যাকলাউ এবং শ্যান্ডাল মৌফী ভিন্ন ধারণা দিচ্ছেন। তারা একটি ‘ডেমোক্রেটিক পপুলারিজম’-এর অস্তিত্বের কথা বলছেন। তাদের মতে, পপুলারিজমের গণতান্ত্রিক এই সংস্কৃতিটি গণতন্ত্রকে পরিশুদ্ধ করার চেতনা থেকে আবির্ভুত হয়। ডেমোক্রেটিক পপুলারিজমে পপুলারিস্টরা নিজেদেরকে জনগণের প্রকৃত ও একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের মতে, কেবল তারাই জনগণের সেবক। তবে এই ‘জনগণ’ সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রেই মূল সমস্যা নিহিত থাকে। তাদের জনগণ কারা – এই প্রশ্নে সর্বব্যাপী ধারণা দিতে তারা অপারগ থাকে। এরফলে সমাজে ‘আমরা বনাম তারা’ ধারণার বিস্তার লাভ করে এবং শ্রেণীবৈষম্য ও বিভক্তির সূত্রপাত ঘটে।
দেখা যাচ্ছে, উভয় ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত পপুলারিজম থেকে ফ্যাসিজমের রূপান্তর ঘটছে। অর্থাৎ যেকোন আঙ্গিকেই পপুলারিজমের আমিময় দুনিয়ায় বাকিরা ব্রাত্য হয়ে পড়ে। ডানপন্থা ও বামপন্থার বিপরীতমুখী পপুলারিজম ধারণার মধ্যে আখেরী মিল এখানেই। অর্থাৎ পপুলারিজম জনগণকে পুঁজি করে ডালপালা বিস্তার করলেও শেষ পর্যন্ত জনগণকে সেই ডালপালায় আশ্রয়দান করতে ব্যর্থ। এ কারণেই মুলার তার হোয়াট ইজ পপুলারিজম বইতে বলছেন, বহুত্ববাদকে অস্বীকার করার প্রবণতাই হচ্ছে পপুলারিজম। ফলে জনগণকে তুষ্ট করার ধারণা থেকে পপুলারিজমের উদ্ভব ঘটলেও শেষ পর্যন্ত এটি সামষ্টিকভাবে গণবিদ্বেষী ফেনোমেনায় পরিণত হয়। এক কথায় বলা চলে, পপুলারিজম যে ছদ্মাবরণ পুঁজি করেই উৎপত্তি লাভ করুক না কেন, তা এক সময়ে গিয়ে ফ্যাসিবাদেই পরিণতি লাভ করে।
আশার কথা হচ্ছে, যেখানে পপুলারিস্টদের আধিপত্য দেখা গিয়েছে, জনগণের তুষ্টিসাধনের বয়ান চালু করে গড়ে উঠা শাসনের ভীত একসময় জনগণের বিদ্বেষের সামনেই মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। তবে জনগণের এই জাগরণের মধ্যেও আবার কিছু ব্যক্তিসর্বস্ব পপুলারিস্ট চরিত্রের উদ্ভব ঘটে। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে অবলম্বন করে এরা নিজেদের হিরোইজম জাহির করার মানসে নতুন মাত্রার পপুলারিস্ট চরিত্রে রূপ ধারণ করে, যেখানে আদর্শ ও দর্শনের কোনো বালাই নাই। এরফলে একটি নব্য পপুলারিস্ট ধারার আবির্ভাবের সম্ভাবনাও থেকে যায়। রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক দর্শনের অনুপস্থিতির কারণে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্ট পপুলারিস্টদের বিপরীতে এসব পপুলারিস্ট চরিত্রের উত্থান আরেকটি রাজনৈতিক সংকটের সূচনা করে। যা অনেক সময় এনার্কির জন্ম দেয়। রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের পথে সমস্যা হিসেবে হাজির হয়।
সুতরাং উচিত হবে, একটি যথাযথ পলিটিক্যাল এজেন্সির মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করা। একটি স্থায়ী সুশাসনধর্মী ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের জন্য জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণের আবশ্যকীয়তা রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন একটি পলিটিক্যাল এজেন্সিকেই এই দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণকেও এর ছায়াতলে এসে দাঁড়াতে হবে। মোটকথা পপুলারিস্ট শাসকের চূড়ান্ত পরিণতি তথা ফ্যসিবাদ থেকে রাজনৈতিক মুক্তির জন্য আদর্শিক ও দার্শনিক দিক থেকে সামাজিক গণআন্দোলন গড়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই।
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia