Joban Magazine  ক্ষমার দর্শন

  ক্ষমার দর্শন

“forgiveness forgives only the unforgivable.”

-Derrida.

কে না জানেন, ক্ষমা মহৎ গুন। কিন্তু মহত্ব চর্চা করা খুব সহজ না। বা ক্ষমার মাধ্যমে যে ধরনের মহত্ব অর্জন করা যায়, তাতে সবসময় ন্যায় বা জাস্টিস কায়েম হয় না। মোট কথা এই মহৎ বিষয়টিকে আমরা এতদিন যতটা হাল্কা চালে ভেবে এসেছি বিষয়টা মোটেও তেমন না। দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিসপূর্ব কাল থেকে এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার শুরু হয়েছে। অবশ্যই এই বিষয়ে প্রাচীন চিন্তার হদিস আমরা পাই বিভিন্ন ধর্ম মারফত। এই অতি জরুরি ও জটিল আলোচনাকে আমরা এই লেখায়- মূলত একজন দার্শনিকের চিন্তাকে ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবো। প্রসঙ্গ ক্রমে অন্যদের কথা আসবে তবে আমরা মূলত এখানে এই বিষয়ে দেরিদার চিন্তার গুরুত্বটা বুঝতে চেষ্টা করবো। দেরিদার চিন্তার সূত্র ধরে আলাপটা আগালে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে এই চিন্তার ব্যবহারিক গুরুত্বটাও খানিকটা ধরতে সক্ষম হব-এমন একটা আশাকে আমলে নিয়ে আমরা আলোচনায় প্রবেশ করছি।

১.

“Forgiveness is nothing less than the way we heal the world. We heal the world by healing each and every one of our hearts. The process is simple, but it is not easy.”
-Desmond Tutu.

জ্যাক দেরিদা বিপুল কাজের মধ্যে ক্ষমা নিয়ে যে কাজগুলো করেছেন তার বিস্তারতি আলাপ এক লেখাতে করা সম্ভব না। একটা বই-ই লিখতে হবে। দেরিদা অন্য অনেক কাজের জন্য খুব বেশি পরিচিত কিন্তু এই বিষয়ে উনার চিন্তার দিকগুলো নিয়ে বাংলা ভাষাতে লেখা-লেখি তেমন একটা হয় নাই। তিনি জটিলতা, দুর্বোধ্যতা এবং তাঁর ডিকনসট্রাকশন (যার বাজে বাংলা অবিনির্মাণ করা হয়েছে) -এই সবের জন্য আমাদের দেশে বুদ্ধিচর্চার মহলে পরিচিত। ক্ষমা নিয়েও তিনি ডিকনসট্রাকশন পদ্ধতিতেই তর্ক তুলেন।

ডিকনসট্রাকশন কী? বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। এক কথায়- এটা একটা চিন্তা পদ্ধতি। সংক্ষেপে এটা এভাবে বলতে চেষ্টা করা যায়- আমরা যেমন, ভালো-মন্দ, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে একটা আর একটার বাইনারি দিয়ে বা সাপেক্ষে বুঝে থাকি তার মধ্যে দুইটার কোনোটাকেই প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারা যায় না। ডিকনসট্রাকশন শব্দ, ভাষা, রচনা বা যেকোনো কিছুকে ভেঙে সেটার আদি, অকৃত্রিম ও প্রকৃত স্বরূপে মানে আসল এসেন্স -ধরতে চেষ্টা করে। নিৎসে হয়ে হাইডেগারের চিন্তার সূত্র ধরে দেরিদা এই পদ্ধতিতে পৌঁছেছেন। ফলে ডিকসট্রাকশন বলতে আমরা বুঝতে পারি কোনো কিছুর ট্রথ/প্রকৃত সত্য স্বরূপ বা এসেন্স/মর্মতে পৌঁছানোর জন্য অবিরাম নির্মাণের এক প্রক্রিয়া। দর্শনের আলোচনায় অনেক সময় দেরিদা ও ডিকনসট্রাকশনকে একাকার মনে করা হয়। যদিও কোনোদিন দেরিদা নিশ্চিত-নির্দিষ্ট করে ডিকনসট্রাকশনের সংজ্ঞা দেন নাই। কিন্তু তার কাজে তিনি এটা করে দেখিয়েছেন। নানানভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পণ্ডিতরা এখানে পেশ করা ব্যাখ্যার সরলিকরণে অবাক হতে পারেন কিন্তু সাধারণ পাঠকের কথা চিন্তা করে এর চেয়ে জটিলভাবে লেখা ঠিক হবে না-মনে করি।

এখানে খুব জটিল আলাপে না গিয়ে বরং তাঁর ক্ষমা বিষয়ক চিন্তা ও কাজগুলোর সাথে একধরনের পরিচয় যেন আমাদের ঘটে সেই চেষ্টাই থাকবে। যাতে করে আমরা আরও অগ্রহী হয়ে উনার মূল কাজের দিকেই মনোযোগ ফেরাতে পারি। ক্ষমা বিষয়ে দেরিদার চিন্তার সবচেয়ে বিস্তারিত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই– ‘On Cosmopolitanism and Forgiveness’ (Routledge, 2001) -এই ছোট বইটার মধ্যে। জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত এটাই ক্ষমা বিষয়ে উনার মূল কাজ। এই বিষয়ে জরুরি প্রশ্নগুলো মূলত এখানেই তিনি পর্যালোচনা করেছেন।

তাছাড়াও দেরিদা তাঁর সারা জীবনে শিক্ষকতার প্রয়োজনে হাজার হাজার পৃষ্ঠার লেকচার নোট নিয়েছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি শুধু ফ্রান্সেই বিভিন্ন লেকচার ও ক্লাস নেয়ার জন্য যেসব নোট নিয়েছেন তা প্রিন্ট পৃষ্ঠা হিসেবে ১৪ হাজার পৃষ্ঠার উপরে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে সেইসব নোট সম্পাদনা করে বিভিন্ন নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তেমনি ক্ষমা বিষয়েও একটি বই ২০১৯ সালে ফরাশি ভাষায় প্রকাশিত হয়। বইটার নাম,  Le parjure et le pardon, পরে ২০২২ সালে বইটার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় শিকাগো ইউনিভাসিটি প্রেস থেকে Perjury and Pardon –নামে। 

 

তিনি আইন ও বিচারকে আলাদা করে দেখান। আইনকে তিনি দেখেন, একটি অনুশাসন/ রুলস বা পদ্ধতি হিসেবে। অন্যদিকে জাস্টিস বা ন্যায় নিশ্চিতভাবেই একক রুলস ও পদ্ধতির বাইরের জিনিস।

 

এছাড়া দেরিদার ক্ষমা বিষয়ক কাজের ওপর ভিত্তি করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও বই-পত্র লেখার কাজ সারা দুনিয়াতেই জারি আছে। সেইসব বইয়ের সূত্র ধরে এখানে আলোচনার সুযোগ নাই। আমরা মূলত দেরিদার কাজকে সামনে রেখেই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক কতকগুলো প্রশ্নকে বুঝতে চেষ্টা করবো।

অন্য অনেক চিন্তক ও দার্শনিকের মতো দেরিদার চিন্তা-জিবনকেও দুইটা ভাগে ভাগ করা যায়। একটা তার উত্থান পর্ব বা প্রথমিক পর্যায়ের কাজ দিয়ে। আর দ্বিতীয় পর্বে, শেষ দিকে মানে ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার আগের বিশ বছরে তিনি যে প্রচুর কাজ করেছেন সেই সময় পর্বকে শেষ পর্যায়ের দেরিদা, বা ইংরেজিতে যেটাকে বলে লেট দেরিদা। শেষ দিকের কাজে তিনি যে শুধু অনেক বেশি হাইডেগারের দিকে মনযোগি হয়েছিলেন তাই নয়। বরং শুধুমাত্র দার্শনিক পদ্ধতীমূলক জটিল তাত্বিক চিন্তার চেয়ে ব্যবহারিক প্রয়োজনের দিক থেকে জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে উঠেছিলেন। যাকে প্র্যাকটিক্যাল ফিলোসফি বলা যায়। ক্ষমা বিষয়ে দেরিদার পর্যালোচনাকে দেরিদার শেষ জীবনের চিন্তা-ভাবনার বিষয় হিসেবেই দেখা হয়। যদিও ১৯৮৯ সালে তিনি খুবই আলোচিত, ‘ফোর্স অব ল’ নামক একটি প্যাপার/প্রবন্ধ এক সেমিনারে উপস্থাপন করেন। এই প্রবন্ধে তিনি আইন ও বিচারকে আলাদা করে দেখান। আইনকে তিনি দেখেন, একটি অনুশাসন/ রুলস বা পদ্ধতি হিসেবে। অন্যদিকে জাস্টিস বা ন্যায় নিশ্চিতভাবেই একক রুলস ও পদ্ধতির বাইরের জিনিস। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে দেখা যাবে- এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষমা/ফরগিভনেস বিষয়টাকে তিনি তাঁর ভাবনায় অন্তর্গত করেন জীবনের শেষ দিকের কাজে।

১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে প্যারিসে দেরিদা একটি সেমিনারে হাজির হন। সেখানে তিনি একটা সেশনে আলোচনা করেন। সেটার নাম ফরাসিতে ‘Questions de re-sponsabilité: le parjure et le pardon’ -এখানেই তিনি ক্ষমার দর্শন নিয়ে তাঁর চিন্তার প্রাথমিক আবিষ্কারটা প্রকাশ করেন। এর পরে ২০০১ সালে আলোচনার বিষয়গুলো ধরে ছোট পুস্তিকা আকারে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়- ‘On Cosmopolitanism and Forgiveness’ নামে। অবশ্য ১৯৯৭ সালে তিনি জেরুজালেমে আলাদা করে ‘অন ফরগিভনেস’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা করেন। এবং দেখা যায়,  ২০০১ সালে ‘To Forgive: The Unforgivable and the Imprescriptible’ -নামেও একটা প্রবন্ধ লিখেন যা পরে, ‘Questioning God’ –নামের একটি সংকলনে নেয়া হয়। দেরিদার জেরুজালেম বক্তৃতা সেই সময়ে চিন্তক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। জেরুজালেম থেকে ফিরে তিনি একটা টিভিতেও এই বিষয়ে কথা বলেন। যার কিছু কিছু ক্লিপ এখনও নেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। On Cosmopolitanism and Forgiveness’ –বইয়ে যে বিষযগুলো তিনি আলোচনা করেছেন সেগুলার সাথে অন্যত্র লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ ও বক্তৃতার অনেক জাগয়ায় বক্তব্যের বেশ মিল পাওয়া যাবে। এই বিষয়ে এত বিস্তারিত লেখার উদ্দেশ্য হলো– যাতে আগ্রহী পাঠক মূল লেখাগুলো সহজেই খুঁজে পড়তে পারেন এবং আরও গভীরভাবে  মনোযোগ দিতে পারেন –এই চিন্তার ধারাকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখতে পারেন।

On Cosmopolitanism and Forgiveness’ –লেখাতে এক ভিন্ন দেরিদাকে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি খুব সরলভাবে ক্ষমার বিষয়টা নিয়ে তার চিন্তা বিস্তার করতে শুরু করেন। ক্ষমা করার প্রক্রিয়া সিম্পল/সাধারণ কিন্তু সহজ না- ড. টুটুর কথাটা মনে রাখলে সহজেই দেরিদার চিন্তার দিকে আগানো সম্ভব হবে। যদিও টুটুর ক্ষমাকে রিকনসিরিয়েশন হিসেবে দেখবার পদ্ধতির ব্যাপারে দেরিদা খুব জোর আপত্তি তুলেছেন। তবে ক্ষমার সাথে ট্রুথের সম্পর্ক নিয়ে দেরিদা এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেন নাই। কিন্তু ক্ষমাকে ট্রুথফুল করে তোলার জন্যই তিনি কলম ধরেছেন– এটা পরিষ্কার। এই বিষয়ে অন্য সময়ে বিস্তারিত আলাপের ইচ্ছে রইলো।

ক্ষমা বিষয়টি কীভাবে আমাদের চিন্তা-ভাবনায় বিস্তার লাভ করতে থাকে তা দেখাতে তিনি শুরুতেই জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অতীতের আচরণের জন্য চীন ও কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ হাজির করেন। এবং তিনি দেখান সবকিছু ছাপিয়ে ক্ষমা কীভাবে এই ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে পুরো দৃশ্যপট দখল করে ফেলে। এবং এই ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা যে একটা রাজনৈতিক বাকোয়াজি/রেটরিক সেটাও বেশিরভাগ সময়েই আড়ালে পড়ে যায়। আলজেরিয়াতে ফ্রান্স যা করেছে তার জন্য তিনজন ফরাশি প্রেসিডেন্ট ক্ষমা চেয়েছেন। রাজনীতিবিদরা ‘ ক্ষমা’কে বিশেষ করে এই ধরনের সাধারণ ক্ষমা/এমনেস্টিকে অনেক সময় জাতিগত ঐক্যের প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। দেরিদা মনে করেন, যে বা যারা এই ধরনের সাধারণ ক্ষমা বা এমনেস্টি প্রস্তাব করেন, তার/দের বিবেচনায় অনেক ধরনের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থাকে। এর সাথে খোদ ‘ক্ষমার’ কোনো সম্পর্ক নাই। ক্ষমা কখনোই সংহতি তৈরির একটা টনিক হতে পারে না। তিনি মনে করেন-

‘Forgiveness does not, it should never, amount to a therapy of reconciliation.’

তাই বলে মনে করার কোনো কারণ নাই যে, তিনি যেকোনো ধরনের পুনঃমিলনের বা রিকনসিলিয়েশনের বিরুদ্ধে। তিনি যেটাতে গুরুত্ব দিচ্ছেন তা হলো, এই যেকোনো সমন্বয়বাদী উদ্যোগ আর খোদ ‘ক্ষমা’ এক জিনিস নয়। একটা দিয়ে আর একটাকে রিপ্লেস করা ঠিক না। ক্ষমা জিনিসটা আলাদা। মিহাইল ইভান্স ঠিকই ধরেছেন। ক্ষমার বিষয়টা আলোচনা করতে গিয়ে এর দার্শনিক দিক উম্মোচনের আগে দেরিদা দুইটা বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছেন।

ক. গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন

খ. ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি বা মানবতাবিরোধী আপরাধ।

এই দুটো বিষয়ের সাথে ক্ষমার সম্পর্ককে কীভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে তা দেখতে পারা খুবই দরকারী সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষিতে।

ক.

বিশ্বায়ন ধারনাটা দেরিদা অন্যান্য নানান কাজে খুব ক্রিটিক্যালি ব্যবহার করেছেন। ক্ষমার বিশ্বায়ন ধারণাটা বুঝতে গিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেন ক্ষমার ঐতিহাসিক সিলসিলার দিক থেকে। অবশ্যই প্রচীন দর্শনে এই বিষয়ের হদিস আছে। সক্রেটিসের আগের আমলের দর্শনেও আছে। কিন্তু দেরিদা তারও আগে যান। দেরিদা আব্রাহাকিম ধর্মের ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেন। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের হেরিটেজে বা ঐতিহ্যে ক্ষমার ভূমিকা দেখা যায়। কিন্তু পশ্চিমা দর্শন ও রাজনীতির প্রকল্প হিসেবে ক্ষমাকে যখন হাতিয়ার করা হয়, অপরাধ স্বীকার করা, বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি বা মানুষের ভুলের প্রাশ্চিত্ত করার একটা প্রক্রিয়া আকারে ক্ষমাকে নেয়া হয়, তখন ক্ষমা ধারণার একটা খ্রিস্টানীকরণ করা হয়। বলাই বাহুল্য, যদিও আব্রহামিক সব ধর্ম ঐতিহ্যে ক্ষমার বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানও লক্ষ করা যায়, এগুলোর প্রতিটি ধারাতে ক্ষমার বিষয়টি কীভাবে হাজির হয়েছে তা নিয়ে আলাদা কাজ হতে পারে। কিন্তু সব ছাপিয়ে ক্ষমার এই যে খ্রিস্টানীকরণ রূপ আমরা দেখতে পাই তা ক্ষমার বিশ্বায়ন ঘটিয়ে ছেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে, জাপানি প্রধানমন্ত্রী যখন চীন ও কোরিয়ার কাছে অতীত কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন সেই ঘটনার উল্লেখ করেছেন দেরিদা। এরা অপশ্চিমা হয়েও ক্ষমার পশ্চিমা রীতিই চর্চা করেছেন। এই প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সেন্ট অগাস্টিনের কনফেশন বা স্বীকার-উক্তির কথা। নিজের পাপ বা অপরাধের স্বীকার উক্তি চার্চের কাছে প্রদানের মাধ্যমে আত্মগ্লানিমুক্ত জীবনের দিকে ফেরার যে প্রচেষ্টা -সেই ঐতিহ্য খ্রিস্টান সমাজে খুবই পরিচিত। পুরানা আমলে ব্যক্তির পাপের জন্য চার্চকে দক্ষিণা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে মানুষ অপরাধের গ্লানী থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করতো।

 

একটি ধারণা হিসেবে ‘ক্ষমা’ যা, আর আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে ক্ষমার যে রূপান্তর এর মধ্যে যে আকাশ পাতাল ফারাক আছে সেই প্রসঙ্গ ও প্রশ্নের বিলয় ঘটে যায় এই পরিমণ্ডলে। মানুষের অধিকার বা খোদ মানুষের ধারণার যে নির্মাণ আমরা এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দেখতে পাই তাতে অপরাধের সংজ্ঞা দেয়ার যে আইনি বৈধতা এই ধরনের কাঠামো অর্জন করে সেটাও প্রশ্নাতীত নয়।

 

খ্রিস্ট বিশ্বাসের সাথে পাপ ও স্বীকার-উক্তির সম্পর্ক খুবই গভীর। এবং ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যদিয়ে এক বিনয়ী নম্র অপরাধীর মতো জীবনযাপন করে শুধু প্রভুর করুণার যোগ্য হয়ে ওঠার শিক্ষা খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্যে খুবই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এই ধারাটাকেই পশ্চিমা দর্শনে প্রথম মনে হয় অগাস্টিনই চার্চের বাইরে চিন্তা ও সমাজ জীবনের দার্শনিক প্রত্যয়ের মধ্যেও বিবৃত করেন। দেরিদা যদিও অগাস্টিন নিয়ে কোনো কথা বলেন নাই এই লেখায়। তিনি সাধারণভাবে এই প্রবণার দিকে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেই উদাহরণ হলো, এই খ্রিস্টীয় ক্ষমার ঐতিহ্য ধরে ক্ষমা চাইতে দেখা যাচ্ছে এশিয়ার জাপানী প্রেসিডেন্টকেও। ফলে দেখা যাচ্ছে ক্ষমা ধারণার বিশ্বায়ণ হয়েছে পরে, আগে এই ধারণার খ্রিস্টীয়করণ হয়েছে। খ্রিস্টীকরণের ধারাবাহিকতায় আজকে ক্ষমাকে একটা বিশ্বায়িত প্রকল্প হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। চার্চ ছাড়াই ক্ষমার এই যে খ্রিষ্টীকরণ তা যখন কোন দেশে বা কোন কমিউনিটির মধ্যে দেখা যায় তখন যে সমস্যাটা হয় তা হলো–গোটা দুনিয়া পশ্চিমা খ্রিষ্টীয় দুনিয়া না। তার অপশ্চিমা দুনিয়ার ইউনিক বা স্বাতন্ত্র্যকে পাশ কাটিয়ে যে খ্রিষ্টীয়করণ চর্চা করা হয় তাতে খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্যের নর্ম বা রীতি বজায় থাকলেও ক্ষমার হক আদায় হয় না। ক্ষমার বিশ্বায়িত বা সার্বজনীন রূপ বলে যে জিনিসকে দেখতে পাওয়া যায় তার প্রাণ শাঁস খ্রিষ্টীয়। তাতে খোদ ক্ষমার এসেন্স বা মর্ম গড় হাজির। মনে রাখতে, দুনিয়া মানেই খ্রিষ্টীয় দুনিয়া না। কিন্তু বৈশ্বয়িক ক্ষমা মানেই একটা খ্রিষ্টীয় ব্যাপার। ফলে দেরিদার এই ক্রিটিকটা পশ্চিমা চিন্তা-দর্শন ও রাজনীতির জন্য অস্বস্তিকর হলেও একটা রাজনৈতিকভাবে বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আজকের দুনিয়ায়।

খ.

মানবতাবিরোধী অপরাধের আলোকে ক্ষমার যে চিত্র আমাদের সামনে উদাম হয় তার বহুমাত্রিকতা লম্বা আলাপের দাবি রাখে। সহজ ও সংক্ষেপে বিষয়টা এখানে আলোচনা করার চেষ্টা করা যাক। প্রথমেই দেখা যাচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তির বিষয়টা আইনের আওয়তায় চলে যায়- এটা আমরা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন দেশে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ক্ষমার আলোচনাটাও যখন এই পরিসরে ওঠে তখন ক্ষমাও একটা জুরিডিকশন বা আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে ওঠে। একটি ধারণা হিসেবে ‘ক্ষমা’ যা, আর আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে ক্ষমার যে রূপান্তর এর মধ্যে যে আকাশ পাতাল ফারাক আছে -সেই প্রসঙ্গ ও প্রশ্নের বিলয় ঘটে যায় এই পরিমণ্ডলে। মানুষের অধিকার বা খোদ মানুষের ধারণার যে নির্মাণ আমরা এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দেখতে পাই তাতে অপরাধের সংজ্ঞা দেয়ার যে আইনি বৈধতা এই ধরনের কাঠামো অর্জন করে সেটাও প্রশ্নাতীত নয়। তিনি আইন ও বিচারকে আলাদা করে দেখান। আইনকে তিনি দেখেন, একটি অনুশাসন/ রুলস বা পদ্ধতি হিসেবে। অন্যদিকে জাস্টিস বা ন্যায় নিশ্চিতভাবেই একক রুলস ও পদ্ধতির বাইরের জিনিস। তাছাড়া এই ধরনের মানবতাবাদের ধারণার দার্শনিক সমস্যা রয়েছে। আগ্রহীরা এই বিষয়ে হাইডেগারের ‘লেটার অন হিউম্যানিজম’ লেখাটা দেখতে পারেন। অন্যদিকে একটা কমিউনিটি বা একজন ব্যক্তির প্রতি অপরাধের মাত্রা বা শাস্তি যখন এই ধরনের কোনো বিমূর্ত আইনি-কাঠামো ঠিক করে দেয় তাতে জাসস্টিস বা ন্যায় বা ইনসাফ কায়েম হওয়ার সুযোগ কম। হিউম্যানিটি বা মানবতা -ধারণার পশ্চিমা যে নির্মাণ যা সর্ব দুনিয়ার জন্য সত্য ধরে নিয়ে বিচার কমিশন গঠন ও সেখানে ক্ষমার প্রশ্নটিকে অন্যদের পক্ষ থেকে একটা কতৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারণের যে আয়োজন তার সাথে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের বিরোধও থাকতে পারে। তাছাড়া এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে গোলমেলে- বিচার, শাস্তি এগুলার পাশাপাশি যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো, রিকসিলিয়েশন বা জাতিগত ঐক্যকে সমুন্নত রাখার রাজনৈতিক প্রয়োজন। ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রশ্ন বাদ রেখে মানবতার খাতিরে ক্ষমার যে, থিয়েট্রিক্যাল বা নাটকীয় পরিবেশন তার সাথে জনগোষ্ঠীর ঐক্য, রাজনৈতিক স্থিতি অর্জনের সম্পর্কই মূল ফোকাসে থাকে, ক্ষমটা তখন হয়ে যায় উপলক্ষ্য মাত্র। এখানে আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষমার দিকটি নিয়ে কথা বলছি। বিচারের দিকটির বহু ক্রিটিক আছে । সেগুলা আমাদের আলোচ্য নয়। তবে এই ধরনের কাঠামোর একটা স্ববিরোধ হলো, যে ব্যক্তি অপরাধী সেও তো মানুষ। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের কাঠগড়ায় যখন তাকে হাজির করা হচ্ছে তখন তার ‘মানুষ’ পরিচয়ের বিলয় ঘটিয়ে কেবল একজন বা একাধিক অপরাধী হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। যদিও সক্রেটিসের মত হলো- অন্যায় করলে মানুষের আত্মা মরে যায়। সেই দিক থেকে অপরাধী হিসেবে হাজির হওয়ার আগেই, অন্যায় করার সাথে সাথেই মানুষ হিসেবে তার বিলয় ঘটে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ঘটছে বিচারকের কাঠগড়ায় এসে। মানে, যে সার্বজনীন মানবতার নীতির আলোকে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান গঠন হলো তাতে অপরাধী মানব সন্তানকে ধারণ করা যাচ্ছে না। তার পরে দেখা যায়, ভিকটিমের পক্ষে বিচার বা ক্ষমার ফয়সালা করেন জুরি যা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মনোভাবকে পুরোপুরি রিপ্রেজেন্ট বা প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয় না।

ফলে এগুলোর সাথে ক্ষমার সম্পর্ক খুবই জটিল ও বিভিন্নমুখীন গোঁজামিলে ভরা। কাজেই এই ধরনের কাঠামোর সাথে ‘ক্ষমা’র ধারণার সম্পর্ককে দেরিদা খুব ক্রিটিক্যালি দেখতে চান।

২.

“Forgiveness is the greatest gift you can give yourself.”

-Maya Angelou.

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে ক্ষমার মাধ্যমে আসলে কী ঘটে? খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে, মূলত রিকনসিয়েলেশন/ঐক্য বা সংহতি বা পুনঃমিলন ও নরমালাইজেশন বা স্বাভাবিকরণ প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার কাজে ক্ষমাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়– ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। দেরিদা মনে করিয়ে দেন ‘Forgiveness’ -এর মধ্যে ‘give’ ব্যাপারটা কিন্তু আছে। মানে, কোনোকিছু দান করা বা দেয়ার বিষয় আছে। এখন কথা হলো কোনোকিছু দিতে হলে তা দেয়ার এখতিয়ার অথবা স্বক্ষমতা আগে অর্জন করতে হবে, থাকতে হবে। লুট করে দেয়া বা দান করা অর্থনীতিতে রবিনহুট নীতি বলে প্রচলিত। কিন্তু এটা ঘটে মূলত ফ্যান্টাসির জগতে। সাম্প্রতিক অনুশাসনের কালে এটার দেখা পাওয়া যায় না। লুট যে হয়-না তা নয়। কিন্তু আইনকে পাশ কাটিয়ে করতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, ক্ষমা বা Forgiveness -এমন গিফ্ট বা দান যা দেয়ার এখতিয়ার কি মানুষের আছে? আমরা আলোচনা করছি যে, যখন ক্ষমার মধ্যদিয়ে অন্য কোনোকিছু অর্জন করার চেষ্টা বা উদ্দেশ্য থাকে সেটা ক্ষমার লক্ষ্য না বরং সেখানে খোদ ক্ষমাকেই উপলক্ষ্য করে ভিন্নকিছু অর্জন করার আয়োজন থাকে। সাবেক কলোনিয়াল দেশগুলো যখন ক্ষমা চায় তখনও দেখা যায়, অতীতের অপরাধের জন্য নিজ দেশে বা ভুক্তভুগী জনগোষ্ঠীর কয়েক প্রজন্ম পরের মানুষদের প্রতিবাদে, বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে বা জাতীয় ঐক্য ও স্বাভাবিক অবস্থা অর্জনের জন্য ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখা যাচ্ছে যে, ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে বা পাওয়ার মধ্যদিয়ে যা অর্জন করার চেষ্টা করা হয় তা ক্ষমা ছাড়া অন্য কিছু। ক্ষমাই গরহাজির থাকে পুরো আয়োজনে। ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে বস্তুগত অর্জনের বাইরে সাইকোলজিক্যাল/মানসিক নিরাময় বা অতীতের বিলাপের বা ক্ষতের উপর প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা থাকলেও দেখা যাবে ক্ষমার উদ্দেশ্যে কোনো বিশুদ্ধতা থাকছে না। ক্ষমাকে সবসময়ই উপকরণ বা উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা ক্ষমার যে দার্শনিক ধারণা তার সাথে মোটেই যায় না।

 

ক্ষমার বিনিময়ে যদি কিছু পাওয়া যায় বা কোনোকিছু পাওয়ার জন্য, এমনকি ব্যক্তিগত প্রশান্তি পাওয়ার জন্যও যদি গিভ করা হয় তাকে দেয়া/গিফ্ট বলে না। সেটা গিভ অ্যান্ড টেক। এটাকে ইকোনোমিক্যালিটি অব গিভ বা ফরগিভনেস বলা যায়। আমরা যখন কাউকে কোনোকিছু উপহার দেই এবং বিনিময়ে যখন ধন্যবাদও গ্রহণ করি তখনও দেখা যায় দেয়ার বা দানের যে মাহাত্ম তা আদান-প্রদানের আরামে বা তৃপ্তিতে গুরুত্ব হারায়।

 

মায়া এনজেলোর কথাটা খুব জনপ্রিয় কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। খোদ গিফ্ট ধারণাটা দেরিদার অন্য অনেক কাজেও দেখা যাবে। দেরিদার কাছে গিফ্ট বা গিভ মানে কোনোভাবেই আদান-প্রদান না। গিভ অ্যান্ড টেক যেই সম্পর্কে থাকে সেখানে প্রকৃত অর্থে গিভ বা কোনোকিছু দেয়ার এসেন্স থাকে না। গিভ মানে গিভ, সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে যা দেয়া হয় সেটাই- গিভ। ক্ষমার বিনিময়ে যদি কিছু পাওয়া যায় বা কোনোকিছু পাওয়ার জন্য, এমনকি ব্যক্তিগত প্রশান্তি পাওয়ার জন্যও যদি গিভ করা হয় তাকে দেয়া/গিফ্ট বলে না। সেটা গিভ অ্যান্ড টেক। এটাকে ইকোনোমিক্যালিটি অব গিভ বা ফরগিভনেস বলা যায়। আমরা যখন কাউকে কোনোকিছু উপহার দেই এবং বিনিময়ে যখন ধন্যবাদও গ্রহণ করি তখনও দেখা যায় দেয়ার বা দানের যে মাহাত্ম তা আদান-প্রদানের আরামে বা তৃপ্তিতে গুরুত্ব হারায়। তখন আর দান থাকে না সেটা, হয়ে যায় আদান-প্রদান। যা কিছু দান তার কোনোরকম রিটার্ন হয় না। যদিও ফরগিভ ও গিভ কে দেরিদা একই রকম ভাবে দেখেন না, তবে কিছু মিল আছে। কিন্তু ‘দ্যা গিফ্ট’ নামের লেখা বা অন্য অনেক লেখাতেই তিনি এই ধারণা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। আর ক্ষমার বিষয়টি পরিষ্কার করতে গিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন,

“If I am conscious that I forgive, then I not only recognize myself but I thank myself, or I am waiting for the other to thank me, which is already the reinscription of for-giveness into an economy of exchange and hence the annihilation of forgiveness. “

মায়া এনজেলোর কাব্যভাবালুতাময় এই সুন্দর লাইনের সমস্যাও -এই বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে চিহ্নত হয়ে যাচ্ছে। সরল অনুবাদে দেরিদার কথাটা এমন- ‘আমি যখন সচেতন থাকি যে আমি ক্ষমা করছি। তখন শুধু আমি নিজেকে নিজে সচেতনভাবে আবিষ্কার করছি না, একই সাথে নিজেকে নিজে ধন্যবাদ বা বাহবা দিচ্ছি এবং আশা করছি অন্যরাও আমাকে বাহবা দিক। এবং এর ফলে ক্ষমার ধারণার পুনরুৎপাদন হতে শুরু করে একটা অর্থনৈতিক বিনিময়মূলক ধারণা হিসেবে এবং ক্ষমার ধারণার বিনাশ বা বিলয় ঘটে (annihilation of forgiveness)’।

ক্ষমা করে দেয়ার মধ্যেও ‘দেয়া’র ঘটনা ঘটে কিন্তু সেটা আদান-প্রদান সম্পর্কের মতো হলে হবে না। ক্ষমা ব্যাপারটা সব রকম গিভ অ্যান্ড টেইক সম্পর্কের বাইরের বিষয়। লেভিনাস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে দেরিদা ক্ষমায় যে গিভ বা গিফ্ট আছে তা লিখছেন এই ভাবে-  ‘ to forgive, to proceed ‘by-gift’ (par-don in the French), is to give a gift that goes beyond economy’. ক্ষমায় যে গিফ্টটা থাকে সেটা এমন গিফ্ট যা অর্থনৈতিক সম্পর্কের বাইরের বিষয়। দেখা যাচ্ছে ক্ষমা করে দেয়া বলতে আমরা যা বুঝি, যে অর্থে ক্ষমা করা ব্যবহার করি তার সাথে ক্ষমার যে ধারণাগত এসেন্স বা মর্ম তার কোনো সম্পর্ক নাই। এটাকে আমরা একটা বিনিময় সম্পর্কের মতো অর্থ করে নিয়েছি। মির্জা গালিবের মতো সহজ করেও আমরা ভাবতে শুরু করি– কাউকে ক্ষমা করে দিয়ে অথবা কারো কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে -এই জীবন আমাদের যাপন করে যেতে হয়। ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করা যেন বেঁচে থাকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। এই ধরনের ক্ষমায় আসলেই ‘ক্ষমা’ থাকে কি না তা পর্যালোচনা করে দেখি না। আসলেই ক্ষমায় কি ঘটে? সেটাও আমরা খতিয়ে দেখি না।

 

‘Forgiveness forgives only the unforgivable.’

 

দেদিরা এক সাক্ষাৎকারে ক্ষমাকে দেখেন, ‘beyond any categorical imperative’- হিসেবে। মানে, কোন আগাম ধরে নেয়া আচরণের বাইরের বিষয় হিসেবে দেখেন। কোন ঋণশোধ ও আপত্তির বাইরের বিষয় হিসেবে ক্ষমাকে দেখেন। ফরগিভনেস বা ক্ষমা এমন গিফ্ট যা যেকোনো হিসাব-কিতাব বা অর্থনৈতিকতাকে অতিক্রম করে যায়। এমনকি যদি ক্ষমাকে বিবেচনা করা হয়- কোনোরকম স্বীকার উক্তি, আত্মসাক্ষ্য, আত্মতৃপ্তি বা আরোপিত শর্তের অধীন হিসেবে তা হলেও এটাকে যে কেউ তাদের সুবিধা মতো ব্যবহারের সুযোগ পাবে। যেকোনারকম শর্তের অধীনে এটা একটা অর্থনৈতিক সম্পর্কের মতোই ফাংশন করবে যা ক্ষমার সাত্যিকারের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ছাড়ে শেষ পর্যন্ত।

৩.

“All is forgivable except the crime against spirit”

-Hegel.

এই অংশে আমরা ক্ষমার প্যারাডক্স নিয়ে আলোচনা করবো। প্যারাডক্স -এর ভালো বাংলা কি হতে পারে? বিভ্রম? নাকি বৈপরীত্য? এর একাধিক বাংলা সম্ভব। নির্ভর করে শব্দটির ব্যবহারের ওপর -কোনো অর্থটি আমরা গ্রহণ করবো। এখানে আমরা প্যারাডক্স-ই লিখছি। দেরিদা গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ক্ষমার যে দার্শনিক মর্ম সেই দিকটা বুঝবার ক্ষেত্রে আমরা একধরনের প্যারাডক্সের মধ্যে আছি। যতই আমরা স্যাকুলার দুনিয়ায় বাস করি না কেন! ধর্ম থেকে আধুনিক জিবনের বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাক্তিগত, সমাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে যতই সুনিশ্চিত ধরে নেই না কেন। ক্ষমার প্রশ্নটার ধর্মগত দিক থেকে মিমাংসার তর্কটা হাজির হয়েই য়ায়। যখনই কোনোকিছু বা কাউকে ক্ষমা করার প্রশ্ন ওঠে ধর্মের ভাষায় দেখা যায় সেখানে আছে, নৈতিকভাবে যাকে পাপ মনে করা হয় সেই ধরনের কোনো আচরণ। কখনো বা এমন পাপ, যা ক্ষমার অযোগ্য জঘন্য অপরাধ বা কারো অসহ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয়টা রয়েছে। এই পয়েন্টটা তিনি একাধিক দিক থেকে আলোচনা করে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। এবং এই বিখ্যাত উক্তি এই পয়েন্টের আলোচনাতেই তিনি করেন–

‘Forgiveness forgives only the unforgivable.’

ক্ষমা মর্মগত ভাবে তাকেই ক্ষমা করে যে ক্ষমার অযোগ্য। এই ক্ষমার অযোগ্যকে ক্ষমা করা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এবং এই অসম্ভবটা সম্ভব করা গেলেই কেবল ক্ষমা করা সম্ভব হয়। দেরিদা বলেন–

‘It can only be possible in doing the impossible’

 

যে ব্যক্তি অপরাধী সেও তো মানুষ। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের কাঠগড়ায় যখন তাকে হাজির করা হচ্ছে তখন তার ‘মানুষ’ পরিচয়ের বিলয় ঘটিয়ে কেবল একজন বা একাধিক অপরাধী হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। যদিও সক্রেটিসের মত হলো- অন্যায় করলে মানুষের আত্মা মরে যায়। সেই দিক থেকে অপরাধী হিসেবে হাজির হওয়ার আগেই, অন্যায় করার সাথে সাথেই মানুষ হিসেবে তার বিলয় ঘটে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ঘটছে বিচারকের কাঠগড়ায় এসে। মানে, যে সার্বজনীন মানবতার নীতির আলোকে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান গঠন হলো তাতে অপরাধী মানব সন্তানকে ধারণ করা যাচ্ছে না। তার পরে দেখা যায়, ভিকটিমের পক্ষে বিচার বা ক্ষমার ফয়সালা করেন জুরি যা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মনোভাবকে পুরোপুরি রিপ্রেজেন্ট বা প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয় না।

 

ফলে দেখা যাচ্ছে ক্ষমা একটি এমন কর্ম বা অ্যাক্ট যা কেবল সম্ভব হয় অসম্ভকে সম্ভব করার মাধ্যমেই। যদিও দেরিদা একই সাথে ক্ষমাকে একটি ইভেন্ট আকারে দেখেন। ইভেন্ট মানে সাধারণ ঘটনা না। দার্শনিক বিবেচনায় ইভেন্ট একটি ধারণা/কনসেপ্ট। এর সাথে ফেনোমেনোলজি, অন্টলজিসহ অনেক কিছুর যোগ আছে। দর্শনে ইভেন্ট মানে শুধু মাত্র একটি ঘটনাই না (এলান বাদিউ -এর ‘বিং এন্ড ইভন্ট’ বা জিজেকের ‘ইভেন্ট’ নামের বই দেখতে পারেন আগ্রহীরা)। তো ক্ষমা কী এমন সরল প্রশ্ন করলে, দেরিদা এর সরল উত্তর দেবেন,

Forgiveness is what calls ‘an event’.

এবার যদি প্রশ্ন করা যায় তাহলে ক্ষমা কেমন ইভেন্ট? এটা এমন ইভেন্ট যার মাধ্যমে দ্যা ইমপসিবল/অসম্ভব হয়ে ওঠে টু বি পসিবল/সম্ভব। এই বিষয়টি বিষদ আলোচনার জন্য দেরিদা ইহুদি বংশজাত ফ্রেঞ্চ দার্শনিক  Vladimir Jankélévitch- এর দুইটা লেখা ধরে আলোচনা করেন।

এক. Le Pardon দুই.  L’Impresciptible.

১৯ শতকের ৬০ -এর দশকে ফ্রান্সে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আইন প্রণয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাগুলো লেখা হয়। পরে এগুলা বই আকারে প্রকাশিত হয়। ক্ষমাবিষয়ক দার্শনিক চিন্তায় দেরিদার আলোচনার পরেই মূলত এই লেখকের দিকে বিশ্ব-চিন্তক মহল দৃষ্টি ফেরাতে শুরু করেন। আমরা এখানে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ পাবো না। শুধু দেরিদার ক্রিটিকটা ধরে আলাপ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

Jankélévitch মনে করেন, সবই ক্ষমার যোগ্য। শুধুমাত্র মানুষের (ব্যক্তির) মানবতাবিরোধী অপরাধ ছাড়া। তিনি বলেন-

‘All is forgivable except the crime against the humanity of man’.

এই লাইন পড়ার সাথে সাথে দেরিদার মনে পড়ে যায় মহান দার্শনিক হেগেলের কথাটা। হেগেল তর্ক তুলেন,

‘all is forgivable except the crime against spirit’.

সবই ক্ষমার যোগ্য। শুধু স্পিরিট (এর একটা বাংলা পরম করা হয়, কিন্তু তাতে হেগেলের স্পিটি বিষয়টা ঠিক ধরা যায় না) এর বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া। দেরিদা Jankélévitch- এর পয়েন্ট চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি তর্ক তুলেন, আব্রাহামিক ঐতিহ্যে ক্ষমার প্রশ্নটি এখনও অমীমাংশিত। বলা হয়, যারা ক্ষমা চায় না তাদের জন্যও বিবেচনা রয়েছে। আর যারা ক্ষমা চায়, নিজেকে অপরাধী হিসেবে স্বীকার করে এবং অতীতের অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আর সেই অপরাধের দিকে ফিরে না তাদের জন্যও বিবেচনা কথা বলা হয়েছে। ফলে ক্ষমার ব্যাপারটি এখানে কখনও কখনও শর্তাধীন আবার কখনও শর্তহীন। যে ক্ষমা প্রার্থনা করে না বা নিজেকে অপরাধীই মনে করে না তাকেও অপরাধী হিসেবে গন্য করার কিছু নীতি এইসব ধর্ম ঐতিহ্যে আছে। দেরিদা মনে করেন, ক্ষমার বিষয়টি নিয়ে আমরা যখন কথা বলি তখন এর দ্বৈততা মানে কন্ট্রাডিটরি বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলি। এতে খোদ ক্ষমার প্রকৃতি উম্মোচিত হয় না। এবং দেরিদা মনে করেন Jankélévitch যখন কথা বলেন, মনবাতাবিরোদী অপরাধের বিচারের কথা বলেন। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মনবতার ধারণা নিজেদের মতো ধরে নিয়ে যখন বিচারের কথা বলেন তখন আসলে তিনি ক্ষমা না করার দায়িত্বের কথা বলেন। এখানে দেরিদা আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেন। ক্ষমার সাথে এরা বিচারের সম্পর্ককে অবিচ্ছেদ্য করে দেখেন। একজন ইহুদি রিফিউজি হিসেবে Jankélévitch -এর অভিজ্ঞতা তাকে ক্ষমার প্রশ্নকে বিচারের প্রশ্নের দিকে নিয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন,

‘Forgiveness died in the death camps’.

যদিও দেরিদা মনে করিয়ে দেন Jankélévitch তার কাজে অন্যত্র স্বীকার করেন নিঃশর্ত ক্ষমার কথা ইহুদি ও খ্রিস্টীয় ধারায় বলা হয়েছে। যদিও তিনি মনে করেন, এই জন্য অপরাধীকে আগে ক্ষমা চাইতে হবে। ফলে তিনি যখন ভিকটিম/ অত্যাচারিত হিসেবে বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন, তখনও একই সাথে একজন ইহুদি হিসেবে তিনি না চাইলেও ক্ষমা করতে বাধ্য। এই কন্ট্রাডিকশন/বৈপরীত্য দেরিদা মনে করিয়ে দেন। এবং দেরিদা আবার মনে করিয়ে দেন, যখন এইভাবে ক্ষমা চাওয়া হয় এবং ক্ষমা মঞ্জুর করা হয় তখনই বিষয়টা সেই দেয়া-নেয়ার পর্যায়ে নেমে যায়। ক্ষমার যে মর্ম/এসেন্স তা থেকে ক্ষমার বিচ্যুতি ঘটে।

 

সবই ক্ষমার যোগ্য। শুধু স্পিরিট (এর একটা বাংলা পরম করা হয়, কিন্তু তাতে হেগেলের স্পিটি বিষয়টা ঠিক ধরা যায় না) এর বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া।

 

অন্যদিকে ক্ষমা করার বিষয়টার সাথে মানুষের এখতিয়ার আর বিচারের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। Jankélévitch মনে করেন,

‘men are unable to forgive what they cannot punish’.

মানুষ সেসব ক্ষমা করতে পারে না, যেইসবের বিচার করতে পারে না। বিখ্যাত চিন্তক হান্না আরেন্ড এর কথাও এই প্রশ্নে আলোচনায় আসে। হান্নাও মনে করেন,

‘Punishment has something in common with forgiveness.’

তাদের দুইজনের চিন্তাতেই যা মিল দেখতে পাওয়া যায় তা হলো- ‘unforgivable is also unpunishable’ ক্ষমার অযোগ্য মানে শাস্তিরও অযোগ্য। এই চিন্তার ধারাকে দেরিদা ক্রিটিক করেন। এবং সেই সূত্র ধরেই দেরিদা দেখতে পান, ‘forgiveness is the unforgiveable’ ক্ষমা বিষয়টা বিচার না বরং ক্ষমার অযোগ্য। এখানে মনে করিয়ে দেয়া অসঙ্গত হবে না যে, দেরিদাও একজন ইহুদি সেই জন্য তাকে আলজেরিয়াতে থাকার সময় স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।  হান্না ও Jankélévitch দুইজনেই ইহুদি ও অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে জীবনে। কিন্তু তারা যে খানে ক্ষমাকে বিচারের আওতায় নিয়ে, বিচারের এখতিয়ারের পরিমণ্ডলে চিন্তা করেছেন। পশ্চিমা গ্রিকো-খ্রিস্টান ধারার মধ্যে চিন্তা করেছেন, ইহুদি হওয়ার পরেও দেরিদা এই দিক থেকে শুধু ভিন্নই না বরং বৈপ্লবিক।

এই পয়েন্টে ক্ষমার প্যারাডক্সটা আরও পরিস্কার করার জন্য দেরিদা সক্রেটিসের মতো করেই প্রশ্ন করেন। তিনি প্রশ্ন তুলেন,

‘What do I forgive?

And whom?

What and whom?

Something or someone?’

আমি কী ক্ষমা করবো? এবং কাকে?

কি এবং কাকে?

কোনকিছুকে বা কোন ব্যক্তিকে?

এই, কী এবং কাকে -প্রশ্নের সূত্র ধরে দেরিদা ক্ষমার প্যারাডক্সটা বেশ ভালো মতোন ধরে ফেলতে পারছেন দেখা যাচ্ছে। আমরা কি কোনো অ্যাক্ট বা কর্মকে ক্ষমা করবো? নাকি ব্যক্তিকে? যে অ্যাক্ট/কর্ম আর যে ব্যক্তি উভয়ই কি একই? পাপ আর পাপী কি একই? কিন্তু ক্ষমা বিষয়ক চিন্তার ইতিহাসে দেখা যায় আমরা প্রায়ই এই প্রশ্নকে গুলিয়ে ফেলতে দেখি । কর্ম ও ব্যক্তিকে একাকার করে দেখা হয়। অথবা কর্মের ওপর ফোকাস থাকে না, মূল নজর চলে আসে ব্যক্তির উপর। দেরিদা মনে করেন–

‘In order for there to be forgiveness, must one not… forgive both the fault and the guilty as such’.

ক্ষমায় এইভাবে একাকার করে দেখার সুযোগ নাই। কর্ম এবং ব্যক্তি দুইটাকেই একই সাথে ক্ষমা করতে পারা যায় না। যা মানুষের পক্ষে আসলেই অসম্ভব। তার পরেও মানুষ যখন ক্ষমা করেন বলে দাবি করেন, তখন সেই ক্ষমাটা মিথ্যা। কেউ কাউকে ধর্ষণ বা হত্যা করলো, কারো পক্ষে অপরাধীকে ক্ষমা করা সম্ভব হলেও সেই খোদ অপরাধকে ক্ষমা করার কোনো এখতিয়ার তো নাই।

আমরা এখানে দেখছি- পাপকে ঘৃণা করতে পারো কিন্তু পাপীকে না-টাইপের অবস্থা। ফলে ক্ষমার মধ্যে এই যে ফাঁকি এটাকেই দেরিদা Perjury/ Pardon নামে চিহ্নিত করেন। Perjury মানে, মিথ্যা, প্রতারণা, ভণ্ডামি। ক্ষমা বিষয়ক গোটা দার্শনিক চিন্তার ইতিহাসে দেরিদার এই আবিষ্কার চিন্তা-বিশ্বকে আজও বিস্মিত করে রেখেছে।

আরও একটি প্রশ্ন তুলেন তিনি। কাকে ক্ষমা করতে বলা হয়? মানুষ তো পাপ ও পাপীকে একই সাথে ক্ষমা করতে পারে না। কাকে ক্ষমা করতে বলা হয় আসলে? সে কি ঈশ্বর? কিন্তু ঈশ্বর কি ভিকটিম? দেরিদা মনে করিয়ে দেন, ফ্যান্সের ক্যাথলিক চার্চ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তাদের কর্মকাণ্ড এবং নীরব ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু তারা সাধারণ জনগণ বা ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ক্ষমা চান নাই। তারা গণহত্যার কথা স্মরণ করে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। যদিও একমাত্র ক্ষতিগ্রস্তের মর্জি হলো ক্ষমা করা না করা।

 

কর্ম এবং ব্যক্তি দুইটাকেই একই সাথে ক্ষমা করতে পারা যায় না। যা মানুষের পক্ষে আসলেই অসম্ভব। তার পরেও মানুষ যখন ক্ষমা করেন বলে দাবি করেন, তখন সেই ক্ষমাটা মিথ্যা। কেউ কাউকে ধর্ষণ বা হত্যা করলো, কারো পক্ষে অপরাধীকে ক্ষমা করা সম্ভব হলেও সেই খোদ অপরাধকে ক্ষমা করার কোনো এখতিয়ার তো নাই।

 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ক্ষমার মর্মকে সত্যিকারভাবে ধারণ করতে পারে, ক্ষমার আদবসহকারে ক্ষমা আর চাইতে দেখি না। দেরিদা বলেন, আমরা ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এই জন্যই না যে, একমাত্র ঈশ্বরই ক্ষমা করতে পারেন (যদিও এটাও অনেক লোক মনে করেন) বরং ঈশ্বরই একমাত্র একচ্ছত্র বিকল্প। একচ্ছত্র আশ্রয়। এক পরম এবং অনামক অদ্বিতীয় (unnameable singularity) । পরম দ্রষ্টা। যখন ক্ষমা চাওয়ার মতো কেউই থাকেন না তখন কেবল ঈশ্বরই থাকেন। এই জন্য এক সেমিনারে তিনি প্রশ্ন তুলেন,

‘Is forgiveness a human thing, something proper to the human, a power of the human -or is it reserved for God.’

ক্ষমা কি কোন মনুষ্য বিষয়, মানুষের সাথে যায়- এমন কেনোা বিষয়, মানুষের এক ধরনের ক্ষমতা নাকি এটা ঈশ্বরের জন্য বরাদ্দ?

এই প্রশ্নের সাথে ক্ষমার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আরো একটি দিকের আলোচনাও চলে আসে। ক্ষমা কি এমন কিছু যা মুখোমুখি হওয়ার বা করার বিষয়? অথবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থতায় করা সম্ভব? দেরিদা মনে করেন, ক্ষমার ব্যাপরটা কাজ করে দুই ‘একক’ এর মধ্যে। অপরাধী এবং ক্ষতিগ্রস্ত। যখনই এর মধ্যে কোন তৃতীয় পক্ষ হাজির হয়ে যায়, তখন গেটা দৃশ্যপটে উপস্থিত হয়, সাধারণ ক্ষমা/এমনেস্টি, রিকনসিয়েলেশন অথবা ক্ষতিপূরণের বিষয়গুলো। দক্ষিণ আফ্রিকার আলোচিত ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিয়েলেশন’ কমিশনের একটা ঘটনা দেরিদা উল্লেখ করেন। ঐ কমিশনে ১১ টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল পাবলিকের সাথে যোগাযোগের জন্য। ড. টুটুর অনুবাদে এই ভাষ্য পাওয়া যায়। এক নারী বলেন,

‘A commission or a government can not forgive. Only I, eventually, could do it. (And I am not ready to forgive).’

কোন সরকার বা কমিশনের ক্ষমা করার এখতিয়ার নাই। একমাত্র আমিই পারি ক্ষমা করতে। কিন্তু এখন আমি ক্ষমা করার জন্য প্রস্তুত না।

দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র বিচার করতে পারে, কিন্তু ক্ষমা করায় কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নাই। আমরা দেখি কান্টও প্রায় একই রকম কথা ভেবেছেন। ক্ষমা বিষয়টাকে তিনি আইনের অতীত বা এখতিয়ারের বাইরের বিষয় বলে মত দিয়েছেন। তার পরেও প্রশ্ন থাকে; বিশেষ করে যখন এই ধরণের কমিশন বা বিচারের প্রয়োজনের নিরিখে ক্ষমার প্রশ্নটি উঠবে, তাহলে কে ক্ষমা করতে পারবে? গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির স্ত্রী কি গুমকারীদের ক্ষমা করে দিতে পারে? দেরিদা মনে করেন,

‘Nobody of whom forgiveness can be asked in the case of the disappeared’.

গুম টাইপের ঘটনায়, গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির বেলায় অন্যকারোর কাছে ক্ষমা চাওয়া বা গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির বদলে অন্য কারো কাছে ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নাই। অন্য ব্যক্তি সেই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায় নাই। ফলে তার বদলে অন্য কারো অধিকার নাই ক্ষমা করার।

যতোই আমরা ক্ষমার প্যারাডক্সকে স্বচ্ছভাবে বুঝতে চাইছি ততই দেখতে পাচ্ছি ক্ষমার অসম্ভব্যতার দিকগুলোই বেরিয়ে আসছে। অন ফরগিভনেস -প্রবন্ধে দেরিদা পরিষ্কার করে বলেন, ক্ষমা করার নামে ক্ষমার মর্ম/ট্রুথ/এসেন্স আদায় হয় না এমন কাজ করা উচিত না। যদি ক্ষমা বলে কিছু থাকে সেটা হলো -এমন কিছু যা ক্ষমার অযোগ্য, তাকে ক্ষমা করা এবং আনকন্ডিশনালি/নিঃশর্ত ভাবে ক্ষমা করা। তিনি মনে করেন,

‘there is only forgiveness, if there is such a thing, of the unforgivable.’

ক্ষমা করা বলতে কোনোকিছু তখনই থাকতে পারে যখন সেখানে ক্ষমার অযোগ্য কোন কিছু থাকে। ফলে কোন কিছু করা তখনই সম্ভব হয় যখন সেই বিষয়টা তাতে থাকে। যেই বিষয়ে সেই জিনিস নাই, তা করা সম্ভব না। তেমনি ক্ষমা মানে ক্ষমার অযোগ্যকে ক্ষমা করা। এর বাইরে ক্ষমার মধ্যে সম্ভাবনা বলে যদি কোনোকিছু থাকে তা হলো আইনের সম্ভবনা। আইনের নানান রকম বিস্তার। যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকি। কাজেই দেরিদা মনে করেন,

‘forgiveness is mad…a madness of the impossible’.

ক্ষমা পাগলমি… অসম্ভবের পাগলামি।

 

গুম টাইপের ঘটনায়, গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির বেলায় অন্যকারোর কাছে ক্ষমা চাওয়া বা গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির বদলে অন্য কারো কাছে ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নাই। অন্য ব্যক্তি সেই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায় নাই। ফলে তার বদলে অন্য কারো অধিকার নাই ক্ষমা করার।

 

ফলে এটা বলা যাবে না ক্ষমা চির অধরা, অসম্ভই থেকে যাবে। বা আমরা এটাকে অর্জন করার চেষ্টা করবো না। দেরিদা মনে করেন, এটা অর্জন করার জন্য সমাজ ও ইতিহাসে আমাদের যে বিষয়টা বুঝতে হবে তা হলো, ক্ষমার কন্ডিশন/শর্ত এবং ক্ষমাকে অর্জন করতে হলে, ক্ষমার মধ্যে যে একই সাথে কন্ডিশন/শর্ত এবং অনকন্ডিশন/শর্তহীনতা বিরাজ করে -এই বৈপরীত্যকে মোকাবেলা করতে পারতে হবে। তাহলেই আমরা ক্ষমার হক রক্ষা করে ক্ষমা বিষয়টাকে বুঝতে পারবো।

৪.

‘Good to forgive; best to forget.’

-Robert Browning.

যেকোনো কিছু বুঝতে হলে আগে তার সাথে সংযোগ বা কমিউনিকেশন ঘটতে হবে। ক্ষমার সাথে এই সংযোগ বা যোগাযোগের সম্পর্কটাও বুঝতে হবে। এই সংযোগের জন্য আগে ক্ষমার প্রশ্নের সাথে গোপনীয়তা বা সিক্রেট -এর যে সম্পর্কটা আছে, সেটা বুঝতে হবে। আরও যেটা বুঝতে হবে তা হলো, অপরাধ বা অপরাধী এবং ক্ষতিগ্রস্ত টাইপের বিষয়গুলো । ক্ষমা একটি যোগাযোগমূলক এক্ট। কে অপরাধী এবং কী অপরাধ তা বুঝতে হবে সবার আগে। এবং দেরিদা মনে করে, এইসব বিষয়ে আমাদের সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকা সম্ভব না, এটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রমাণাতীত বা প্রামাণঅযোগ্য। এটা কি কোনোভাবেই সম্ভব যে দুই পক্ষই ( অপরাধী ও ক্ষতিগ্রস্থ) পুরো ঘটনার বিষয়ে সমান ভাবে সচেতন হবে? দুই পক্ষের মধ্যে কোনো অবস্থা বা ঘটনা নিয়ে শুধু অ্যাকশনের ভিন্নতা থাকে তাই না, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিরও ভিন্নতা থাকে।

আর যদি এমনও হয়- ক্ষতিগ্রস্ত বুঝতে পারে, এবং অপরাধীর সাথে কথা বলতে থাকে, এবং একমত হয়ে যায়, তখন সাথে সাথে রিকনসিলিয়েশন শুরু হয়, সেটাকে ক্ষমা বলা যাবে না। এমন কি ক্ষতিগ্রস্ত যদি অপরাধের কারণ বুঝতে পারার পরে সে যদি মুখে বলেও আমি ক্ষমা করতে চাই না তাও রিকনসিলিয়েশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তখন যুক্তির খেলা শুরু হয়ে যায়। এজলাসে প্রায়ই এমন হয়।

যখন আমরা বলি, আমরা অপরাধ এবং অপরাধীকে বুঝতে পারছি তখনই অপরাধীর তরফে এমন উদ্যোগ শুরু হয় যার ফলে ক্ষমার প্রয়োজন বিলিন/ডিজঅ্যাপেয়ার হয়ে যায়। তখন আমরা বুঝতে পারি কেউ কেন এমন কর্ম করলো তখন আমরা বিক্ষুদ্ধ জনকে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে বলি।  দেরিদা মনে করেন, সবচেয়ে চরম অত্যাচারের শিকার, যে ন্যায় বা জাস্টিস প্রত্যাশা করেন, অপরাধী যখন আদালতের সামনে হাজির হয়, তখন তার মনে ক্ষমার বিষয়টির কথা জেগে ওঠে। এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ধারাতে ক্ষমাকে ট্রুলি বুঝবার বোধ উধাও হয়ে যায়। এটা এমন একটা অবস্থা যা আসলে আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না। এবং আবার আমরা যুক্তির সীমারেখাও অনুধাবন করতে পারি না। এই জন্যই পুরো বিষয়গুলো যুক্তি-তর্ক দিয়ে পরিস্ক্রার হয়ে গেলে তখন আর ক্ষমার বিষয়টি সেখানে থাকে না। ক্ষমার কিছু সিক্রেসি থাকে। দেরিদা মনে করেন,

‘Forgiveness is thus mad. It must plunge lucidly into the night of the unintelligible.’

ক্ষমা এমন একপাগলামি যা হিসাব-কিতাবের বাইরে আলতো করে রাতের অসচ্ছ আঁধারে বোকার মতো লেপ্টে থাকে।

অন্য আরেকটি দিক থেকেও বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করা যায়। ক্ষমা আদতে একটি সিক্রেট বা গোপন বিষয়। বিষয়টা অনেকটা গিফ্ট এর মতো। দেরিদার দর্শনে সিক্রেট বা গোপন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটা একটি শব্দ মাত্র না। এই বিষয়ে আগ্রহীরা উনার বইটা দেখতে পারেন, ‘A Taste for the Secret’. আমরা এখানে বিস্তারিত আলাপ পাশ কাটিয়ে সংক্ষেপে ক্ষমার ধারণার সাথে সিক্রেটের সম্পর্কটা শুধু বলতে চেষ্টা করবো। দেরিদার কাছে সিক্রেট এমন একটি ধারণা যা, কোনোভাবেই রাজনৈতিক ও বিচারিক পরিসীমার মধ্যে ধরা যায় না। এইসবের আওয়ার বাইরেই থাকে সিক্রেট। গোপন বা সিক্রেট এমন কিছু যা অপঠিত এবং অগম্য/ইনএকসেসেবল-মৌলগত ভাবেই। আমাদের অপর/আদার এই সিক্রেট দ্বারাই গঠিত। এর মানে এই না যে আমরা কোনোকিছু সম্পর্কে অন্যকে জানাই না বা জানতে চাই না। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই ধারণাগত বা মর্মগত দিক থেকে অন্যকে জানতে পারি না। কোনোব্যক্তি বা অন্যকোনো কিছুকেও না। জানতে পারি না মানে, তাদের সমগ্রতাসহ, সম্পূর্ণরূপে জানতে পারি না। দেরিদা এখানে যেন সক্রেটির কণ্ঠে কথা বলেন। তিনি তর্ক তুলেন, যেহেতু আমি সম্পূর্ণভাবে নিজের সম্পর্কেই জানি না। আমিও আমার একধরনের সিক্রেট/গোপন। সেখানে অন্যকে জানার প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে যেকোনো যোগাযোগের সম্ভাব্যতা এই গোপনীয়তার শর্তাধীন। এই জন্য আমরা অন্যের সাথে সাধারণত সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে, সত্ত্বার সমগ্রতাসমেত যোগাযোগ করতে পারি না। কারণ আমাদের সত্ত্বা এই গোপনীয়তার কাঠামো দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমরা পরিপূর্ণভাবে যোগাযোগ করে উঠতে পারি না। দেরিদা মনে করেন, আমার অর্থ/মিনিং আমার অভিপ্রয়/ইনটেনশন -এর চেয়ে অনেক বেশি, ছাপিয়ে যায়। লেভিনাস যেমন বলেন, ‘the saying exceeds the said.’ আমাদের বলা, আমাদের বক্তব্যকে ছাপিয়ে যায়। যা বলা হচ্ছে বক্তব্য বা বলবার আছে তার চেয়ে অনেক বেশি। যা বলা হচ্ছে আর যা বক্তব্য তার মধ্যে যে বিপুল পার্থক্য, অনেক অধরা, গোপন বিষয় থাকে সেটাকেই বুঝাতে এভাবে কথাটা বলা হয়েছে। এবার আমাদের প্রসঙ্গে ফিরি। ক্ষমাও তেমনি একটি সিক্রেট। কারণ, অন্যকে ক্ষমা করার বেলায় দেখা যায়, অপরের অনেক কিছুর সাথেই সংযোগ করা সম্ভব হয় না। অনেক গোপন/অধরা থেকে যায়। দেরিদা মনে করেন,

‘The secret of this experience remains. It must remain intact, inaccessible to law, to politics, even to morals: absolute.’

সিক্রেটের যা মর্ম অভিজ্ঞতা তাকে সংরক্ষন করতে হবে। এবং এটা অবিকৃতভাবেই সংরক্ষণ করতে হবে। এটা আইন, রাজনীতি এমনকি নৈতিকতার পক্ষেও অগম্য। কেন না এটা অ্যাবসুলিউট/চূড়ান্ত। যা চূড়ান্তভাবে গোপন/সিক্রেট তাতে কারো হস্তক্ষেপের এখতিয়ার নাই। উদাহরণ হিসেবে দেরিদা উল্লেখ করেন, মনে করেন- একজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, যার সন্তানকে নির্বাসিত করা হয়েছে বা গলা কেটে নেয়া হয়েছে বা এমন একজন যার পরিবারকে ডেথ-ওভেনে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমন অবস্থায় কি তারা আমি ক্ষমা করে দিলাম বা আমি ক্ষমা করবো না- বলার মতো অবস্থায় থাকে? আমি নিশ্চত না -দেরিদা বলেন, আমি বরং নিশ্চিত তারা কোনোকিছু বলার মতো অবস্থায় থাকে না। কোনো ভাষাই থাকে না। এবং এই যে ভাষাহীন অবস্থা এটা কোন ভাবেই কমিউনিকেট করা যায় না। একসেস করা যায় না। দেরিদা বলেন, আমি অবশ্যই এই সিক্রেটকে শ্রদ্ধা করি। ফলে দেরিদা মনে করেন, ক্ষমার অভিজ্ঞতা একই সাথে যোগাযোগাতীত বা অসম্ভব একটি অভিজ্ঞতা।

 

দেরিদার কাছে সিক্রেট এমন একটি ধারণা যা, কোনোভাবেই রাজনৈতিক ও বিচারিক পরিসীমার মধ্যে ধরা যায় না। এইসবের আওয়ার বাইরেই থাকে সিক্রেট। গোপন বা সিক্রেট এমন কিছু যা অপঠিত এবং অগম্য/ইনএকসেসেবল-মৌলগত ভাবেই। আমাদের অপর/আদার এই সিক্রেট দ্বারাই গঠিত। এর মানে এই না যে আমরা কোনোকিছু সম্পর্কে অন্যকে জানাই না বা জানতে চাই না। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই ধারণাগত বা মর্মগত দিক থেকে অন্যকে জানতে পারি না। কোনোব্যক্তি বা অন্যকোনো কিছুকেও না। জানতে পারি না মানে, তাদের সমগ্রতাসহ, সম্পূর্ণরূপে জানতে পারি না।

 

আরও বলতে হবে, এই যে অকথ্য অবস্থা এর মধ্যে ক্ষমার প্রশ্ন উঠলেও স্মৃতির যন্ত্রণা থেকে রেহাই না পাওয়ার বিষয়টা থেকেই যায়। ধরা যাক, কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। বিচার বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বা যেভাবেই হোক তিনি ক্ষমা করে দিলেন। তিনি যে অসহ্য স্মৃতির দহনে আক্রন্ত হবেন, সেটা থেকে এই ক্ষমা তাকে পরিত্রাণ দিতে পারবে না। মানে ক্ষমার মাধ্যমে জাস্টিস বা ন্যায় মানে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে এমন কোনো গ্যারান্টি নাই। ক্ষমা করে দিয়ে প্রতিনিয়ত স্মৃতির দহনে দগ্ধ হওয়া কোনোভাবেই ন্যায় কায়েম -বলা যাবে না। তাই ক্ষমার সাথে সাথে কবি রবার্ট ব্রাউন ভুলে যাওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু ভুলে যাওয়ার বিষয়টা সব সময় ব্যক্তির ইচ্ছা বা এখতিয়ারের ওপর নির্ভর করে না। এমন অনেক ঘটনা থাকতে পারে আমরা ভুলে যেতে চাই কিন্তু ভুলতে পারছি না। আবার ভুলে যাওয়া মানে ক্ষমা করা না। দেরিদা মনে করেন,

‘forgiving is not forgetting’.

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না-টাইপের ব্যাপার। ফলে ক্ষমাকে এখানেও এক অসম্ভব সম্ভাবনা আকারেই দেখা যাচ্ছে।

৫.

“The weak can never forgive. Forgiveness is the attribute of the strong.”

-Mahatma Gandhi.

আমরা দেখেছি, দেরিদা ক্ষমার বিষয়টিকে এমন কিছু মনে করেন যা বিচারিক বা আইনি পরিমণ্ডলের বাইরের বিষয়। তার পরেও তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখান, ক্ষমার এখতিয়ার কীভাবে আইনের কাঠামোর মধ্যে সংরক্ষন করা হয়। অপরাধীকে ক্ষমা করার বিষয়টি আইনের মাধ্যমেই চর্চা করা হয়। আমেরিকা, ভারত বা বাংলাদেশেও এটা করা হয়। অনেক গণতান্ত্রি ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশেও ক্রিমিনালকে ক্ষমা বা দায়মুক্তি প্রদানের এখতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান সংরক্ষন করেন। কুখ্যাত অপরাধীকে রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমা করে দেন। তার পরে এরা বিদেশে বা স্বদেশে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় এমন নজিরের অভাব নাই। দেরিদা এই বিষয়টাকেও বুঝতে চেষ্টা করেন। ক্ষমা করার অধিকার -এরা কই পাইলো? এই অধিকার আইনের দ্বারা প্রাদান করা হয় এবং এটা ক্ষমা করার বেলায় প্রয়োগ করতে দেখা যায়। এটাকে তিনি বলেন, আইনের আইন-অধিক/অতিরিক্ত ব্যবহার। মানে, আইনের এমন ব্যবহার যা আইনকে ছাপিয়ে যায়। আইনের মাধ্যমে আইনকে পাশকাটিয়ে যাওয়ার একটি ব্যাপার। দেরিদা মনে করেন, এই ধরনের ক্ষমা করার অধিকার চর্চার অরিজিন বা মূলটা আছে থিওলজিক্যাল বা ধর্মতত্ত্বগত ইতিহাসের মধ্যে। এটা একটা ডিভাইন ক্ষমতা। আইন বা বিচারে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার পরেও ক্ষমা করে দেয়ার এখতিয়ার একমাত্র ডিভাইন/ঐশ্বরিক এখতিয়ার। কিন্তু এটা স্যাকুলার রাষ্ট্রের প্রধানরাও চর্চা করেন ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যদিও অনেক স্যাকুলার রাষ্ট্রের প্রধান ধর্মগ্রস্থ ছুঁয়ে শপথ নেন। এবং ধর্মের ভাষাতেও কথা বলেন। Metaphysics of Morals – এ মাহান দার্শনিক কান্টও একই মত দেন। যার সাথে দেরিদার চিন্তার মিল দেখা যাচ্ছে। কান্টও মনে করেন, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীরই কেবল কোনো অপরাধীকে ক্ষমা করার অধিকার আছে। তা না হলে অন্যায় হতে পারে। কান্টও মনে করেন,

‘forgiveness in general should only be permitted on the part of the victim’

সাধারণভাবে ক্ষমার করার এখতিয়ার শুধু মাত্র ভিকটিমের তরফ থেকেই আছে। অন্য কেউ -এটা করতে পারে না। কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখন এই ধরনের কাজ করেন তখন বিচারের নামে অবিচার ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। দেরিদা উদাহরণ হিসেবে বলেন, Puerto Ricans কিছু সন্ত্রাসীকে বিল ক্লিন্টন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। পরে দেখা যায় তার স্ত্রী হিলারি সেই সময় নিউ ইয়র্ক থেকে সিনেট হওয়ার জন্য নির্বাচনে নেমেছিল। সেই এলাকার অনেক ভোটার ঐ Puerto Ricans দ্বিপাঞ্চল থেকে আগত, ফলে ভোটে প্রভাব ফেলতেই এমনটি করা হয়েছি।

ক্ষমা যদি একটি গিফ্ট/দান, একটি সিক্রেট/গোপন, প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়- তাহলে কে ন্যায়গত ভাবে ক্ষমা করার অধিকারী? এইখানে দেরিদা সভারেন্টির গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা আলোচনা করেন। তিনি বলেন,

‘what makes the ‘I forgive you’ sometimes unbearable, or odious, even obscene is the affirmation of sovereignty.’

কীভাবে সম্ভব হয় বলা যে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম, যখন ক্ষমা করা অসহনীয় বা উদ্ধত্যপূর্ণ এমনকি দৃষ্টিকটু ভাবে সার্বভৌমত্ব জাহির করার প্রচেষ্টা। কাজেই ক্ষমা করার কারণ বা রিজন আমরা কারো হাতে তুলে দিতে পারি না। দেরিদা ক্ষমা করার অধিকার ক্ষমতাবান কারো হাতে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়াতে আপত্তি তুলেন। আমাদের ক্রমাগত প্রশ্ন তুলতে হবে, কে প্রকৃত পক্ষে ক্ষমা করার যোগ্য এবং ভিকটিমকে মনে রাখতে হবে যে, কোনো কাঠামোগত ক্ষমতার হাতে এটা গেলে সে ক্ষমা করার ক্ষমতাও এই প্রক্রিয়ায় হারিয়ে ফেলবে। ক্ষমতার এই ক্ষমা করার অধিকারকে তিনি শুধু ক্ষমার অপব্যবহার হিসেবেই দেখেন না বরং এর ফলে একজন মানুষ ক্ষমার ক্ষমাত্বকেও ভুলে যান (forgiven forgiveness)।

ক্ষমা করার অধিকার অন্য কারো নাই। ক্ষমতা যদি ন্যায়ানুগ এবং বৈধও হয় ক্ষমা করার অধিকার তার নাই। ক্ষমার ঘটনা কখনোই ঘটতে পারে না যদি না কেউ ক্ষমা করার প্রকৃত এখতিয়া বা সার্বভৌম ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। তাকে ছাড়া অন্য কেউ এটা করার দাবি করতে পারেন না। কেউ যে কোনো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির মাধ্যমে অন্যের তরফে ক্ষমার অধিকার অর্জন করতে পারেন না।

তার পরেও ক্ষমার ঘটনা ঘটে। বিরল হলেও ঘটে। দেরিদা মনে করেন প্রকৃত ক্ষমা করার সাথে ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নাই বরং ক্ষমতাহীনতার সম্পর্ক আছে। ফলে মহাত্বা গান্ধি এই পয়েন্টে সঠিক বলেন নাই। ক্ষমা করা কোনোভাবেই শক্তিমানের পরিচায়ক হতে পারে না। কারণ সভারেন্ট বা সার্বভৌম ক্ষমতা মানুষের থাকে না। থাকতে পারে না। যদিও রাষ্ট্র এটা দাবি করে। যদি গান্ধি মানুষের মানুষকে ক্ষমা করার কথা বুঝায়ে থাকেন তা হলে তিনি ক্ষমার মূল পয়েন্ট মিস করে গেছেন। এই প্রশ্নে দেরিদা বলেন,

‘What I dream of, what I try to think of as the ‘purity’ of a forgiveness worthy of its name, would be a forgiveness without power: unconditional but without sovereignty.’

আমি কিসের স্বপ্ন দেখি? ক্ষমার নামে- বিশুদ্ধ ক্ষমা বলতে আমি কিসের চিন্তা করতে চেষ্টা করি? ক্ষমা হবে ক্ষমতাহীন: শর্তহীন কিন্তু সভারেন্টি বা সার্বভৌম ক্ষমতা ছাড়া।

ফলে ক্ষমার সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আমাদের আরও প্রশ্ন তুলতে হবে। ক্ষমাকে ক্ষমতার অধীন বা ক্ষমতামূলক ব্যাপার মনে করলে ক্ষমার হক নষ্ট হবে।

আমেরিকান দার্শনিক, মার্থা নাসবম যদিও আরেক ধরনের ক্ষমার কথা উল্লেখ করেছেন তার ‘Anger and Forgiveness’ বইতে। তিনি মনে করেন আমরা এখন ক্ষমার একটা যুগে বাস করছি। চারদিকে মোটিভেশনাল গুরুদের বিপুল আবির্ভাব ক্ষমাকে একটা থেরাপিটিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। মনোজাগতিক অসুখ সারানোর এক হাতিয়ারে পরিণত করেছেন ক্ষমাকে। কথায় কথায় সরি বলার প্রবণতা তো একটা কৌতুককর অবস্থায় চলে গেছে বহু আগেই। এমনকি ক্ষমতার প্রশ্নে, বিরোধী দল ও মতের বা সাবেক অত্যাচারীদের সাথে নেলসন মেন্ডেলার যে আচরণ সারা দুনিয়াতে প্রসংশা অর্জন করেছে তাকে মার্থা নাম দিয়েছেন, ‘transactional forgiveness’ এটা অনেকটা দেরিদার অর্থনীতিবাদি হিসেবে ক্ষমাকে চিহ্নিত করার মতোই। আদান-প্রদান বা লেনদেন হিসেবে ক্ষমাকে ব্যবহার অর্থে তিনি এই টার্মটি ব্যবহার করেন। আমাদের সামাজে যখন দেখি কথায় কথায় ক্ষমা চাওয়া হয়, তখন আসলে ক্ষমা মিন করা হয় না।

মহান দার্শনিক সক্রেটিস মনে করেন, সকল অন্যায়ের কারণ হলো, অজ্ঞানতা। তাই দর্শন ও শিক্ষার কাজ হলো সমাজ থেকে অজ্ঞনতা দূর করা। প্লেটোর রচিত সংলাপ নেমোতে সক্রেটিস মত দেন, মানুষ যখন অন্যায় করে তখন অন্যায়কে কোন না কোনোভাবে ভালো বা তার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেই করে, মন্দকে ভালো মনে করেই সে মন্দ কাজে শামিল হয়। এর মূলে আছে অজ্ঞানতা। তিনি মনে করেন, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় করে না। যেহেতু মানুষ ভালো করতে চায়, তাই দর্শনের কাজ হলো মানুষ যাতে ভালো করতে পারে সেই পথকে সুগম করা। যদিও অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের এই মত অতি নির্ধারণবাদী মন্তব্য বলে খারিজ করে দেন। সক্রেটিসের দর্শনে সরাসরি ক্ষমার বিষয়টা ব্যাপক ভাবে না আসলেও গ্রিসের আদালতে তার জবানবন্দি ‘ ইংরেজিতে ‘এপোলজি’ – নামের বই আকারে বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু সক্রেটিস জবানবন্দিতে ক্ষমার চাওয়ার প্রশ্নের দিকে যান নাই। বরং তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ট্রুথফুলনেস বা সত্যতা কোথায় তা বুঝতে চেয়েছেন। তবে এই ক্ষমার প্রশ্নে দেরিদার কণ্ঠে যেন আমরা সক্রেটিসের স্বর শুনতে পাই। ক্ষমা নিয়ে কথা বললে সক্রেটিস এই পয়েন্টেই আগুমেন্ট করতেন বলে- অনেক দেরিদা বিশেজ্ঞ মনে করেন।

দেরিদা তাঁর ‘on forgiveness’ লেখাতে খুবই যৌক্তিক ভাবে ক্ষমা নামক অ্যাক্ট বা কর্মকে বিচার করে দেখান- এটা যুক্তির সব বাউন্ডারি অতিক্রম করে যেতে জানে। দেরিদার লেখা-লেখি সাধারণত জটিলতার অভিযোগে অভিযুক্ত। চেষ্টা করা হয়েছে, যতটা সরলভাবে এই বিষয়ে দেরিদার চিন্তাকে হাজির করা যায়। অনেক লেখকের কাজ থেকে সাহায্যও নিয়েছি। সব চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ মিহাইল ইভানেসের কাছে। দেরিদার এই দার্শনিক পর্যবেক্ষণ শুধু দর্শন, আইন, নীতিবিদ্যাতেই না, বরং সাহিত্যেও প্রভাব বিস্তার করেছে। পুলিৎজার বিজয়ী ভিয়েতনামি-আমেরিকান ঔপন্যাসিক Viet Thanh Nguyen তার আলোচিত উপন্যাস ‘The Committed’ যা ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি দেরিদার ক্ষমার দর্শনকে চরিত্র নির্মানের কাজে ব্যবহার করেছেন বলে এক আলাপে জানিয়েছেন।

 

আমাদের ক্রমাগত প্রশ্ন তুলতে হবে, কে প্রকৃত পক্ষে ক্ষমা করার যোগ্য এবং ভিকটিমকে মনে রাখতে হবে যে, কোনো কাঠামোগত ক্ষমতার হাতে এটা গেলে সে ক্ষমা করার ক্ষমতাও এই প্রক্রিয়ায় হারিয়ে ফেলবে। ক্ষমতার এই ক্ষমা করার অধিকারকে তিনি শুধু ক্ষমার অপব্যবহার হিসেবেই দেখেন না বরং এর ফলে একজন মানুষ ক্ষমার ক্ষমাত্বকেও ভুলে যান

 

আমাদের সব সময় ক্ষমা বিষয়ে চলতি হুজুগী প্রবণতাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করতে হবে। এই বিষয়ে এখন অনেক কাজ হচ্ছে। তাদের কাজের দিকেও মনোযোগ ফেরানো যেতে পারে। তবে বিপুল মিসরিডিং -এর দেখাও পাওয়া যায় দেরিদার অন্য অনেক কাজের মতো এই কাজ নিয়েও। তবে ক্ষমার দর্শনকে বুঝতে দেরিদার অন্য কিছু ধারণাও আমাদের সাহায্য করতে পারে। যেমন, গিফ্ট, সিক্রেট, ফোর্স অব ল, এথিকস ইত্যাদি। এই প্রশ্নে দেরিদাকে খুবই গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার। এই বিষয়েও আমরা যেন কমনভাবে ধরে না নেই যে, ইতমধ্যে আমরা ক্ষমার বিষয়টি জানি বা জেনে গেছি। কারণ, ধারণাগত দিক থেকে ক্ষমাকে দেখবার যথেষ্ট ঘাটতি দর্শনে রয়ে গেছে। আমরা যখন ক্ষমা করি তখনও যেন মনে না করি ক্ষমাকে আমরা বুঝে গেছি। চিন্তার কাজ কোনকিছু ধরে নেয়া না। কোন কিছু থেকে পলায়ন করা না। বরং ক্রমাগত পর্যালোচনা ও প্রশ্ন জারি রাখা। আমরা আজকের মতো এই আলাপ শেষ করার আগে আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে একটু আলোচনা করে নিতে চাই।

আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে ক্ষমার বিষয়টা আলোচনা করার জন্য আরও কিছু বিষয় যুক্ত করা দরকার। ক্ষমার বিষয়টা আমরা বিচারিক দিক থেকে দেখার আগে দেখি ধর্মের দিক থেকে। ভারতীয় ধর্মপরিমণ্ডলে ক্ষমাকে সম্ভব করে তোলার আগে যে বিষয়টি প্রিকন্ডিশন বা পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে নেয়া হয় তার নাম–দয়া। দয়ার উদ্রেক করে ক্ষমার দিকে মনযোগ ফেরানো হয়। দয়া এখানে প্রেম-ধর্ম-ক্ষমা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় সমাজে এই দয়ার প্রথম উম্মেষ আমরা লক্ষ করি সতিদাহ প্রথা বিলুপ্তির সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। এবং এই দয়ার প্রশ্নে ধর্মকে নয়া ব্যাখ্যার আলোকে সমাজে হাজির করার প্রয়োজন পড়েছিল ( দেখুন: রণজিৎ গুহ; দয়া: রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা- বইটি)। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, যার দয়া নাই সে হিন্দুই না। বেঙ্গল রেঁনেসা নামে কলকাতায় ১৯ শতকে যে নবজাগারণ দেখা যায় তাতে দয়া আর ধর্ম হাতধরাধরি করে চলে। হিন্দু বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মানে ( মূলত বাবু শ্রেণীর পরিচয় তৈরিতে) -এই নয়া জাগরণ ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তখন দয়াকে সমাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার দরকার পড়েছিল কঠোর ও নিষ্ঠুর শাস্ত্রীয় বিধান থেকে বিশেষ করে নারী ও সাধারণ শ্রেণির মানুষকে রক্ষার জন্য।

অন্যদিকে ইসলামে অন্য আব্রাহামিক ধর্মের মতো ক্ষমার মাহাত্ম্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এখানেও চূড়ান্তভাবে ক্ষমা করার সার্বভৌম ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তার হলেও মানুষের গুরুত্ব এখানে এতোটাই বেশি যে, যদি কোন ব্যক্তির হক নষ্ট করা হয়, তবে আগে তার কাছে ক্ষমা আদায় করে নিতে হবে। না হলে সৃষ্টিকর্তাও তাকে ক্ষমা করবেন না। এখানে ডিভাইন সভারেন্টি সৃষ্টিকর্তা ও অনুসারীর মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে দেখা যায়। অন্যদিকে ইসলাম আবার কোন লোক দেখানো বিচার ও ক্ষমাকে গ্রহণ করেন না। ক্ষমা হতে হবে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। নিজের নফস বা মনকে সন্তুষ্ট করা বা লোকদেখানো ক্ষমার কোন গুরুত্ব নাই। ফলে ক্ষমার যে গোপন/সিক্রেট বিউটি তাকে ইসলাম গুরুত্ব দেয় এবং শেষ পর্যন্ত এর সার্বভৌম ক্ষমতা ঐশ্বরিক বলেই মানে। মানুষকে ক্ষমা করতে হলে ঐশ্বরিক সিফত বা গুনের পথে এগিয়েই এইটা অর্জন করতে হবে। মানুষের ক্ষমা করার ক্ষমতা অনেক শর্তের নিগড়ে আটকা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে সব কিছুর রেকর্ড থাকে। মানুষের কাজের সব রেকর্ড মানুষ চাইলেও সংরক্ষণ করতে পারে না। ফলে চূড়ান্ত সভারেন্টি মানুষ সংরক্ষণ করতে পারে না। ফলে ক্ষমার মাধ্যমে ন্যায় বা ইনসাফ কায়েম মানুষের পক্ষে যতটা কঠিন ঐশ্বরিকভাবে ততটা কঠিন নয়।

তার পরেও কে না জানে মানুষের নিষ্ঠুরতার সীমার চাইতে মহত্বের অসীমতা আরও ব্যাপক হতে পরে। হওয়া সম্ভব। আর যেকোনো সম্ভবনাও অসম্ভবের সাথে সম্পর্কিত। অসম্ভবের পাগলামির মধ্যেই সম্ভাবনা বিরাজ করে। দেরিদার কথা দিয়েই শেষ করি। ক্ষমার বিষয়টাকে তিনি মনে করেন,

‘This madness is perhaps not so mad …’

এই পাগলামি ঠিক এতোটা আবার পাগলও নয়…

 

( প্রথম খসড়া, ১২/৩/২৩, ঢাকা, বাংলাদেশ)

সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।

মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
Paypal https://paypal.me/jobanmedia

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নাম *