একটা দেশে হুট করেই ফ্যাসিবাদ কায়েম করা সম্ভব হয় না। তার জন্য সমাজে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার একটা লম্বা সিলসিলা লাগে। ফ্যাসিবাদকে আমরা হুট করে আবিষ্কার করতে পারি তার ক্ষমতা চর্চার ধরণ/লক্ষণগুলোকে দেখে। কিন্তু সেই ক্ষমতা যে সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ঐতিহ্য হিসেবে চর্চা করে তার মধ্যে নিহিত থাকা ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলা আমরা হয়তো খেয়াল করি না। ফলে সব সময় ক্ষমতা চর্চার ধরণ দেখেই আমরা ফ্যাসিবাদকে বুঝতে চাই এবং মোকাবেলা করতে চাই। তাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে ফ্যাসিবাদ পিছিয়ে থাকার কালেও তার সঞ্জিবনী শক্তির অবসান হয় না। সে আবার ফিরে আসে। যা ক্ষতি করার তা করার সুযোগ পেয়ে যায়। কাজেই ফ্যাসিবাদের যে সামাজিক লজিক তৈরি হয় এবং সেটার যে প্রবাহ সাংস্কৃতিক ধারা হিসেবে বহমান থাকে তাকে মোকাবেলা না করলে ফ্যাসিবাদ থেকে পাকাপাকি ভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই ফ্যাসিবাদি রাজনীতি মোকাবেলার আগের ফয়সালার অন্যমত হলো- সাংস্কৃতিক স্তরে ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করা। স্বৈরতন্ত্রের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তখনই সাফল্য অর্জন করতে পারে- যখন আমরা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের প্রশ্নটা গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে পারবো।
মহান দার্শনিক উমবার্তো একো ফ্যাসিজম নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। আমাদের এই লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক কথাটা হলো,
“ফ্যাসিবাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হল ঐতিহ্য পূজা। ঐতিহ্যবাদিতা ফ্যাসিবাদের চেয়েও পুরানা।”
আমরা বলছি আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে তাকে মূলত সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ বলা যায়। আর এই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য ইতিহাসের যে বয়ান বা ন্যারেশন এরা দাঁড় করাইছে তার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে- এটা একটা উপনিবেশী আমলের চিন্তা প্রক্রিয়ার ভেতর তৈরি হওয়া বয়ান। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বলে যে সংস্কৃতির কথা বলা হয় তা হিন্দুত্ববাদি ইতিহাসের প্রকল্পে তৈরি করা টাইম লাইন ধরে আগানোর পরে মূলত এর সবকিছু শুরু হয় ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমল থেকে। তাছাড়া এই বয়ানের মধ্যদিয়ে জাতিকে বিভক্ত করে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের রুচির আলোকে একটি জনগোষ্ঠির সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করা হয়। ফলে কথায় কথায় ঐতিহাসিক সিলসিলার দোহাই দেয়া, ঐতিহ্যের মিথ্যা গর্বে উন্মাদের মতো আস্ফালন করে এরা যে ঐতিহ্যকে গোটা জনগোষ্ঠির উপর চাপিয়ে দিতে চায় তা সবাইকে ধারণ করার বদলে বিভক্তিকে উস্কে দেয়। এবং এই বিভক্তির মধ্যে এরা গায়ের জোরে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি ও জাহির করে যা একটা ফ্যাসিবাদি প্রবণতা। কাজেই এদের ঐতিহ্যবাদিতার মধ্যে সবাইকে যে বাঙালির সুপ্রেমিসি মেনে বাঁচতে হবে- এটার স্পষ্ট ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনটা আমরা দেখি এরা যখন ক্ষমতা চর্চা করে। শেখ মুজিব তার শাসন আমলে সবাইকে বাঙালি হয়ে বাংলাদেশে বসবাসের হুকুম দিয়েছিল। জালেম সরকারের আমলে আমরা সব সময়ে ঐতিহ্যের দোহাই দিতে দেখি। এবং এই ঐতিহ্যবাদিতা যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখবো এদের হাতে বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের যাত্রা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে, নিজেদের ইতিহাসের একমাত্র কর্তা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে। আর এই ঐতিহ্যবাদিতার দোহাই দিয়েই আজকের ডিজিটাল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আরও শক্তিশালী অবস্থায় পৌঁছে গেছে। কাজেই আজকের ফ্যাসিবাদের গোড়া খুঁজতে হবে তাদের ঐতিহ্যবাদিতা ও ঐতিহাসিক বয়ানের মধ্যেই। সেই বয়ানের হাত ধরেই তারা রাষ্ট্র-ক্ষমতার দখল নিতে সক্ষম হয়েছিল।
আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক বিভাজনের সমস্যাটা ১৯৬৫ সালেই মনিষী লেখক আবুল মনসুর আহমদ ধরতে পেরেছিলেন। উনার লেখা,
‘বাংলাদেশের কালচার’ বইটা আজও খুবই প্রাসঙ্গিক। যদিও তখন বাংলাদেশকে পাক-বাংলা বলা হতো। স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম না হলেও সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলো ও সমস্যাগুলো একই রয়ে গেছে। বিস্তারিত আলাপে যাবো না। আগ্রহীরা বইটা পড়ে নিবেন। দরকারী কয়েকটা কথা বলেই শেষ করবো। ১৯৬৫ সালের প্রশ্নগুলো আজও যে সমান প্রাসঙ্গিক রয়ে গেল তার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এর অন্যতম প্রধান একটা কারণ হলো,
আমরা স্বাধীন দেশ বা ভূ-খন্ড পেয়েছি কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতি তৈরি করতে পারি নাই। মানে, একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি আকারে গড়ে উঠতে পারি নাই। আজও এই সমাজ একটা জাতি হওয়ার বদলে মোটাদাগে দুইটা বা কয়েকটা সম্প্রদায়ে বিভক্ত।
আবুল মনসুর আহমদ রাবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন,
“বাংলায় কোন ‘জাতি’ নাই। আছে শুধু হিন্দু-মুসলিম দুইটা সম্প্রদায়।”
এবং বাংলাদেশে পশ্চিম বাংলার শিল্প-সাহিত্যের প্রভাবের মাত্রাটা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আজও কলকাতার অনুকরণের দিকেই একপাল লেখক-শিল্পীদের ব্যাপক আগ্রহ। মূলত ভারতীয় বাঙালির সাংস্কৃতিক উপনিবেশ হিসেবে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতেই এরা কাজ করে যাচ্ছেন। যারা বাঙালি মুসলমান ও তাদের সংস্কৃতিকে জমিদার মাইন্ডসেট থেকে বিচার করে থাকেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেন,
“বাঙালি হিন্দু সাহিত্যিকদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে রসিকতা করিয়া বলিতে শুরু করিয়াছেন যে, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে একটিমাত্র কালচার আছে, তার নাম এগ্রিকালচার।”
তার মানে- আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের সংস্কৃতিকে এরা খুবই অপমানজনক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে। আমাদের কৃষি ঐতিহ্যকে এরা চাষা-ভূষার কালচার মনে করে। এই মানসিকতার সাথে উন্নয়নবাদি ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে কৃষি ও খাদ্য ভাণ্ডার ধ্বংস করে দেশের মানুষকে ভারতের আমদানির উপর নির্ভরশীল করার রাজনৈতিক চর্চার মিল আছে।
অন্যদিকে আজও আমাদের সমাজে সংস্কৃতির প্রশ্নটা কোন না কোন ভাবে হিন্দু- মুসলমানের আত্মপরিচয়ের লড়াইয়ে পরিণত হয়। এর মূল কারণ হলো, বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রশ্নটার সাথে যে সভ্যতার সংযোগ তৈরির চেষ্টা করা হয় তা হিন্দু বা বৈদিক সভ্যতার সূত্র ধরে। ইসলামের বা মুসলমানের সবকিছুকে বহিরাগত মনে করা হয়। ইসলামী সভ্যতার কোনকিছুকে এখনও মূলধারার সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করা হয় না। যদিও এই দেশে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি, কিন্তু সাংস্কৃতিক ভাবে মুসলমানরা মাইনরিটি। সংখ্যায় মেজরিটি। এর উগ্র প্রকাশ আমরা ইসলাম বিদ্বেষী শাহবাগের সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্যে দেখেছি। যেই কৃত্রিম জাগরণ এই ফ্যাসিবাদকে বিপুল শক্তি যুগিয়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াতে হাজির হয়েছে ইসলামপ্রেমি জনতা। এবং যার স্বাভাবিক পরিণতি- সমাজে বিভক্তি আরও চরম আকার ধারণ করা। হয়েছেও তা-ই। বাংলাদেশ শাপলা-শাহবাগে বিভক্ত। যাক সেটা অন্য আলোচনা। এগুলো নিয়ে অন্যত্র বেশ কিছু লেখা লিখেছি।
আমাদের একটা জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করতে হবে। যেহেতু এতোদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে যা কিছু মান্য ও নমস্য ধরা হয়েছে তার রাজনৈতিক এজেন্সি হিসেবে আমরা আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে পেয়েছি ফলে এই রাজনীতির থেকে মুক্তির প্রশ্নের আগে সাংস্কৃতিক ভাবে গণতান্ত্রিক জাতিগঠনের উপযোগি সংস্কৃতির দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণের কোনো বিকল্প নাই।
এই কাজ করার জন্য গভীর চিন্তা ও দার্শনিক সাধনার দরকার। যার ঘাটতি আমাদের আশাবাদি করতে পারছে না। বিখ্যাত তাত্ত্বিক হোমি কে ভাবা তার ‘লোকেশন অব কালচার’ বইতে বৈশ্বিক পরিসরে আত্মপরিচয় নির্মাণের প্রশ্নে সাংস্কৃতিক প্রশ্নের জরুরত নিয়ে বিস্তারিত আলাপ তুলেছেন। আমরা সময় করে এই আলাপে পরে ফিরবো। এখানে প্রাসঙ্গিক হলো- ভাবা মনে করেন, একটা কমিউনিটির মধ্যে যদি ঐতিহাসিক অবদান রাখার বিষয়ে বৈষম্যমূলক মনোভাব থাকে, কাউকে গুরুত্ব দেয়া আর কাউকে অবহেলার ধারা থাকে, ঐক্য তৈরির জন্য মুক্তভাবে মতপ্রকাশের অবস্থা না থাকে বরং বিপুল অনৈক্যকে জিয়িয়ে রাখার জন্য ডিজরেসপেক্ট বা অসম্মান করার প্রক্রিয়া চালু থাকে তাইলে সাংস্কৃতিক প্রশ্নে সংহতি কায়েম সম্ভব হয় না।
এই অবস্থায় শাসনচক্র ‘কালচারাল হাইব্রিডিটি’ বা ‘কালচারাল টেম্পোরালিটি’ মানে নগদ প্রয়োজনে একধরনের ঐতিহ্য আবিষ্কার করে নেয়। আর তাকেই মূলধারা হিসেবে চালু করা হয়। এটারই বাজার তৈরির চেষ্টা চলে। আর এটা করতে গিয়ে সংস্কৃতির জন্য যে নীতি বা কালেকটিভ মোরালিটির দরকার হয় তাকে নানান মিথ্যা গর্ব দিয়ে দিনকে দিন বর্বর করে তোলা হয়।
আমাদের একটা জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করতে হবে। যেহেতু এতোদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে যা কিছু মান্য ও নমস্য ধরা হয়েছে তার রাজনৈতিক এজেন্সি হিসেবে আমরা আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে পেয়েছি ফলে এই রাজনীতির থেকে মুক্তির প্রশ্নের আগে সাংস্কৃতিক ভাবে গণতান্ত্রিক জাতিগঠনের উপযোগি সংস্কৃতির দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণের কোন বিকল্প নাই।
আপনি যদি খেয়াল করেন দেখবেন, আওয়ামী বয়ানের হয় পুরোটা মিথ্যা অথবা সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ। এবং এই বয়ানের ব্যাপারে প্রশ্ন বা ক্রিটিক না তুলে যারা এটাকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছে এরা ননক্রিটিক্যাল ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান’ বা একচোখা মানুষের জন্ম দিয়ে চলেছে। এই একচোখা মানুষের সৃষ্টিশীলতার মাপ কোন ভাবেই মুজিব কোটকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। আর এটাই তাদের গর্ব। কাজেই যারা এটাকে যে কোন লজিকে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এখনও শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছে, এইসবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছে, কালচারাল কনফিডেন্স যুগিয়ে যাচ্ছে- এরা গণবিরোধী ও জনঘৃণার প্রতিকে পরিণত হয়েছে ইতমধ্যে। এতে করে দেশের বেশির ভাগ সংস্কৃতিজীবী, কবি-লেখক নিজেদের সম্ভাবনাকে হত্যা করে ফেলেছেন। শাহবাগে তাদের জানাজা হয়ে গিয়েছে।
এতো দিন যে মূলধারার সংস্কৃতি চর্চার গর্ব আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক ভাবে এগুলা সব ফ্যাসিবাদের ছাতার তলে জড়ো হওয়াতে- গোটা জাতীর জীবনে তৈরি হয়েছে সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক শূন্যতা। এই শূন্যতা কাউন্টার পপুলিজম দিয়ে বা শুধু রাজনৈতিক লড়াই দিয়ে অর্জন করা সম্ভব না। আর সম্ভব হলেও তা ধরে রাখা যাবে না। কারণ, এখনও সাংস্কৃতিক মূলধারা মানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি ধারাই। এবং এই মূলধারা বিশাল কালচারাল ইন্ডাসট্রি গড়ে তুলেছে।
এই বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ আমরা পাই থিওডোল এর্ডোরনো‘র ‘দ্যা কালচারাল ইন্ডাসট্রি- বইতে। আমরা এই ইন্ডাসট্রিকে সহজে বুঝতে পারি এর্ডোরনোর এই বক্তব্য থেকে। তিনি মনে করেন-
সাংস্কৃতিক ইন্ডাসট্রিকে বুঝতে হবে, এটার স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করা বা বিকশিত করার প্রবণতা দিয়ে। এবার বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি এখনকার কালচারাল ইন্ডাসট্রি চরমভাবে জনগণের স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকারের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের পক্ষে কাজ করছে। এমনকি স্বাধীন নাগরিকদের মধ্যে যারা নিজের অবস্থান থেকে গণমানুষের পক্ষে কাজ করতে চেষ্টা করেন। জনগণকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেন তাদের বিরুদ্ধে এদের কাজটা এর্ডোরনোর ভাষায়, ‘ক্রিটিক অব ম্যাস কালচার এজ এ প্রোডাক্ট অব কালচারাল ইন্ডাসট্রি।’ মানে এই সাংস্কৃতিক ইন্ডাসট্রি গণকালচার হিসেবে যাকিছু প্রডিউস করেছে তাকে ক্রিটিক করাই আমাদের কাজ। আর বুদ্ধিজীবীরা এটা করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে জনগণের বিরুদ্ধের এই সাংস্কৃতিক কারখানা খুব সহজেই ফ্যাসিবাদের স্বার্থকে দেখভাল করতে পেরেছে।
মিডিয়ার ভূমিকার দিকে তাকালে এটা আরও স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। মিথ্যার পূজার ফলে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষগুলোর আত্ম-সম্মান মরে গেছে। যেটা আগেই বলেছি আওয়ামী আমলে আমাদের সাংস্কৃতিক মান কোনভাবেই মুজিব কোর্টের মাপের বাইরে যেতে পারে নাই। এই অবস্থায় অন্যসব অঙ্গনের মতোই সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চরম মিডিওকার বা মধ্যমেধার আস্ফালন কায়েম হয়েছে। যা আমাদের চিন্তার দারিদ্রতাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
এবং এমন কন্ডিশনের মধ্যে বিপুল তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে। ফ্যাসিবাদের মিথ্যার সাম্রাজ্যের মধ্যে যে প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে তার কাছ থেকে বিশ্ব -সভ্যতার কাছে উপস্থাপনের যোগ্য সাংস্কৃতিক সৃষ্টি আশা করার সুযোগ নাই। চরম হতাশাগ্রস্ত, আত্মমর্যাদাহীন, ভোটাধিকার বঞ্চিত, অপমাণিত, নারর্সিসাস, প্রযুক্তির আফিমে বুদ হয়ে থাকা ভাইরাল রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠির কাছ থেকে আমরা যেসব সাংস্কৃতিক সৃষ্টি বা উন্মাদনা পাচ্ছি তা জাতীগত ভাবে আমাদের লজ্জার জন্য যথেষ্ট। এর মধ্যে আবার ‘আই হেইট পলিটিক্স’ টাইপের একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। যাদের স্বপ্নই হলো বিদেশে গিয়ে ভালো থাকা-ভালো খাওয়া। এই ট্রেন্ডের মধ্যে বিরল ব্যতিক্রম পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান সেই অবস্থাকে পরিতনের সুযোগ করে দিয়েছে। এই সুযোগকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কাউন্টার মিডিওক্রেসি আরও বিপদ ডেকে আনবে। সাংস্কৃতিক জগরণের জন্য আবুল মনসুর আহমদের কথা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেন,
“মানুষের মর্যাদাবোধই তার কালচারের প্রাণ। তার আত্মশক্তিই ওর শক্তি। এই দুইটা যার নাই কালচারের ব্যাপারে তারা পরগাছা।”
আমাদের অবস্থাও তা-ই হয়েছে। আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তি হারানোর ফলেই ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের মতো একটা দল আমাদের রাজনৈতিক এজেন্সি হতে পেরেছে। এই লম্বা সময়ে আমাদের সব প্রতিষ্ঠান ও বেশির ভাগ ব্যক্তি তার প্রকৃত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে মানে, আত্মশক্তি হারিয়েছে এই ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছে। আর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই শুধু না, আমাদের বেশির ভাগ লোকের সম্মতির মধ্য দিয়েই। লেখক দেবেশ রায় যেমন লিখেছেন,
“যা শোনা হয় তাও ভাষা- খোলা, পরিষ্কার ভাষাতেই ফ্যাসিবাদ ডিম পাড়ে, ফ্যাসিস্ট উপকরণ:
নিরক্ষরতা, অক্ষর বিস্মরণ, শিক্ষা বিস্মৃতি, সেলিব্রিটি, পাবলিক ও সচেতনতা- স্বাধীনতা আমাদের, ফ্যাসিবাদও আমাদের।”
ভূয়া দেশপ্রেম যা মূলত রাষ্ট্র ধবংসের প্রকল্প ছিল, মিথ্যাভরা চেতনা, একদলীয় স্বাধীনতা, শিক্ষার নামে কুশিক্ষা, প্রযুক্তির আরামের প্রতি আকর্ষণ উস্কে দিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতার গর্ব ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়েই আমাদের এই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের বিপুল উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সম্মতিতেই ধীরে ধীরে এমন রক্তহরণকারী হয়ে উঠেছে।
কাজেই আজকে এই ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলার আগে সাংস্কৃতিক প্রশ্নটাকে আমাদের ডিল করতে হবে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-মিডিয়ার মূলধারা বলতে যা বুঝায় তা আওয়ামী ধারা । আর আওয়ামী লীগ বাই ন্যাচার একটা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ধারণ করে ( বাবা-কন্যা মিলে দুই শেখ আমল দেখলে এটা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত)।
মনে রাখতে হবে, এরা যখন রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায় থাকে না তখনও এরাই সাংস্কৃতিক মূলধারা হিসেবে থেকে যায়। শাহবাগের পরাজিত এই শক্তিকে ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলকে ব্যাখ্যা করতে রণজিৎ গুহ যেমন ‘ডমিনেন্সে উইথআউট হেজিমনি’ টার্মটি ব্যবহার করেছেন, আমরাও এদের বেলাতে এটাই বলতে পারি- ক্ষমতাহীন প্রভাব।
রাজনীতি ও ক্ষমতার পার্থক্য ভুলে এরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতির সব রকম মত ও পথকে বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু একটা রাজনৈতিক মতাদর্শকে সার্বজনীন করে তুলবার দিন এখন আর নাই। কিন্তু এরা ট্রাইবাল আমলের মতো শুধু সহমতের লোকদের নিয়েই একটা দেশ গঠন করতে চায়। কিন্তু সেই মতের কোন দার্শনিক ও মতাদর্শিক ক্ষমতাও নাই। কারণ এটার কোন গ্রেটার ভিশন নাই। ছলে বলে ক্ষমতায় থাকা ছাড়া এরা আর কিছু চিন্তা করতে পারে না। আর এই ছলকে জনপ্রিয় করতে, বিশ্বাসযোগ্য করতে ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এরা যখন রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায় থাকে না তখনও এরাই সাংস্কৃতিক মূলধারা হিসেবে থেকে যায়। শাহবাগের পরাজিত এই শক্তিকে ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলকে ব্যাখ্যা করতে রণজিৎ গুহ যেমন ‘ডমিনেন্সে উইথআউট হেজিমনি’ টার্মটি ব্যবহার করেছেন, আমরাও এদের বেলাতে এটাই বলতে পারি। ক্ষমতাহীন প্রভাব। এই নামের বইটার ভূমিকাতেই গুহ বলেছেন এই ক্ষমতাহীন প্রভাবের একটা জাতীয় আসপেক্ট বা প্রেক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশে আমরা এটাই দেখছি। এবং এটাই রাষ্ট্রীয় ভাবে এই ফ্যাসিবাদের বারবার ফিরে আসার সম্ভাবনা জারি রাখে। কাজেই শুধু রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের দিকেই আমাদের মনযোগ থাকলে হবে না। আমাদের ফ্যাসিবাদের এই সাংস্কৃতিক বীজতলাকে পরিষ্কার করতে হবে।
বাংলাদেশের সাংষ্কৃতিক জগৎকে আপনি মোটাদাগে- ভারতীয় বাঙালির কালচারাল কলোনিয়ালিজম হিসেবে পাঠ করতে পারেন।
কাজেই বিভিন্ন দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ মূলত সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য যে ধরনের মতাদর্শগত শক্ত পজিশন লাগে তা বাঙালি জাতীয়তাবাদি নামক কলকাতাপন্থি বা ট্রাইবাল বয়ানে নাই। ফলে এটা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে মূলধারা হিসেবে কায়েম করে এবং তার উপর ভর করেই টিকে ছিল ক্ষমতাশীনরা আর এটাই রাজনৈতিক ভাবে আমাদের পরাধীন করে রেখেছে। এবং ক্ষমতা হারিয়ে এরা তাই পালিয়ে যায়। লড়াই করার মতো নৈতিক বা মতাদর্শগত শক্তি থাকলে গোটা দলকে গণহত্যার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে কেউ পালাতে পারে না। কিন্তু এদের কালচারাল পান্ডারা রয়ে গেছে। কাজেই এই ফ্যাসিবাদের সংস্কৃতিকে বা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পরাজিত করতে পারলে রাজনৈতিক মুক্তিকে রক্ষার পথটা সহজ হয়ে যাবে।
অনেকে আমার এই অবস্থানের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, কিসের সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ? এটাতো সিম্পল লুটপাটতন্ত্র। কথা সত্য। কিন্তু এই গণবিরোধী সাংস্কৃতিক মতাদর্শের রাজনৈতিক এজেন্সি হিসেবে যখন বারবার অবিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগই হাজির হয় তখন এটাকে একটু গুরুত্ব দিয়ে নেয়াই দরকার।
মহান সমাজ চিন্তক পিয়েরো বরদিও উনার ‘দ্যা ফিল্ড অব কালচারাল প্রোডাকশন’ বইতে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন, একটা শিল্পকর্ম বা সৃষ্টিকে শুধু সেই শিল্পকর্ম বা সৃষ্টির আলোকে দেখবার সুযোগ নাই বরং সেটা কি ধরনের সামাজিক অবস্থানের ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে, কারা সেটার টেস্ট, মূল্য, গুরুত্ব বা রিসিপশন নির্ধারণ করছে সেটাও কালচারাল ফিল্ডের প্রোডাকশনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।
ফলে আওয়ামী আমলে চোর করে ডাকাতের বন্দনা টাইপের অবস্থা। ব্রিটিশ আমলে বিকশিত ভারতীয় বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবাদি চিন্তার আলোকে যে সাহিত্য-শিল্প এতোদিন ঢাকাতে রাজত্ব করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের প্রাণস্পন্দন ছিল না। ফলে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি আমাদের সম্মিলিত ঐক্যের বোধ সৃষ্টির চেয়ে বিভক্তি সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবেই বেশি কাজে এসেছে। উপনিবেশি আত্মপরিচয়ের দর্শনের আলোকে তৈরি শিল্প-সংস্কৃতি দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক জাতির সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি তৈরি হতে পারে না।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা মানে তার সাংস্কৃতিক ধারারও পরাজয়- এটাই সাধারণ ভাবে মনে করা হয় কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটে না, কারণ, এখানের সমস্ত ধারণার একটা আওয়ামী করণ করা হয়েছে। বেশি ব্যাখ্যার দরকার নাই। সিম্পল আপনি যদি জিয়াউর রহমান নিয়ে পজেটিভ কথা বলেন আপনি বিএনপির লোক। আর আপনি শেখ মুজিবর রহমান নিয়ে কথা বলার পরেও, আপনি আওয়ামী লীগের লোক হবেন না। আপনি হবেন- নিরপেক্ষ। আওয়ামী ধারার একটা সার্বজনীনতা তৈরি করা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই।
অন্যদিকে আমাদের যা কিছু ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্মিলিত জাতীয় আত্মপরিচয় ও গৌরবের বিষয় হতে পারতো এমন সবকিছুরই আওয়ামী করণের ফলে এখন সাংস্কৃতিক বিষয়-আশয় হিসেবে যা টিকে আছে খুব ব্যতিক্রম বাদে সবই ফ্যাসিবাদের দোস্ত-দোসরে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম মানে শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামই না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণেরও সংগ্রাম। এই এক লেখাতে সাংস্কৃতিক পরিসরের সব প্রসঙ্গ আলোচনা করা সম্ভব হলো না। তবে এই আলাপ আমরা যেন জারি রাখি এটাই প্রত্যাশা।
“মানুষের মর্যাদাবোধই তার কালচারের প্রাণ। তার আত্মশক্তিই ওর শক্তি। এই দুইটা যার নাই কালচারের ব্যাপারে তারা পরগাছা।”
এই বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু আলাপ তুলেই আজকের মতো শেষ করবো। গোটা ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে ৬০ -এর দশকে যে ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার উঠেছিল তাতে সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গটিও গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় মহলে বিপুল গুরুত্ব পেয়েছে। অনেক বিখ্যাত সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক আমরা পেয়েছি সেই সময়ে। তাদের কাজ ধরে ধরে বিস্তারিত আলাপ দরকার। আমাদের অবস্থার পরির্বতনের জন্য সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় চিন্তার রসদ আমরা পেতে পারি।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা মানে তার সাংস্কৃতিক ধারারও পরাজয়- এটাই সাধারণ ভাবে মনে করা হয় কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটে না, কারণ, এখানের সমস্ত ধারণার একটা আওয়ামী করণ করা হয়েছে। বেশি ব্যাখ্যার দরকার নাই। সিম্পল আপনি যদি জিয়াউর রহমান নিয়ে পজেটিভ কথা বলেন আপনি বিএনপির লোক। আর আপনি শেখ মুজিবর রহমান নিয়ে কথা বলার পরেও, আপনি আওয়ামী লীগের লোক হবেন না। আপনি হবেন- নিরপেক্ষ। আওয়ামী ধারার একটা সার্বজনীননতা তৈরি করা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই।
ফলে আওয়ামী লীগ যেহেতু নিজেকে সার্বজনীন মনে করে- তাই ক্ষমতায় গিয়ে তার পক্ষে ফ্যাসিবাদ কায়েম ছাড়া আর কোন অপশনও চিন্তা করার সুযোগ থাকে না। কারণ- তার ধারণার মধ্যেই ফ্যাসিবাদ রয়ে গেছে। কাজেই শুধু লীগের পরাজয়েই মুক্তি আসবে না যদি না পাল্টা সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি করা না যায়। তা হলে- ফ্যাসিবাদের কবল থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত হয়েও নিস্তার পাওয়া যাবে না। নতুন রূপে, নয়া অজুহাতে, ভিন্ন কোন ভিকটিমহুডে গল্প ফেদে তা ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার সংস্কৃতি বলে একক কোন বস্তু নাই। সব কিছু মিলেই সংস্কৃতি। এই লেখকের সাথে এক আলাপে বিখ্যাত সমাজ-মনোবিজ্ঞনী, চিন্তক আশিস নন্দী বলেছিলেন, সংস্কৃতি হলো সালাদের গামলার মতো। সব মিলে, বিভিন্ন আইটেম নিয়েই সালাদ। এই ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যই হলো জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিভক্তি উস্কে দিয়ে স্বৈরতন্ত্র কয়েম করা গেলেও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি আসে না। মুক্তি আসে না।আমরা যখন সংস্কৃতি কথাটা বলছি, তখন একক কোন পারফর্ম আর্টের কথা বলছি না। আমরা দার্শনিক-মতাদর্শিক-ঐতিহাসিক প্যারাডাইম বা পাটাতন নির্মাণের কথা বলছি। যার আলোকে নয়া নয়া সাংস্কৃতিক ফর্ম বা পারফর্ম তৈরি হবে।
১৯৭১ সালে আমেরিকার সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক থিওডর রোসজাক একটা বই লিখেন। বইটার নাম- ‘দ্যা মেকিং অফ এ কাউন্টারকালচার। এই ‘কাউন্টারকালচার’ -শব্দটির প্রচলনকারী হিসেবে ইতিহাসে তার নাম চির স্মরণীয় হয়ে আছে। এই বইটা ধরে এখানে আলাপে যাবো না। যে সাংস্কৃতিক মতাদর্শিক চর্চা বা অবস্থান ভিয়েতনাম যুদ্ধ, অস্ত্র-ইন্ডাসট্রি ইত্যাদির প্রতি জনগণের মনোভাবকে পজেটিভ করে রেখেছিল তার পরির্বতন করা এবং সমাজের মূলধারার এই সাংস্কৃতিক মাইন্ডসেটকে ভেঙে ফেলার জন্য কাউন্টারকালচার ধারণাটার ব্যাপক উত্থান হয়। ৬০ -এর দশকে দুনিয়া ব্যাপি জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের জোয়ারের হাত ধরে তৈরি হয় একদল দুনিয়া কাপানো সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক তাত্ত্বিক।
আওয়ামী লীগ যেহেতু নিজেকে সার্বজনীন মনে করে- তাই ক্ষমতায় গিয়ে তার পক্ষে ফ্যাসিবাদ কায়েম ছাড়া আর কোন অপশনও চিন্তা করার সুযোগ থাকে না। কারণ- তার ধারণার মধ্যেই ফ্যাসিবাদ রয়ে গেছে। কাজেই শুধু লীগের পরাজয়েই মুক্তি আসবে না যদি না পাল্টা সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি করা না যায়। তা হলে- ফ্যাসিবাদের কবল থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত হয়েও নিস্তার পাওয়া যাবে না। নতুন রূপে, নয়া অজুহাতে, ভিন্ন কোন ভিকটিমহুডে গল্প ফেদে তা ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
মার্শালম্যাক লোহান, হার্ভাট মার্কুজ, সুসান সনটগ, মাওসেতুং, চে গুয়েভারা, ববডিলান, এলেন গিনসবার্গ সহ অনেক নাম আমরা পাই এই ধারায়। এদের মধ্যে অনেকের চিন্তাতে মার্কসবাদের প্রভাব থাকলেও এমন অনেকে আছেন যারা মার্কসের প্রতি খুব ক্রিটিক্যালও ছিলেন। এছাড়াও পারফর্ম আর্টের এক এক ধারাতে উত্থান ঘটে বিপুল পরিমাণ নতুন আর্টিস্ট ও কলাকৌশলীদের। এই কাউন্টারকালচারাল মুভমেন্টের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রতিভার সেই ঝিলিক এখনও দুনিয়াকে মাতিয়ে রেখেছে বিভিন্ন সেক্টরে। সেই রাজনৈতিক উত্থান সব জায়গায় সমান সফলতা পায় নাই কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এই কাউন্টারকালচার মুভমেন্ট সংস্কৃতিকে ক্ষমতার অন্ধ দাশে পরিণত করার প্রবণতাকে ধ্বংস করে দিয়ে সরাসরি নতুন এই নির্মাণের পরিমণ্ডলে জনতাকে সংযুক্ত করতে পেরেছে অনেক দেশেই। এটা আমাদেরও পারতে হবে। এই বিজয়ের পরে এটা এখন অন্যতম মূল কাজ।
এখন আমরা বাংলাদেশে ঠিক এমনই একটি সময়ে উপণিত হয়েছি। আমাদের যে সাংস্কৃতিক প্রবাহ গোটা জাতিকে ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত করেছে তাকে মোকাবেলার জন্য কাউন্টারকালচার নির্মাণের লড়াই শুরু করা দরকার। যা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্তরে উপনীত হয়ে রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এটা প্রথমে শুরু হবে দর্শনিক-মতাদর্শিক পাটাতনে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক মিথ্যাগুলোকে গুড়িয়ে দিয়ে নয়া বয়ান হাজিরের মধ্য দিয়ে। আর এতে প্রতিটি সেক্টরে বিকশিত হবে একঝাক নতুন প্রতিভার। এই প্রতিভার জন্মেরও বড় অন্তরায় এই একচোখা ফ্যাসিবাদি ধারার মূল ধারা হিসেবে চেপে বসা। কাজেই চারদিকে এখনও ফ্যাসিবাদি আগ্রাসন দেখে হতাশ হলে চলবে না। মহান দার্শনিক আগামবেন আমাদের জানিয়েছেন, ‘থট ইজ দ্যা কারেজ অব হোপলেসনেস’। চিন্তাই এই হতাশ অবস্থা কাটিয়ে উঠবার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে সক্ষম।
তবে, কাউন্টারকালচার ঘরে বসে বসেই করা যাবে এমন না। এটা সরাসরি মাঠের লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই হাজির হতে পারে। মোট কথা এই ফ্যাসিবাদ মোকাবেলার আগের ফয়সালা হিসেবে কাউন্টারকালচার নির্মাণের প্রশ্নটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। তাহলেই রাজনৈতিক লড়াই শক্ত ভিত্তি পাবে। রাজনৈতিক ও মানসিক উভয় ধরণের মুক্তির পথ সহজ হবে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অতি সংক্ষেপে কিছু কৌশলগত দিক ভেবে দেখতে অনুরোধ করি:
ক.
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলেই, ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ছিলেন, বরেণ্য লেখক, কবি, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। তিনি সেই সময়ই ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংস্কৃতি কমিশন’ গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। যা পরে এরশাদ আমলে গঠিত হয়। দেশের সেরা মেধাবীদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তাদের একটি বিস্তারিত প্রস্তাবনা ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়। ২০০ পাতার এই প্রতিবেদন পরে ২০০৫ সালে বই আকারে প্রকাশ করেন সৈয়দ আলী আহসান ফাউন্ডেশন, বইটার প্রকাশক- ঐতিহ্য। এই লেখায় সেই প্রতিবেদন থেকে কোন প্যারা তুলে দিচ্ছি না। বরং গোটা প্রতিবেদনটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেদনে সংস্কৃতির প্রতিটি দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে সেই প্রতিবেদনের আলোকে এমন একটি প্রতিবেদন/প্রস্তাবনা তৈরি করে তারপরে সরাসরি কাজে নেমে গেলে এই সেক্টরের অচলাবস্থার অবসান সম্ভব। প্রতিবেদনটি ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি’-সৈয়দ আলী আহসান -এই শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়ে কাজে আগ্রহীদের এটা পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি।
তবে বর্তমানের চলমান সংগ্রামের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আরও কিছু পয়েন্টের দিকে মনযোগ ফিরিয়ে এই লেখা শেষ করছি-
১. রাজনৈতিক প্রতিরোধ বা গণআন্দোলনের পাশা-পাশি ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করা দরকার। এতোদিনের ফ্যাসিবাদি শাসনে দেশের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মির রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এবং আমরা দেখেছি মুষ্টিমেয় কিছু লোকবাদে সবাই এই ফ্যাসিবাদের সঙ্গি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে যার যার অবস্থানে থেকে। অনেকে সরবে ভূমিকা পালন করেছে অনেকে নীরবে সুবিধা নিয়েছে। এখন ক্ষমতার পরির্বতন হওয়ার আওয়াজ উঠতে শুরু করার সাথে সাথে এদেরই একটা অংশ নিজেদের পুরোপুরি পাল্টে নিতে শুরু করবে। চিন্তা বা মতাদশের অবস্থান একই রেখে শুধু সুবিধার জন্য নতুন ক্ষমতাসীনদের সাথে মিশে যাবে। এবং এদের কাছ থেকেই সুবিধা নিয়ে -এই ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধ স্রোতের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে শক্তি যোগাতে থাকবে। এবং যেকোন দুর্বল মুহূর্তে এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি চক্রের পারপাস সার্ভ করতে বিলম্ব করবে না। কাজেই এই দল পরির্বতন করে সুবিধার সুযোগ বন্ধ করার জন্য সংস্কৃতির প্রশ্নেও কে ফ্যাসিবাদের পক্ষে আর কে বিপক্ষে -এমন একটা পরিষ্কার হিসেব যাতে সহজে পাওয়া যায় তাই একটা সাংস্কৃতিক গণ-আন্দোলনে তাদের ভূমিকার মূল্যায়নের কোন বিকল্প নাই। এই ক্ষেত্রে শাহবাগ একটি বড় কষ্ঠিপাথর হতে পারে।
২. গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে, গণতান্ত্রিক চিন্তা ও মতাদর্শকে মূলধারা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। গত দেড় দশকে দেশে একদলীয় ফ্যাসিবাদী বয়ান মূলধারার মিডিয়াতে প্রচারের ফলে সামাজিক স্তরে ও নতুন প্রজন্মের চিন্তার মধ্যেও ফ্যাসিবাদের বয়ানই প্রভাব বিস্তার হয়ে রয়েছে। এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আন্দোলনের ম্যধমে শিক্ষার চেয়ে কার্যকর শিক্ষা আর নাই। অল্প সময়ের মধ্যেই কাউন্টারকালচার নির্মাণেূ আন্দোলন জরুরী।
৩. রাষ্ট্রীয় যে সকল প্রতিষ্ঠান শিল্প ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য তৈরি করা হয়েছে সেইসবের নীতি ও কর্ম-কৌশলগত পরির্বতন নিয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। যারা লুটপাটের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছে তাদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়টিও জরুরী। যাতে আগামী দিনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক জাতীয় সংস্কৃতি নির্মানের সহায়ক হতে পারে।
৪. প্রকৃত প্রতিভাবানদের যে কোন মূল্যে সমানের সারিতে আনতে হবে। দেশের সাংস্কৃতিক কর্মিদের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানে পৌছার মনোভাব তৈরি করতে হবে। দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বিশ্বমানের সৃজন প্রক্রিয়াতে যুক্ত হওয়ার উদার পরিবেশে স্বাধীন ভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিভার বিকাশের সকল বাধা দূর করতে হবে।
৫. সাংস্কৃতিক ইন্ডাসট্রির মাফিয়াদের হঠাতে হবে। মিডিয়ার জন্য নীতিগত ভাবে জনবান্ধব পলিসি নিতে হবে। মিডিয়ার গণবিরোধী ভূমিকার জন্য প্রতিষ্ঠান ও চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৬. শুধু শহরে নয়। গ্রামে সাংস্কৃতিক চর্চার ধারাকে শক্তিশালি করতে হবে। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বাংলাদেশের সব ধরণের বা সবার সংস্কৃতিই জাতীয় সম্পদ হিসেবে গুরুত্ব পাবে।
৭. শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে গ্রাম-শহর বৈষম্য, পুরস্কারের সিন্ডিকেট ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নামে গোষ্ঠিবাদি এলিটিজম দূর করতে হবে। পুস্তক ও প্রকাশনা শিল্প বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে। বহু ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্প-সাহিত্যের নামে লুটেরা শ্রেণীর ধান্ধাবাজি প্রতিহত করতে হবে, প্রতিটি সেক্টরে স্বচ্ছতা নাতে হবে।
রাজনৈতিক লড়াই যদি চিন্তা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি অর্জনের দিকে আমাদের ধাবিত করতে পারে তবেই আমরা প্রকৃত বিজয় অর্জনের দিকে যেতে পারবো। এটা পারতেই হবে। এটাই আমাদের এখন জরুরী কাজ।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে জবানের ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ’ সংখ্যায়। সামান্য পরিমার্জন করে জবানের পাঠকদের জন্য অন লাইনে আপ করা হলো)
সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।
মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
https://paypal.me/jobanmedia