Joban Magazineযে-কোনো প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের গুলিভরা খুনি রাইফেলের চেয়ে ন্যায়পরায়ন গণতান্ত্রিক তারুণ্যের বুকে ঠাসা প্রতিবাদের বারুদ অনেক বেশি শক্তিমান -নূরুল কবীর

প্রিন্ট সংস্করণ/ইন্টারভেনশন/ তত্ত্বচিন্তা/ সমাজ ও রাজনীতি/ চলতি চিন্তা

যে-কোনো প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের গুলিভরা খুনি রাইফেলের চেয়ে ন্যায়পরায়ন গণতান্ত্রিক তারুণ্যের বুকে ঠাসা প্রতিবাদের বারুদ অনেক বেশি শক্তিমান -নূরুল কবীর

নূরুল কবীর

যে-কোনো প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের গুলিভরা খুনি রাইফেলের চেয়ে ন্যায়পরায়ন গণতান্ত্রিক তারুণ্যের বুকে ঠাসা প্রতিবাদের বারুদ অনেক বেশি শক্তিমান -নূরুল কবীর

নূরুল করীরের বাড়তি পরিচয় দরকার নাই।  বাংলাদেশে জনগনের পক্ষের চিন্তা ও মতামত উৎপাদনে তিনি বহুদিনের পরীক্ষিত চরিত্র। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে বিরল, ব্যতিক্রম এই মানুষটি ইতিহাস ও দর্শনের একনিষ্ঠ অনুশীলনকারী। যার কিছু কিছু ছাপ তাঁর লেখা-লেখিতে পাওয়া যায়। নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক পরিচয়ের বাইরেও তিনি লেখক ও চিন্তক হিসেবেও আমাদের জন্য  গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জিবনে বহু সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কিন্তু এটি তার সবচেয় দীর্ঘতম ও বিস্তারিত সাক্ষাৎকার। ফ্যাসিবাদি শাসন আমল থেকে শুরু করে গণঅভ্যুত্থানের বিষদ বয়ানসহ অনেক জরুরী প্রসঙ্গে বেশ লম্বা সময় ধরে, জবানের তরফে আপনাদের জন্য  এই আলাপটি করেছেন, জবান সম্পাদক; রেজাউল করিম রনি।

একটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার পদচ্যুতি তারপর ছোটবোনকে নিয়ে আগস্ট, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

নূরুল কবীর: বাংলাদেশে এই প্রথম বারের মতো সমাজের চেনা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তাঁদের সংগঠিত দলসমূহ ও সহযোগী সংগঠনের প্রত্যক্ষ প্রভাববলয়ের বাইরে, একদল তরুণ শিক্ষার্থীর চৌকষ নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সুগভীর সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে রূপ পরিগ্রহণ করার মাধ্যমে জনগণের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপেবসা একটি স্বৈরশাহীর পতন ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই অসমসাহসী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন একটি চরম স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর আত্মম্ভরী নেত্রীর অন্যায্য অহম ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে, তাঁকে পালিয়ে দেশত্যাগ করে তাঁর পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় শাসকশেণির আস্তানায় আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করেছে। ফলে, এই অবিস্মরণীয় ঘটনাকে আমি দেখি একটি গণতন্ত্রপরায়ন অনিরুদ্ধ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে একজন ক্ষমতালীপ্সু স্বৈরশাসকের নেতৃত্বাধীন একটি খুনি সরকারের অপরিহার্য পতন হিসেবে।

জুলাই-আগস্টের এই বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে লীগ-সরকারের পতনের পেছনে অবশ্য বিগত ১৫ বছরব্যাপী সংঘটিত বেদনাদায়ক সামাজিক-রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পশ্চাদপট হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। অতীতের নানা অসফল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সমাজে ক্রমশ যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও ক্ষোভের বিকাশ ও সঞ্চার ঘটে, সেই সচেতন বিক্ষুব্ধতার উচ্চতর সোপানের ওপরই প্রজ¦লিত হয়েছিল একটি সফল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের দীপ্ত মশাল, যার অগ্নিশিখায় স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার তখতে তাউস পুরে ছাড়খার হয়ে যায়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত, শেখ হাসিনার লীগ-সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এদেশে ফের প্রমাণীত হয়েছে যে, যে-কোনো প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের গুলিভরা খুনি রাইফেলের চেয়ে ন্যায়পরায়ন গণতান্ত্রিক তারুণ্যের বুকে ঠাসা প্রতিবাদের বারুদ অনেক বেশি শক্তিমান।

দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোদ্ধ গণঅভ্যুত্থানের মুখে আমিত্মবাদী রাজনীতিক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন এবং তাঁর চাটুকার দলীয় মন্ত্রীদের অপমানজনক অন্তর্ধানের মাধ্যমে ইতিহাসে আবারও প্রমাণীত হয়েছে যে- জনস্বার্থবিরোধী যেনো স্বৈরশাহীর অনাবশ্যক আস্ফালন ও আত্মম্ভরিতা শেষ পর্যন্ত তার জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে বাধ্য।

তৃতীয়ত, লীগ-সরকারের পতনের অব্যবহিত পর পরই লীগ-সংশ্লিষ্ট সকল লোভাতুর রাজনীতিক, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও তোষামুদে বুদ্ধিজীবী চক্রটির পলায়নের ঘটনায় কিংবা যাঁরা পালাবার সময় ও সুযোগ পাননি, তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য পরিত্যাগ কিংবা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে, ফের প্রমাণীত হয়েছে যে, পৃথিবীর যে-কোনো সরকারের জন্য তার চারপাশে নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত স্তাবক-সমাবেশ ঘটানো শেষ পর্যন্ত সেই সরকারের জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে না।

যে-কোনো দেশের যে-কোনো জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে, তার সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লড়াইকে, সফল করার জন্য প্রধানত সেদেশের মানুষকেই লড়তে হয় – এ কথাটা বোঝার প্রধান দায় ও সেই সংগ্রামকে যথার্থ নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব প্রধানত সংশ্লিষ্ট দেশ ও জনগোষ্ঠীর গণতন্ত্রকামী রাজনীতিকদের ওপরই বর্তায়।

সর্বোপরী, বোনকে নিয়ে শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে পৃথিবীতে আরেকটি সত্য আবারো প্রমাণীত হয়েছে যে, স্বৈরতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রণীত কোনো অন্যায্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তামূলক আইন গণতন্ত্রপরায়ণ গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে খরকুটোর মতো ভেসে যায়, জনতার রুদ্ররোষের কবল থেকে ইতিপূর্বে ক্ষমতাবান কোনো জনস্বার্থবিরোধী ব্যক্তি বা পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যায্য ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে, ২০০৯ সালে অক্টোবরে জাতীয় সংসদ এই মর্মে একটি ‘আইন’ প্রণয়ন করেছিল যে, শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানাসহ তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র ‘আজীবন’ ভিআইপি’র মর্যাদা ও তদরূপ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তাছাড়া, তাঁদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তাঁদের ‘মতামতকে প্রাধান্য’ দিয়ে ‘প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা’সহ ‘অন্যান্য সুবিধাদিও’ প্রদান করবে।

স্পষ্টতই, শিক্ষার্থী-জনতার রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মুখে পলাতক হাসিনা ও রেহানা এবং তাঁদের সন্তানদের এই সুবিধা প্রদান, গ্রহণ বা ভোগ করার বিষয়টি রীতিমতো অবান্তর হয়ে পড়ে। এ ঘটনা থেকে অবশ্য বাংলাদেশের ভাবিশাসকদের শিক্ষা নেয়ার সুযোগ অবারিত রইল।

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আন্দোলন সংগ্রামের মুখে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার লুটপাটজীবী পেটোয়া লীগ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে তোলা বিদ্যমান নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের দলবাজ কর্মকর্তাদের অবিশ্বাস্য পরাজয় পলায়ন কেমন করে সংঘটিত হতে পারল?

নূরুল কবীর: আপনার মনে থাকার কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের একদিন আগে, ৪ আগস্ট, তাঁর অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী জাহাঙ্গীর কবীর নানক প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে প্রকাশ্যে এই কথা বলে হুমকি দিয়েছিল যে, তাঁদের, অর্থাৎ লীগ ও সরকারের, ‘ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গেছে’। প্রকৃত পক্ষে, এ সব জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ নেতা উপলব্ধি করতেই অক্ষম হয়ে পড়েছিল যে, লীগ ও তার সরকারের দেড় দশকব্যাপী অন্যায়-অবিচার, লুট-পাট, গুম-গ্রেফতার, খুন-খারাবী ও সন্ত্রাসী তৎপরতার প্রেক্ষিতে এদের ব্যাপারেই ছাত্র-জনতার ধৈর্য্যরে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহী ছাত্র-জনতা ইতিমধ্যেই, বিশেষত পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াকু ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুবরণ করার মুহূর্তে থেকে, লীগের স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামের শেষ ধাপে পৌঁছে যায়। তাঁরা অতএব সরকার উৎখাতের জীবনপণ লড়াইয়ে নিজেদের নিয়োজিত করে এবং তাবৎ সরকারি গোলা-বারুদ, লাঠি-গুলি উপেক্ষা করে, অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে, সরকারের পতন নিশ্চিত করে। তবে, এটা সংশ্লিষ্ট সকলের উপলব্ধি করা জরুরি যে, লীগ সরকারের পতন কেবলমাত্র জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার বীরোচিত লড়াইয়ের ফসল নয়, বরং এই বিজয়ী সংগ্রাম ছিল দীর্ঘ দেড় দশক জুড়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার ছোট-বড় বহু সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে লীগ-সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি, লুটেরা অর্থনীতি, প্রভৃতির বিরুদ্ধে পরিচালিত বেশ কয়েকটি আপাত ‘অসফল’ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জনগণের ভেতরে সঞ্চারিত রাজনৈতিক চেতনা, গণতন্ত্রপরায়ন শিক্ষার্থীদের ন্যায্য সংগ্রামকে বিদ্রুপ ও খুন-জখমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার ঘৃণ্য সরকারি অপপ্রয়াসের মুখে আরো শাণিত রূপ পরিগ্রহ করে – যা তাঁদের প্রতিবাদী শিক্ষার্থী-আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। এমতাবস্থায়, নারী, পুরুষ, এমনকি শিশু-কিশোরসহ প্রায় সকল শ্রেনির মানুষ এ যাবৎকাল লীগ-নিয়ন্ত্রিত নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের খুনি কামান-বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের সক্রিয় সহযোগিতায়, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের পতনের জন্য মরনপণ সংগ্রামে লিপ্ত হন। শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা আকড়ে থাকার চেষ্টা করেন। হাসিনার ক্ষমতালীপ্সা এতই উদগ্র হয়ে উঠেছিল, ক্ষমতার মদমত্ততা তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল যে, দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে, দেড় সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরও ৫ আগস্টের সকাল ৯টায়, তিনি পুলিশ ও জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের গণভবনে ডেকে এনে, পুলিশ প্রধানের [অপ]কর্মতৎপরতার প্রশংসা করে, উপস্থিত অন্যদের সংগ্রামী জনতার ওপর আরো গুলিবর্ষণের উস্কানি দিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন রাজধানী শহরের নানা দিক থেকে প্রবল ঢেউয়ের মত অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের অগণিত লড়াকু মিছিল হাসিনাকে গদিচ্যুত করার জন্য তাঁর বাসভবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। জনগণের সে উত্তাল জাগরণের মুখে হাসিনার সশস্ত্র দলীয় বরকন্দাজ বাহিনী রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। তাছাড়া, জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রধানগণ আরো লাশের বিনিময়ে তাঁকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্য সরকারিভাবে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর টিমটি, প্রথমে হাসিনার ক্ষমতা প্রলম্বিত করার জন্য শক্ত অবস্থান গ্রহণ করলেও গণভবনের দিকে অগ্রসরমান বিক্ষুব্ধ জনতার বিশাল মিছিলের মুখে, তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধান করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে জানিয়ে দেয়। এমতাবস্থায়, মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলে যে হাসিনা আস্ফালন করেছিলেন, লীগ বিরোধী উত্তাল জন তরঙ্গের মুখে, সেই হাসিনাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তায়, তাঁর তাবৎ বিপদাপন্ন দলীয় নেতা-কর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ফেলে রেখে, কেবলমাত্র নিজের বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে, সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে ভারতে পালিয়ে যান।

এই বছরের জানুয়ারি মাসে তৃতীয় বারের মতো একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছিল। লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সরকার আরো পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ভেবে ভিষণ উৎফুল্ল ছিল, আর বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে নেমে এসেছিল প্রবল হতাশা। এমতাবস্থায়, গণঅভ্যুত্থানের মুখে লীগ-সরকারের পতনের পর জাতীয়তাবাদী দল সহ ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক শিবিরের অবস্থাকে কীভাবে দেখেন?

নূরুল কবীর: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা ও অঙ্গীকার রয়েছে, তাঁদের কেউ বাংলাদেশে গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের নামে যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাকে ‘নির্বাচন’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে না। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণভাবে সর্বজনগ্রাহ্য একটি নির্বাচন-ব্যবস্থা থাকে, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাভাজন নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ থাকে- যার দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান ও রীতি-নীতির ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আর মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় সকল দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আয়োজিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জনসাধারণ নির্বিঘ্নে তাঁদের প্রতিনিধি বেছে নেয়ার নিশ্চিত সুযোগ লাভ করেন।

বাংলাদেশে একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনব্যবস্থা গড়েই উঠতে পারেনি, ফলে, গত নির্বাচনের প্রাক্কালেও ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত উভয় শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে, গ্রহণযোগ্য অভিন্ন কোনো নির্বাচনী কর্তৃপক্ষও উপস্থিত ছিল না, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদপুষ্ট একটি কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী দল সহ ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ অংশগ্রহণই করেনি; লীগ শিবিরের যে দল বা গ্রুপগুলো অংশ নিয়েছিল, তাঁদের প্রত্যেকে নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে, প্রকাশ্য আসন-সমঝোতার ভিত্তিতেই শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। ফলে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই দেশি-বিদেশি সকলের কাছে নির্বাচনের ফলাফল নিখুঁতভাবে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার উপস্থিতির অন্যতম প্রধান উৎসই হলো দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার অনুপস্থিতি।

এমতাবস্থায়, দেশের বিপুল অধিকাংশ ভোটার জনসাধারণ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের ভোট-বর্জনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নির্বাচনের দিন ভোট-কেন্দ্র থেকে দূরে থাকেন। ওদিকে, নির্বাচনকে মেকিভাবে হলেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ দেখানোর ‘রাজনৈতিক প্রয়োজনে’, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পূর্বাহ্নেই নিজ দলের ‘মনোনীত’ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রায় সর্বত্র নিজ দলীয় ‘ডামি’ প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রকাশ্য হুকুম জারি করেছিল। ফলে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, ‘নির্বাচনটি’ দেশে-বিদেশে ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল।

সাধারণভাবে, এই ‘ডামি নির্বাচন’-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল রীতিমতো হতাশাজনক। লীগের নেতা-কর্মীরা আরো পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ করার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছে ধরে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু লীগের উৎফুল্লতা তার ‘ডামি নির্বাচনের’ মতই ভিত্তিহীন ছিল- নিছক লুটপাটের কাল প্রলম্বিত করার বিকৃত রাজনৈতিক অভিলাষের বাইরে এ উৎফুল্লতার কোনো তাৎপর্য ছিল না।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের অপরাপর দলগুলো, যারা সকলেই ‘দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বিধান পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে’ বহুবছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল, ‘ডামি’ নির্বাচনের মাধ্যমে লীগ ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তাদের শিবিরে নেমে এসছিল প্রবল হতাশা।

জাতীয়তাবাদী দল ও তার লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গীরা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিতব্য একদলীয়-একতরফা নির্বাচন বর্জন করার জন্য আগেই জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়েছিল, অন্যদিকে নিজেদের সংগ্রামের মুখে একদলীয় ‘ডামি নির্বাচন’কে ‘প্রতিহত’ করার মাধ্যমে, একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন-ব্যবস্থার বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা করার আশ্বাসও দিয়েছিল। এটা ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রপরায়ণ জনসাধারণ ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত জাতীয়তাবাদী দলসহ গোটা বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের ভেতর সম্পাদিত একটি অলিখিত ‘রাজনৈতিক চুক্তি’। দেশের গণতন্ত্রকামী ভোটার জনসাধারণের বিপুল অধিকাংশ ‘ডামি নির্বাচন’ বর্জনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু গোটা ‘ডামি নির্বাচন’ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার ঘোষিত ‘দায়’ পালনে জাতীয়তাবাদী দল ও তার রাজনৈতিক সঙ্গীরা ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর, আরো একটা প্রহসনমূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ স্বৈরতান্ত্রিকভাবে নিজেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পুনর্বহাল করতে পেরেছিল।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বারম্বার এ ধরনের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লীগ-নেতৃত্বকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংগঠনসমূহের পদস্থ কর্মচারীসহ সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী সমম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ এক বিরাট বাহিনীকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের স্বার্থে নিজেদের এই অন্যায়ভাবে ব্যবহৃত হওয়ার বিনিময়ে, সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এই বিশাল বাহিনীটি, আপন আপন পদমর্যাদা ও প্রভাব অনুযায়ী, নিজেদের জন্য অবৈধ বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলার অলিখিত ‘অধিকার’ আদায় করে নিয়েছে। ফলে, গোটা লীগ-আমল জুড়ে, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসন ভয়ঙ্কর দুর্নীতিচর্চার এক অদৃষ্টপূর্ব আখড়ায় পরিণত হয়েছিল- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাধরদের অবাধ লুটতরাজ আর অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাঁচার ছিল তার এক অবশ্যম্ভাবী বিষফল। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি ভেতরের দিক থেকে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির উপদ্রব আর তার সহজাত দ্রব্যমূল্যের নিরন্তর ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। আবার, এই জনস্বার্থবিরোধী গোটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে উচ্চকিত বিরোধী রাজনৈতিক শিবির ও ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ওপর নানা রকমের নিপীড়ন জারি ছিল। এই শোচনীয় বাস্তবতা সাধারণভাবে সমাজের ভেতর এবং বিশেষভাবে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের কর্মী-সমর্থকদের ভেতর প্রবল রাজনৈতিক হতাশার সঞ্চার করেছিল- যা বৈষম্যবিরোধী ও জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্রের জন্য সংঘটিত সাম্প্রতিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে লীগ সরকারের অপমানজনক পতনের মধ্যদিয়ে আপাতত দূরীভূত হয়েছে।

জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন বিরোধী শিবির তার রাজনৈতিক ‘দায়’ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে মনে করেন কেন?

নূরুল কবীর: বিরোধী শিবিরের সবচেয়ে বড় সংগঠন জাতীয়তাবাদী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই, জনগণের সাথে সম্পাদিত পূর্বোল্লেখিত ‘রাজনৈতিক চুক্তি’ ভেঙ্গে পড়ার জন্য প্রধানত দায়ী করা যায়। একদিকে জনসমর্থনপুষ্ট একটি ব্যাপক আন্দোলনকে তার যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাবার জন্য নেতৃত্বের যথার্থ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাশীলতার অভাব, অন্যদিকে বিদেশি মিত্রদের ওপর সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের প্রয়োজনাতিরিক্ত নির্ভরশীলতাই এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ছিল। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বিরোধী শিবিরের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রকৃত নেতৃত্ব এদেশের মাঠে-ময়দানে সক্রিয় রাজনীতিকদের হাতে ছিল না – বরং নেতৃত্বমূলক নির্দেশনা এসেছে জাতীয়তাবাদী দলের একাধিক প্রবাসী নেতার কাছ থেকে, যাঁরা একদিকে যেমন বয়সে তরুণ, জাতীয় পর্যায়ে সংগ্রাম পরিচালনার কলা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতাশূন্য, অন্যদিকে বহুবছর প্রবাসে থাকার কারণে নিজেদের কর্মীবাহিনীসহ সাধারণ মানুষের সমকালীন রাজনৈতিক মেজাজ বুঝতে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যাদের পরিচ্ছন্ন ধারণা রয়েছে, তাঁরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছেন যে, কয়েক লক্ষ কর্মী-সমর্থকদের বিশাল জনসভাকে সরকার, গত বছরের ২৮ অক্টোবর কিছু লীগ-কর্মী ও পুলিশের উস্কানির ফাঁদে ফেলে, পণ্ড করে দেয়ার চাতুর্যময় প্রয়াস গ্রহণ করতেই জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্ব হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ফলে, উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেই সভায় সমবেত কয়েক লক্ষ মানুষের ক্ষোভকে সরকারি অনাচারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভে পরিণত করার পরিবর্তে, আক্রমণকারী একটি ছোট্ট সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়ার বদলে, তাঁরা বরং যেনতেন প্রকারে পরের দিনের জন্য হরতাল আহ্বান করে তাৎক্ষণিকভাবে সভা সমাপ্তির ঘোষণা দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে এখানেই জাতীয়তাবাদী দলের মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ধরা পড়ে। ছাত্র-আন্দোলনের ওপর লীগ-সরকার ও লীগের দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সশস্ত্র নিপীড়ন নেমে এলে, জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সরকারি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় পর্যন্ত নিশঙ্ক চিত্তে লড়ে যায়। লীগ-সরকারের পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার ফাঁস হয়ে যাওয়া কথপোকথনের ভিডিও থেকে লড়াকু শিক্ষার্থীদের অকুতোভয় সংগ্রামের স্বরূপ খানিকটা অনুমান করা যায়। একজন খুনি পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলছেন, ‘স্যার, গুলি করি। মরে একটা। আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইডাই হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের।’ স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী দলের সংগ্রামে অসংখ্য তরুণের অসামান্য আত্মত্যাগের পরও বলা যায়, এই দলের তরুণরা লীগ-সরকারের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি। জুলাই-আগস্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ আহ্বানে নির্দলীয় তরুণরা, এক পর্যায়ে, শুধু দেশ ও সমাজের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক মুক্তি অর্জনের মহত্তর প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে লড়াইয়ে নেমেছিল – নিজেদের ব্যক্তিগত লাভালাভের ভাবনা তাঁদের বিবেচনায় ছিল না। ফলে, লড়াইয়ের ময়দানে নিজেদের ব্যক্তি-জীবনকে তুচ্ছ করে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে, নিরাপোষ সংগ্রামে মৃতুবরণ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী দলের সংগ্রামী কর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে বিন্দুমাত্র ছোট না করেও বলা যায়, তাঁদের সংগ্রামের পেছনে লীগের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে গদিচ্যুত করে ক্ষমতায় যাওয়ার সুনির্দিষ্ট দলীয় লক্ষ্যও খানিকটা ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির বিবেচনা খানিকটা হলেও প্রশ্ন সক্রিয় ছিল। এসব হিসেব-নিকেশ একটি খুনি রাষ্ট্রের লক্ষ্যভেদী বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়াতে সবসময় যথেচ্ছ মাত্রায় প্রাণীত করে না।

রাজনৈতিক দলের নেতা নির্বাচনের দায়িত্ব অতএব দলীয় কর্মীদের ওপরই ন্যস্ত থাকা প্রয়োজন এবং দলের সুস্থ ও শক্তিমান অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্যই তা প্রয়োজন।

যাই হোক, ২৮ অক্টোবর থেকে বিরোধীদলগুলো ১২ দফায় ২৪ দিন ‘অবরোধ’ ও পাঁচ দফায় ছয়টি হরতাল কর্মসূচি পালন করেছিল, সেসব কর্মসূচির প্রতি দেশের সাধারণ মানুষ শুরুতে সক্রিয় সহানুভূতি প্রদর্শনও করেছিল, কিন্তু ঢাকার রাজপথে বিরোধী শিবিরভুক্ত নেতা-কর্মীদের প্রবল ও প্রতিবাদী উপস্থিতির অভাব লক্ষ করে, মানুষ ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে নিষ্প্রাণ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। স্বভাবতই, বিরোধী শিবিরের সংগ্রাম তার ইতিবাচক পরিণতি লাভে ব্যর্থ হয়।

এমতাবস্থায়, ১৫ নভেম্বর, লীগ-সরকারের ইচ্ছাধীন ‘কমিশন’টি নির্বাচনের ‘শিডিউল’ ঘোষণা করে দিয়েছিল। ওদিকে, অনুচ্চ তালের হরতাল-অবরোধের সিরিজ শেষে, ২১ ডিসেম্বর থেকে কয়েকদিন, জাতীয়তাবাদী দলের দিশাহীন নেতৃত্ব দেশের নাগরিকদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ‘লিফলেট বিলি’ করার মতো একটি অতি নিরীহ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে। সর্বোপরি, ঐ লিফলেটে এমন কোনো বক্তব্যই ছিল না, যা এদেশের মানুষ ইতিমধ্যেই জানতেন না, বা ইতিপূর্বে বুঝতে পারেনি। জাতীয়তাবাদী দলের এহেন রাজনৈতিক বিহ্বলতার সুযোগে, আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার সারা দেশে বিেেরাধী দলটির সকল স্তরের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সত্যাসত্য নানা অভিযোগ এনে, তাঁদের অধিকাংশকেই কারারুদ্ধ করে ফেলেছিল। এভাবে, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরভূক্ত নেতা-কর্মীদের কারাগারে রেখে, লীগ-সরকার নিজের বশীভূত রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবহার করে তার পূর্বপরিকল্পিত ‘ডামি নির্বাচন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

কিছু প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রের কুটনীতিকগণ বরাবর একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর চাপ জারি রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁরা জাতীয়তাবাদী দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার জন্য দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিবে -এমন কোনো আশ্বাস দেয়নি, দিতেও পারে না। তথাপি, যে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লীগ-প্রশাসনের ভোটাধিকার ও মানবাধিকার-খর্বী কার্যকলাপের জন্য যেসব রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা জারির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল, পরিবর্তিত নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, দৃশ্যতই, তারা সেই অবস্থান থেকে সরে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে, একদিকে জাতীয়তাবাদী দলের ভ্রান্ত আন্দোলন-কৌশল যেমন দায়ী ছিল, অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র ভারতের লীগ-পক্ষাবলম্বী আন্তর্র্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করার জন্য ভারত-সরকারের প্রতি লীগ-নেতৃত্বের সবিনয় নিবেদনের কথা লীগ-সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী, আব্দুল মোমেন, ১৮ আগস্ট ২০২২, নিজেই দেশবাসীকে জানিয়ে বলেছিলেন যে, কদিন আগে দিল্লী সফরের সময়, তিনি ‘শেখ হাসিনাকে [ক্ষমতায়] টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ’ করেছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ লীগের সে অনুরোধ রক্ষা করেছিল। এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর, ‘নির্বাচনের’ প্রাক্কালে, ভারত কর্তৃক ‘তলে তলে’ লীগের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার খবর জানিয়ে, লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সেতুমন্ত্রী, ওবায়দুল কাদের, ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর, এক প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, “দিল্লীকে ওয়াশিংটনের দরকার, দিল্লী আমাদের সঙ্গে আছে। [আমাদের] কোনো সমস্যা নেই।” লীগ-সম্পাদক সেদিন সঠিক তথ্যই পরিবেশন করেছিলেন। কেননা, মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ ও ‘স্বাধীন নির্বাচন’ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য দায়ী লীগ-সরকারের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর প্রতিশ্রুত ভিসা-নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্বঘোষিত প্রক্রিয়া হঠাৎ করেই স্থগিত করে দিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ঐ আচরণে আমাদের অবশ্য খুব আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। নিজের কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে বন্ধু পরিবর্তন করতে, কিংবা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও স্বৈরশাসকদের সাথে হাত মেলাতে, খুব সময় নেয় না। তাছাড়া, নৈতিকতার দিক থেকে, যুক্তরাষ্ট্র আপন স্বার্থে হামেশাই দ্বিচারিতার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। ইউক্রেন ও প্যালেস্টাইনের প্রতি ওয়াশিংটনের পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির কথাই ধরুন না কেন। ইউক্রেনে ‘সামরিক আগ্রাসন চালানো’র ও সেখানে ‘বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা’র অপরাধে, হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক আদালত যখন রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে, যুক্তরাষ্ট্র তখন তাতে সোৎসাহে সমর্থন জানায়, কিন্তু একই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের’ প্রসিকিউটর যখন প্যালেস্টাইনি ভূমি জবরদখল ও সেদেশে গণহত্যা চালানোর অপরাধে জায়নবাদী ইসলাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আবেদন জানান, যুক্তরাষ্ট্র তখন সেই আদালতের অস্তিত্বের বৈধতা ও এখতিয়ার নিয়েই প্রশ্ন উত্থাপন করে – আদালতের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারির হুমকি প্রদর্শন করে। পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধাবাদী সুসম্পর্কের কথাও সারা দুনিয়া অবগত রয়েছে। ফলে, দক্ষিণ এশিয়ায় বিকাশমান জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো নতুন প্রেক্ষাপটে, আপন স্বার্থে, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ-নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকারের প্রতি সমর্থনসূচক অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ-নীতির আকস্মিক পরিবর্তনের প্রশ্নে বলে রাখা প্রয়োজন যে, জাতীয়তাবাদী দল, কিংবা সেই দলের বৈদেশিক-সম্পর্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত রাজনীতিবিদগণ, ওয়াশিংটন ও দিল্লীকে নিরপেক্ষ রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। অন্য কথায়, ওয়াশিংটন ও দিল্লী বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলে সক্রিয় তাদের বিশ্বস্ত বন্ধুদের রাজনৈতিক স্বার্থ সেদিন পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে।

এদিকে, রাশিয়া, চীন ও ইরানের মত দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ছাড়া, আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী অন্য কোনো দেশের সরকার লীগের প্রহসনমূলক ‘ডামি নির্বাচনের ব্যাপারে সপ্রশংস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। ভারতের কথা অবশ্য আলাদা- কথিত নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত ফল ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ‘টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচত হওয়ার জন্য’, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন। স্পষ্টতই, হিন্দুত্ববাদী মোদীর নেতৃত্বাধীন বর্ণবাদী ভারত পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে নারাজ।

এ ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট সকলের উপলব্ধি করা প্রয়োজন, যে-কোনো দেশের যে-কোনো জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে, তার সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লড়াইকে, সফল করার জন্য প্রধানত সেদেশের মানুষকেই লড়তে হয় – এ কথাটা বোঝার প্রধান দায় ও সেই সংগ্রামকে যথার্থ নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব প্রধানত সংশ্লিষ্ট দেশ ও জনগোষ্ঠীর গণতন্ত্রকামী রাজনীতিকদের ওপরই বর্তায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কখনোই তার ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই।

 

জাতীয়তাবাদী দলের অসফল অক্টোবর-আন্দোলনের পর পর দলটির পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে সংগঠনটির নেতৃত্ব কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই, কোন রাজনৈতিক শিবিরের প্রত্যক্ষ প্রভাবমুক্ত লড়াকু সংগ্রামের মুখে লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। এখন, সফল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী দল কতটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন?

নূরুল কবীর: দেখুন, ঠিক কী কারণে তখন হঠাৎ করে জাতীয়তাবাদী দলের ‘পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে’ নেতৃত্বকাঠামোতে ব্যাপক ‘পরিবর্তন’ আনা হয়েছিল, দলটির শীর্ষ-নেতৃত্ব সেটা জনগণের সামনে, এমনকি দলীয় নেতা-কর্মীদের সামনেও স্পষ্ট করে তুলে ধরেননি। এদেশের মূল ধারার গণমাধ্যম ও নানা সামাজিক মাধ্যমে বর্ণিত জল্পনা-কল্পনা থেকে আমরা অনুমান করেছি যে, দলটির ডিফেক্টো শীর্ষ নেতা, তারেক রহমান, বিগত অক্টোবর সংগ্রামে যাঁরা ‘প্রবল’ ভূমিকা পালন করেছেন ও নানা সরকারি জুলুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের ‘প্রমোশন’ দিয়েছেন; আর যারা ‘দুর্বল’ ভূমিকা পালন করেছেন কিংবা ‘সন্তোষজনক’ ভূমিকা পালন করেননি, তাঁদের কাউকে কাউকে ‘ডিমোশন’ দিয়েছেন বা নেতৃত্বের পদ থেকে অপসারণ করেছেন। এক্ষেত্রে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নিশ্চয় সদিচ্ছাপ্রসূত ছিল, কেননা কারো পক্ষেই নিজ দলের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যর্থতা কিংবা বিপর্যয়ের জন্য, সরকারি নিপীড়নের বাইরে, অন্য কাউকে দায়ী করে ‘ডিমোশন’ দেয়ার আগে, শীর্ষ নেতৃত্বকেই তো নৈতিকভাবে সে ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ করতে হয়, আত্মসমালোচনা করতে হয়, এমনকি নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে হয়, অন্তত সরে যাবার প্রস্তাব তো করতে হয়। আমার জানামতে, জাতীয়তাবাদী দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন কোনো প্রস্তাব সেদিন আসেনি। আমি তো আগেই বলেছি, এবং জেনেই বলেছি, বিগত অসফল আন্দোলনের নেতৃত্বমূলক নির্দেশনা এসেছে একাধিক প্রবাসী নেতার একাধিক কেন্দ্র থেকে – যাঁদের জীবনে একদিকে, জাতীয় পর্যায়ে কোনো সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়নি, অন্যদিকে নানা বাধ্যবাধকতার কারণে দীর্ঘদিন প্রবাসী জীবনযাপনের ফলে দেশের ভেতরে মাঠের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি, নিপীড়িত নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক মনোভাব এবং সর্বোপরী, একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে দুবৃত্তায়ীত জাতীয় অর্থনীতির নির্মম শিকার সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পোষণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায়, বিদেশ-বিভূঁই থেকে আসা বাস্তবতা-বিবর্জিত ‘নির্ধারক নির্দেশনা’র ভিত্তিতে পরিচালিত সংগ্রামের সাফল্যে বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব। বাস্তবেও তাই ঘটেছে। যে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ তোড়ে সৃষ্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার লীগ-সরকারের পতন ঘটেছে, সে আন্দোলন বিকাশের প্রথম পর্যায়ে, সংগঠন হিসেবে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। আন্দোলনটি যখন হঠাৎ বেগবান হয়ে ওঠে, জুলাইয়ের মধ্যভাগে, তখন ছাত্রদলের অনেক কর্মী ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রামী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, মৃত্যুবরণও করেছেন। জাতীয়তাবাদী দরের নেতৃবৃন্দ তখনও তাঁদের কার্যক্রম ছাত্র-আন্দোলনের ‘নীতিগত সমর্থনের’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন এক-দফা দাবিতে, অর্থাৎ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়, ৩ আগস্ট, তখনই কেবল ছাত্র দলের কর্মীরা, সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে, সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকশ’ ছাত্র দল কর্মী পুলিশী নির্যাতনে খুন-জখমের শিকার হয়েও লড়াইয়ের ময়দানে শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেন। সময়োচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতার কারণেই, ছাত্র দলের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের পরও, এই বিজয়ী সংগ্রামে তাঁদের কোন নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা বা আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব ছিল না।

যাই হোক, একথা সত্য, জাতীয়তাবাদী দলের গঠনতন্ত্র দলীয়-প্রধানকে এককভাবে সংগঠনের নানা পর্যায়ের কমিটি গঠন, বিলুপ্তি ও পরিবর্তনের ‘ক্ষমতা’ দিয়েছে। ফলে, দলের শীর্ষ নেতা তাঁর এই ‘ক্ষমতা’, যদিও মর্মের দিক থেকে তা পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক, প্রয়োগ করতেই পারেন এবং তিনি হামেশা তা করেও থাকেন। সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র দলীয়-প্রধানকে এ ‘ক্ষমতা’ প্রদান করেনি, কিন্তু বাস্তবে লীগ-প্রধানও সংগঠনের নানা স্তরে নেতৃত্ব মনোনয়নে কিংবা কমিটি গঠনে চূড়ান্ত অনুমোদন দানের এই অগণতান্ত্রিক ‘অধিকার’ বরাবর সংরক্ষণ ও চর্চা করেছেন। বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার উপস্থিতির অন্যতম প্রধান উৎসই হলো দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার অনুপস্থিতি।

রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা ও নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের আবশ্যকতাকে আইনগত বাধ্যবাধকতার অধীনস্থ করার জন্যও দাবি উত্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের মানুষকে যথার্থই উপলব্ধি করতে হবে যে, তেতো নিম গাছ অন্যভাবে উপকারী হলেও তা সুমিষ্ট আম ফলায় না, কিংবা সুউচ্চ সবুজ দেবদারু বৃক্ষও বটের শীতল ছায়া দিতে অক্ষম।

নানা স্তরের দলীয় কর্মকর্তাদের ‘প্রমোশন’, ‘ডিমোশন’ কিংবা ‘অপসারণের’ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব কি মানদণ্ড ব্যবহার করেছেন- আমরা তা জানি না। অনুমান করি, তিনি এ ব্যাপারে দলের ভেতর তাঁর আস্থাভাজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছেন। সে ক্ষেত্রেও, প্রশ্ন থেকে যায়, তাঁর বিশেষ আস্থাভাজন সহকর্মীরাই-বা পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে কী কী মানদণ্ডের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। লক্ষ করুন, জাতীয়তাবাদী দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় প্রমোশনপ্রাপ্ত একজন নেতা, যিনি দলটির মুখপাত্র হিসেবেও পরিচিত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন গড়ে ওঠার দিনগুলিতে এই আন্দোলনের অন্তর্লীন চেতনা ও চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে এতই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন যে, তিনি ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলন দানা বেধে ওঠার পরও, ১০ জুলাই, এই গণতন্ত্রপরায়ন সংগ্রামকে একটি গণবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা মনে করেছিলেন – সংগ্রামটিকে ভারতের সাথে লীগ-সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের কারণে সৃষ্ট ছাত্র-জনতার ক্ষোভ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ার সরকারি চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল। এই নেতাজির এহেন বিভ্রান্তিমূলক পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে আমরা আমাদের পত্রিকায়, নিউ এইজ, সম্পাদকীয় লিখেছিলাম।

কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নেতা/কর্মকর্তার জন্য জবাবদিহিতাবিহীন একক ক্ষমতা-চর্চা আনন্দদায়ক হতে পারে, কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট নেতার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। কেননা, এ রকম ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট দল বা প্রতিষ্ঠানের কোনো সাফল্যের জন্য শীর্ষ নেতা পরিপূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন ঠিকই, কিন্তু কোনো বৈফল্যের দায়ভারও একাকী তাঁকেই বহন করতে হয়। দেখতেই পাচ্ছেন, কর্তৃত্বপরায়ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন লীগ-সরকারের অপমানজনক পতনের পর, পতিত সরকারের সুবিধাভোগী কোনো নেতা-নেত্রীই পতনের দায় নিচ্ছেন না, পলাতক ও গ্রেফতারকৃত সকলেই শীর্ষ নেত্রীর একাধিপত্যতামূলক আচরণকেই দলীয় বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করছেন।

কোনো দেশের কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরে যথোপযুক্ত নেতা নির্বাচনের যুক্তিযুক্ত উপায় হলো, সংশ্লিষ্ট দলটির সকল সাংগঠনিক স্তরে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে, একাধিক প্রার্থীর ভেতর থেকে কর্মী বা প্রতিনিধিদের ভোটের ভিত্তিতে ‘নেতা’ বাছাই করার ব্যবস্থা জারি রাখা। কেননা, নির্দিষ্ট দলের নির্দিষ্ট অঞ্চলের নিবেদিত কর্মীরাই শুধু জানেন, তাঁদের নিজেদের এবং সে অঞ্চলের জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য উপযুক্ত ‘নেতা’ কে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নির্বাচনের দায়িত্ব অতএব দলীয় কর্মীদের ওপরই ন্যস্ত থাকা প্রয়োজন এবং দলের সুস্থ ও শক্তিমান অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্যই তা প্রয়োজন।

রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দি বড় বড় রাজনৈতিক দলের নানা পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা যখন সংশ্লিষ্ট কর্মীদের অধিকারে থাকে না, তখনই নেতৃত্ব দখলের প্রক্রিয়ায় আর্থিক দুর্নীতি চর্চার সংস্কৃতি তৈরি হয় – শীর্ষ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ ওপরের স্তরের প্রভাবশালী নেতাদের পকেট ভারি করে নিচের স্তরের নেতৃত্বমূলক পদ-পদবি দখল করার সংস্কৃতি চালু হয়। এই দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থার প্রতি শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত অনিহা থাকলেও, কিংবা এই ব্যবস্থা থেকে তিনি নিজে বৈষয়িকভাবে লাভবান না হলেও তাঁর পক্ষে এ সংস্কৃতির কুপ্রভাব থেকে দলকে রক্ষা করার সুযোগ থাকে না। কেননা, কমিটি ‘কেনা-বেচার সংস্কৃতি’র কারণে সংগঠনের নানা স্তরের নেতৃত্ব প্রায়শই দলের সুবিধাবাদী বিত্তবানদের করতলগত হয়ে পড়ে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ এই অসুস্থ সংস্কৃতির শিকারে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘদিন রাষ্ট্র-ক্ষমতার বাইরে থাকলেও, জাতীয়তাবাদী দলও একই অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়েছে। এই অপসংস্কৃতির কুপ্রভাবে যে-কোনো সংগঠনের নিবেদিত নেতা-কর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তার পরিনাম হিসেবে সংগঠনগুলো ভেতরের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে- যা একদিকে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের, অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।

এমতাবস্থায়, জাতীয়তাবাদী দলের নানা স্তরে আনীত অক্টোবর-আন্দোলন পরবর্তী পরিবর্তন, যা দলের ভেতর নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠিত হয়নি, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্ত্তি গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রয়াসকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিতে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ইতিমধ্যেই আমরা বেদনার সাথে লক্ষ করছি যে, লীগ-সরকারের পতনের মাধ্যমে সারাদেশের যে সকল স্থানের অবৈধ চাঁদাবাজি, দখল দারিত্ব, ইত্যাদি লীগমুক্ত হয়েছে, সে-সব জায়গাগুলি জাতীয়তাবাদী দলের নেতা-কর্মীরা আপন দখলে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে – শীর্ষ নেতৃত্বের বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও অবৈধভাবে পুনর্দখলমূলক অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে – একটি স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে লীগ-সরকারের পতন ও পলায়নের প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে এ মুহূর্তে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জাতীয়তাবাদী দলের বিজয়ের নিরঙ্কুশ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ দেশের একজন গণতন্ত্রপরায়ণ নাগরিক হিসেবে আমি বরং এই মর্মে উদ্বিগ্ন যে, একটি স্বৈরতান্ত্রিক লুটেরা সরকারকে আামাদের ইতিহাস যদি শেষ পর্যন্ত একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিবর্জিত কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে, তাহলে বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কতটা গণতন্ত্রায়ন সম্ভব হবে! আমাদের দেশে গণতন্ত্র-সম্ভবা ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের গর্ভপাত ঘটার ইতিহাস রয়েছে। বারম্বার একই পরিণতি বরণ করার মধ্যে একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিনামদর্শীতার পরিচয় বহন করে না। ফলে, আমি মনে করি, একটি স্বৈরতন্ত্রবিরোধী অবিস্মরণীয় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ইতিবাচক রূপান্তরকামী সময়ে, রাষ্ট্র-ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের যাবতীয় দাবির পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রায়ণের দাবিটিও সংশ্লিষ্ট কর্মীমহল ও জনগনের চেতনায় কার্যকরভাবে সঞ্চারিত করা প্রয়োজন। এমনকি, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা ও নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের আবশ্যকতাকে আইনগত বাধ্যবাধকতার অধীনস্থ করার জন্যও দাবি উত্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের মানুষকে যথার্থই উপলব্ধি করতে হবে যে, তেতো নিম গাছ অন্যভাবে উপকারী হলেও তা সুমিষ্ট আম ফলায় না, কিংবা সুউচ্চ সবুজ দেবদারু বৃক্ষও বটের শীতল ছায়া দিতে অক্ষম।

 

সদ্য সংঘটিত বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে নানা রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি সমাজে নানা রকম ন্যারোটিভ বা বয়ান হাজির করছে। আপনি এই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র পরিষদের’ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য, ন্যায্যতা তাঁর বিরুদ্ধে লীগ-সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী পদক্ষেপগুলিকে কীভাবে দেখেন?

নূরুল কবীর: দেখুন, আমি পরিপূর্ণভাবে একজন রাজনীতিমনষ্ক সাংবাদিক। সাংবাদিকতাকে আমি একটি রাজনৈতিক তৎপরতা হিসেবেই বিবেচনা করি। সাংবাদিকতা চর্চায় আমি বরাবর দল-নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছি, কিন্তু মুহূর্তের জন্যও ‘রাজনৈতিক-ভাবাদর্শ-নিরপেক্ষ’ সাংবাদিকতায় লিপ্ত হইনি। আবার, ইতিহাস চর্চা আমার বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক প্রেরণার অন্যতম উৎস হিসেবে সক্রিয় থাকে। একদিকে, কিছু সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবাদর্শের আলোকে গণতন্ত্রপরায়ন সাংবাদিকতা, অন্যদিকে আমাদের সামষ্টিক ইতিহাসের পাঠ, পুনর্পাঠ ও নতুন গবেষণার ভিত্তিতে সে ইতিহাসের বয়ানের জনস্বার্থপরায়ন পুনর্নির্মাণ আমার অভিষ্ঠ। ফলে, আমাদের চোখের সামনে সংঘটিত একটা বড় ছাত্র-গণআন্দোলনের ভেতর-বাহির সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, এমনকি শারীরিকভাবেও, সম্যক অবগত থেকেই আমি ও আমার সহকর্মীরা এই লড়াই-সংগ্রাম সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য পরিবেশন ও প্রকাশিত তথ্যের বিশ্লেষণ হাজির করেছি এবং গণতন্ত্রপরায়ন এই সংগ্রামের প্রতি পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে আমাদের ভাবাদর্শগত পক্ষপাত প্রকাশ করেছি। সে-সব অভিজ্ঞতার আলোকে এই সংগ্রামটিকে আমি যেভাবে দেখেছি ও বুঝেছি এবং তার ভিত্তিতে আমার মননের ভেতর এই লড়াকু সংগ্রামের যে অবয়ব নির্মিত হয়েছে, তা আপনার সাথে শেয়ার করতে পারি। এই পর্যবেক্ষণকে সদ্য সংঘটিত বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের একটি খসড়া বয়ান হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। তবে একটি সাক্ষাৎকারের পক্ষে তা, আয়তনের দিক থেকে, একটু লম্বা হয়ে যাবে বৈকি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের চাকরি কোটা সংস্কার আন্দোলনটি, যা মর্মের দিক থেকে ছিল রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, একই সাথে ছিল একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রাম। ২০১৮ সালে সূচিত এই সংগ্রামটি শুরুর অর্ধযুগ পরে, এ বছরের মধ্য-জুলাইতে তা রক্তাক্ত রূপ পরিগ্রহ করে – যে রক্তারক্তির প্রধান দায় ক্ষমতাচ্যুত লীগ-সরকারের, বিশেষত সরকারের পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘাড়ে বর্তায়। একটি অতীব ন্যায্য সংগ্রাম দমনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ-সরকার মধ্য জুলাইতে সংগ্রাম শুরুর এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ন্যূনতম তিন শতাধিক নিরস্ত্র শিশু-কিশোর-তরুণ ও প্রবীণ নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করেছে, যা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে- স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানি ঘাতক সামরিক জান্তা ছাড়া -কোনোদিন কোনো সরকার সংঘটিত করেনি। এহেন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পর পৃথিবীর কোনো সরকারেরই এক মুহূর্তও রাষ্ট্রক্ষমতা আকড়ে থাকার ন্যূনতম নৈতিক অধিকার থাকে না। লীগেরও ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কারণে ছাত্র-জনতার লড়াইটি প্রলম্বিত হয় এবং ৫ আগস্টে ক্ষমতাচ্যুতি পর্যন্ত, তিন সপ্তাহে, আরো কয়েকশ প্রাণ রাস্তায় ঝরে পড়ে। সেপ্টেম্বরের শেষাবধি, নতুন সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ১৫৮২ জনে পৌঁছেছে। তাছাড়া, এক হাজারের অধিক প্রতিবাদী মানুষ পুলিশের ছররা গুলির আঘাতে চিরতরে দৃষ্টি হারিয়েছেন, শরীরে গুলিবিদ্ধ কয়েকশ মানুষের হাত কিংবা পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। আন্দোলনের সময় সরকারি বাহিনীর লাঠি ও গুলির আঘাতে আহতদের ভেতর থেকে মৃতের সংখ্যা এখনো বেড়েই চলেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জেনারেল এরশাদের সামরিক-স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামের নয় বছরে, ৮০’র দশকে, ২৬ জন মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। ইতিপূর্বে, পাকিস্তানী জামানায়, জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময়, ৬০ এর দশকে, এদেশের ৬১ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। স্পষ্টতই, ক্ষমতালিপ্সু লীগ সরকার এদেশের গণতন্ত্রপরায়ন জনতার বিরুদ্ধে একটা গণহত্যা পরিচালনা করেছে। ইতিহাসের কাছে এ এক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

এবারের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তার ন্যায্যতা দিয়ে শুরু করবেন কি?

নূরুল কবীর: এবারের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটে এ বছরের জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে, জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রদত্ত একটি কোর্ট-রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুনরুত্থানের মাধ্যমে।

সরকারি চাকরিতে কোটা-সংস্কারের দাবিতে প্রথমে যখন আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ২০১৮ সালের এপ্রিলে, তখন বিদ্যমান চাকরির কোটা বিন্যাস অনুযায়ী, ৫৬ শতাংশ চাকরি জনগণের বিভিন্ন অংশের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সংরক্ষিত কোটায় ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও তার সন্তান-সন্ততি, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলাভিত্তিক প্রার্থী, ৫ শতাংশ ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’ ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে, আর বাকি ৪৪ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের বিধান বিদ্যমান ছিল।

পাকিস্তানি নয়া-উপনিবেশবাদী হানাদার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি স্বাধীনতাকামী জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে উত্থিত বাংলাদেশের যাত্রার শুরুতে, ১৯৭২ সালে, প্রথম সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। আমি মনে করি, ইতিপূর্বে উপনিবেশিক শাসন-সৃষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার গণতান্ত্রিক প্রয়োজনে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত করার উদেশ্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে সমাজের পিছিয়ে থাকা ‘অনগ্রসর’ অংশের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ সংরক্ষন করা অপরিহার্য ছিল। রাষ্ট্রীয় সংবিধানে গৃহীত এই ব্যবস্থার অধীনে, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে, সরকারি চাকরিতে মাত্র ২০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, আর ৮০ শতাংশই নানা কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হতো। এই ৮০ শতাংশের মধ্যে ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক প্রার্থী, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী ও ১০ শতাংশ নারী প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ ছিল।

পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৬ সালে, মেধাভিত্তিক নিয়োগ ৪০ শতাংশে উন্নীত হয় এবং তা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। আবার, ১৯৮৫ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনির পদে মেধাভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যা ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয় এবং বাকি ৫৫ শতাংশ কোটাভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা বলবৎ করা হয় এবং ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। তারপর, ২০১২ সালে, প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য এক শতাংশ বরাদ্দের পর, মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিমাণ ৪৪ শতাংশে স্থির হয়।

যখন কোন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ছাত্র-গণআন্দোলনের সময় মায়েরা তাঁদের নিরস্ত্র তরুণ সন্তানদের সশস্ত্র পুলিশের সাথে রাস্তার লড়াইয়ে প্রাণীত করেন, নিজেরাই রাজপথে দাঁড়িয়ে লড়াইরত সন্তানদের সাহস যোগান, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে, লড়াইয়ের ময়দান ত্যাগ না-করা লড়াকু তরুণদের রাজপথেই খাদ্য ও পানীয় যোগান, তখন সেই ছাত্র-গণআন্দোলন কোনোভাবেই পরাজিত হতে পারে না

সাংবিধানিক নীতির অধীনে ‘অনগ্রসর’ জনগোষ্ঠিভুক্ত মানুষকে বিশেষ আনুকুল্য দিয়ে সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার পথ নির্মান করা নিশ্চয় একটি ন্যায্য পদক্ষেপ। এই নীতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে যথাযথভাবেই কোটাভিত্তিক সংরক্ষণের পরিমানের ভেতর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এমতাবস্থায়, কোটাপদ্ধতি প্রবর্তনের ৪৬ বছর পর এবং ১৯৮৫ সালে সর্বশেষ কোটা সংস্কারের ৩৩ বছর পর, ২০১৮ সালের এপ্রিলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কোটা ব্যবস্থার আরেকবার, অর্থাৎ যুগোপযোগী, সংস্কারের দাবিতে সংগ্রাম গড়ে তোলে। লক্ষ্যণীয় যে, প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ মোটেও ‘কোটা ব্যবস্থার বাতিল’ দাবি করেনি, যুযোপযোগী ‘সংস্কার’ দাবি করেছিল মাত্র। কিন্তু লীগ-সরকার, কোন রকমের যুক্তিপূর্ণ কারণ উল্লেখ না করে, তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে, যে সংগঠনের অসংখ্য সদস্যের বিরুদ্ধে সারাদেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মেয়েদের নানাবিধ যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে, সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছিল। ছাত্র লীগের পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল রাজনীতিকভাবে দলীয়কৃত কর্মকর্তাদের অধীনস্থ পুলিশ সদস্যরা। সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রীরা মার খেয়েছে, জখম হয়েছে, গ্রেফতার বরণ করেছে কিন্তু আন্দোলনের মাঠ ত্যাগ করেনি। এমতাবস্থায়, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখে তার ছাত্র লীগের অপমানজনক পরাজয়ের আভাস ফুটে উঠলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে একদিন, ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর, কোটা ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের বদলে, একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে, গোটা কোটা ব্যবস্থাটিকেই বাতিল করে দিলেন। অথচ, কোটা-সংস্কারপন্থী ছাত্র-আন্দোলন তখনো কোটা বাতিল চায়নি, যুযোপযোগী সংস্কার চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তরফে বাতিলের ঘোষণাটি ছিল প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রসূত একটি অবৈধ সিদ্ধান্ত। সাম্প্রতিক সময়ে, এ বছরের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত তার বহুলালোচিত ‘সংবাদ সম্মেলনে’, প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি ‘বিরক্ত’ হয়ে কোটা [ব্যবস্থা] বাতিল করেছিলেন। স্পষ্টতই, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তাঁর সাংবিধানিক ‘শপথ’ ভঙ্গ করেছেন। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুযায়ী, এ দেশের কোন প্রধানমন্ত্রী ‘অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হইয়া’ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। অর্ধযুগ পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিরাগ’বশত গৃহীত সিদ্ধান্তটির কুফল হিসেবেই মূলত এ বছর ছাত্র-ছাত্রীদের রক্তাক্ত জুলাই বিদ্রোহের সূচনা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর ‘বিরক্তিপ্রসুত’ সিদ্ধান্তে ২০১৮ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন-সংগ্রাম তখনকার মতো বন্ধ হলেও, তা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অনেক তরুণ সদস্যদের ক্ষুব্ধ/আহত করে এবং তাঁদের একটি গ্রুপ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোটা-ব্যবস্থা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তটি ‘অবৈধ’ দাবি করে হাই কোর্টের কাছে মিমাংসা চায়। হাই কোর্ট, শেষ পর্যন্ত, এ বছরের ৫ জুন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের নির্দেশের আলোকে, গোটা কোটা-ব্যবস্থাকে বাতিল সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নির্বাহী আদেশকে ‘অবৈধ’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, এই কোটায় সন্তানদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি/নাতনিদেরও যুক্ত করে। অন্যান্য ‘অনগ্রসর’ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক পরিবর্তন-পরিবর্ধনের সুযোগ মঞ্জুর করে রায় ঘোষণা করেন।

এ রায়ের মাধ্যমে গোটা পরিস্থিতি ২০১৮ সালের আন্দোলন-পূর্ববর্তী অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রীক শিক্ষার্থীগণ নিজেদের জীবন-জীবিকার ভবিষ্যত নিয়ে ফের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

শিক্ষার্থীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার ন্যায্য কারণ ছিল। বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর গবেষণালব্ধ এ বছরের শুরুতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৮ থেকে ১০ লাখ বেকার রয়েছে। তাছাড়া, বহু বছর ধরে, ফি বছর দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে, এখানে ব্যক্তিখাতের পর্যাপ্ত বিকাশ ঘটেনি-যাঁর অনিবার্য কুফল হিসেবে ব্যক্তিখাতেও উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হয়নি। এমতাবস্থায়, নিজেদের জীবিকার অনিবার্য প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের নতুন করে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের সংগ্রামে অবতীর্ণ হন, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে আন্দোলনকে সুসংহতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীরা ৫ জুন তারিখেই “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামে একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে এবং নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দেয়ার জন্য একটি সমন্বয় কমিটিও গঠন করে। এই কমিটি বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে ৯ই জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ অনুষ্ঠানর করে এবং তাঁদের কোটা সংক্রান্ত পুরনো দাবি রাজনৈতিক ভাবে নিষ্পত্তির জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়।

ওদিকে, কোটা-ব্যবস্থা বিলোপ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশের আলোকে প্রণীত সরকারি পরিপত্রকে হাইকোর্ট ‘অবৈধ’ ঘোষণা করলে, আমিত্ববাদী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ বোধ করেন এবং তাঁর নির্দেশে লীগ-সরকার হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে ৯ই জুন সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের শরণাপন্ন হয়। আপীল বিভাগের ছয় সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বিষয়টির শুনানির জন্য ৪ জুলাই তারিখ ধার্য্য করা হয়। কিন্তু ৪ জুলাই আবেদনটি শুনানির জন্য উত্থাপিত হলে, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন। সংগ্রামরত ছাত্র-ছাত্রীরা অতএব বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলে। ইতিমধ্যে, ৬ জুলাই, জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শিক্ষার্থীদের ‘চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ও ‘শিক্ষকদের পেনসন স্কিম বিরোধী সংগ্রামের প্রতি নৈতিক সমর্থন’ ব্যক্ত করেন। শিক্ষার্থীদের সংগ্রামী নেতৃত্ব তাঁদের আন্দোলনকে তৎকালীন বিরোধী রাজনীতিক শিবিরের প্রভাবমুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন, কারণ, তাঁরা সরকারকে একটি ন্যায্য ছাত্র আন্দোলনের সময়ে ‘বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক সংগ্রামের’ তকমা লাগিয়ে দমন করার সুযোগ দিতে চাননি। কিন্তু বিরোধী শিবিরের নৈতিক সমর্থন আন্দোলনটিকে অতিরিক্ত শক্তি জুগিয়েছে বৈকি।

এদিকে, লীগ-সরকারের ‘আবেদনের’ প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ, শেষ পর্যন্ত, ১০ই জুলাই, হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতার ওপর চার সপ্তাহের জন্য ‘স্থিতাবস্থা’ জারি করে এবং ৭ই আগস্ট সরকারি আবেদনের ওপর শুনানির সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করেন। এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় দেশের প্রধান বিচারপতি সংগ্রামরত ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেনিকক্ষে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন, “আন্দোলনের মাধ্যমে কি কখনও সুপ্রীম কোর্টের রায় বদলানো যায়?”

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন- ১৯৮০’র দশকে তিনি ছাত্র লীগের বাকশালপন্থী অংশের সহ-সভাপতিও ছিলেন- ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা কাম্য ছিল। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার এই অতীত নিয়ে বেড়ে ওঠা বিচারপতি হাসানের ভুলে যাওয়া উচিৎ হয়নি যে, পাকিস্তানি জমানায়, ১৯৬৯ সালে, স্বৈরতান্ত্রিক আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে সংঘটিত বিশাল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের দায়ের করা ‘আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বিচারের জন্য স্থাপিত বিশেষ ট্রাইবুনালের প্রধান বিচারপতি, পাকিস্তানের একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, এস এ রাহমান, মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারেনি। বিদ্রোহী ছাত্র-জনতা কর্তৃক তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে, ১৯৬৯ এর ১৬ই ফেব্রুয়ারি, পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে, কোনো রকমে জীবন রক্ষা করে লাহোরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইতিহাস-বিস্মৃতির করুণ শিকার বিচারপতি হাসান সেদিন উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে, কয়েকদিন পরই, ১৮ জুলাই, নিরাপোষ ছাত্র-গণআন্দোলনের তোড়ে, সরকারের গোপন নির্দেশে, তিনিই আপীল-বিভাগে কোটা-সংক্রান্ত মামলাটির শুনানীর তারিখ তাঁরই পূর্ব ঘোষিত ৭ আগস্ট থেকে ২১ জুলাইতে এগিয়ে আনতে বাধ্য হবেন। সর্বোপরি, তিনি সম্ভবত ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি যে, সংগ্রামশীল শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রদত্ত তাঁর ইতিহাসবোধবিবর্জিত জ্ঞানদানের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ৫ আগস্ট, আপন বাসভবন থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সযোগে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং তার পাঁচ দিনের মাথায়, ১০ আগস্ট, অজ্ঞাত স্থান থেকে ফিরে এসে আপীল বিভাগের পুরো টিম সহ প্রধান বিচারপতির পদটিও তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে।

প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ সরকারি চাকরি সংক্রান্ত কোটা-ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টিকে সরকারের দিক থেকে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় হিসেবে যথার্থই চিহ্নিত করেছিল এবং প্রথম থেকেই বিষয়টিকে আইন-আদালতের মারপ্যাচের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ফলে, এ বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশ বা হুমকির প্রতি তাঁরা বরাবরই নির্বিকারত্ত্ব প্রদর্শন করেছেন। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষার্থী-সমাজ অতএব আন্দোলন-সংগ্রামের পথেই অগ্রসর হয় এবং সারা দেশের, বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরগুলিতে, প্রতিবাদী মিছিলগুলি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অতিক্রম করে, পুলিশি বাধার মুখেও, সংশ্লিষ্ট শহরগুলোর রাজপথ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে থাকে। এই মিছিলগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ যোগ দিতে শুরু করলে আন্দোলনটি ‘সড়ক অবরোধ’ সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি মধ্য জুলাইতে হঠাৎ বেগবান হয়ে উঠল কেন?

নূরুল কবীর: নিয়মতান্ত্রিকভাবে অগ্রসরমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এই ধীরতালের সংগ্রামটি সহসা, ১৪ জুলাই সন্ধ্যায়, ভীষণভাবে বেগবান হয়ে ওঠে। আন্দোলনটি বেগবান হওয়ার পেছনে সেদিন বিকেলে অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে একজোড়া অতিউৎসাহী লীগপন্থী সংবাদকর্মীর ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্ন ও অসংযত বাকচারিতায় অভ্যস্থ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতাবাদী শেখ হাসিনার শ্লেষাত্মক উত্তর সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। হাসিনা সেদিন আন্দোলনরত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের, প্রকারান্তরে, ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

হাসিনা নিজে ও তাঁর ফেরেপবাজ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অনুসারীরা বহু বছর যাবৎ লীগ-সরকারের নানা অপকর্ম, অপরাধ ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যে-কোনো সংগঠন কিংবা ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে ‘রাজাকার’, স্বাধীনতা-বিরোধী, ইত্যাদি অপমানজনক অভিধায় অভিযুক্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পাপাচারকে আড়াল করার প্রতারণাপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে চলেছিল। মনে রাখা প্রয়োজন যে, যে-কোনো উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ প্রচার, রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দমন, কোনো নেতা/নেত্রীকে ঘিরে কাল্ট নির্মাণ, প্রভৃতির মত, বিরোধী ভাবাদর্শের বিকাশ রোধে তার অনুসারীদের গায়ে নানা নেতিবাচক তক্মা এঁটে দেয়া ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। লীগ ও তার সরকারের ক্ষমতাচর্চার ভেতর বরাবরই এই বৈশিষ্ট্যগুলি পরিপূর্ণ স্পষ্টতা নিয়ে জারি ছিল। চাকরির কোটা সংস্কারকামী শিক্ষার্থী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যেও লীগ-সরকার ও তার তাবেদারের দল অভিন্ন ফ্যাসিবাদী অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু এবার লীগের এই অপকৌশল তার জন্য বুমেরাং হিসেবে আবির্ভূত হয়। কেননা, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে সেদিন সন্ধ্যায় দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ অসংখ্য প্রতিবাদী মিছিল ও গগণবিদারী শ্লোগানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীগণ অনতিবিলম্বে তাঁদের দাবি মেনে নেয়া সহ প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কটাক্ষমূলক বক্রোক্তির জন্য ‘প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা’র দাবি উত্থাপন করে।

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বিবর্জিত আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক পরিসরে আপন আধিপত্য জারি রাখার উদ্দেশ্যে, শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি, শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করেও একটি পরম পুজনীয় ‘কাল্ট’ নির্মান করেছিল – যার সম্পর্কে কোনো সমালোচনামূলক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ ও উপস্থাপন করা লীগের কাছে দণ্ডণীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হত। এমতাবস্থায়, লীগ সরকার ও তার নানা সরকারি-বেসরকারি পেটোয়া বাহিনীর সৃষ্ট ভয়ের সংস্কৃতির ভেতর দীর্ঘদিন জীবন যাপনের ফলে, হাসিনা সম্পর্কে কোনো ন্যায্য সমালোচনাও প্রকাশ্যে হাজির করার বিষয়টি একটি ট্যাবুতে পরিণত হয়েছিল। এমতাবস্থায়, হাসিনাকে তাঁর অপমানজনক উক্তির জন্য হাজারো কণ্ঠে ‘প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনার’ দাবি উত্থাপনের ভেতর দিয়ে লীগ কর্তৃক সযত্নে লালিত হাসিনা সংক্রান্ত ‘ট্যাবুটি’ ভেঙ্গে যায়, লীগের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে কৃত্রিমভাবে নির্মিত তাঁর পুজনীয় ‘কাল্ট’ও ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। ওদিকে, ফ্যাসিবাদ আক্রান্ত কোন স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ‘কাল্ট’ নির্মাণ ও ব্যবহার না করে ক্ষমতায় টিকে থাকে না। আবার, ‘কাল্ট’ চরিত্রকে ঘিরে নির্মিত ‘ট্যাবু’ ভেঙ্গে গেলে, সে চরিত্রের সামাজিক-রাজনৈতিক ‘মর্যাদা’ অধগামী হতে শুরু করে, যা যে-কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তির জন্য বিপজ্জনক। ফলে, হাসিনা সংক্রান্ত ‘ট্যাবুটি’ পুনপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেও তাঁকে ঘিরে গড়ে তোলা ‘কাল্ট’ রক্ষা করার স্বার্থে, ছাত্রসমাজ কর্তৃক হাসিনার ক্ষমা প্রার্থনার দাবিকে লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংগ্রামরত শিক্ষার্থীদের ‘ঔদ্ধত্য’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে, ১৫ই জুলাই, তাঁদের ‘দমন করার জন্য’ লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগই যথেষ্ট বলে হুংকার দেন এবং সেদিন দুপুরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্রধারী সরকারি ছাত্র সংগঠনটিকে লেলিয়ে দেন। ফলে, ছাত্র লীগের হেলমেট পড়া সন্ত্রাসী বাহিনী, পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায়, লাঠিসোটা ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র – ক্যাম্পাস, ছাত্রাবাস, শ্রেনিকক্ষ – শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এহেন বর্বরোচিত হামলায় মারাত্মকভাবে আহত ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে, সশস্ত্র ছাত্র লীগ কর্মীরা সেখানে ঢুকেও তাঁদের বেদম প্রহার করে।

একটি ন্যায়সঙ্গত ছাত্র-আন্দোলনকে এভাবে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়ার সরকারি তৎপরতা, অচিরেই, ক্ষমতাসীন লীগের তরফে একটি আত্মঘাতী প্রকল্পে পর্যবসিত হয়। কেননা, সরকারের অন্যায় ও অন্যায্য আক্রমনের ফলে সংগ্রামী শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অতি দ্রুত বিক্ষোভে পরিণত হয় এবং পুলিশ ও লীগের সশস্ত্র হামলার প্রতিবাদে সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই তাঁরা পুনঃসংগঠিত হয়ে এক অদম্য প্রতিরোধের সূচনা করে। সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রীদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে লীগ কর্মীরা লেজ গুটিয়ে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

কিন্তু সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চাপ ও উস্কানির প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পেটোয়া বাহিনী পরদিনই, ১৬ই জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরে আসে এবং আবার পুলিশি সশস্ত্রতার ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ওপর পাগলা কুকুরের ক্ষ্যাপামো নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংগ্রামী শিক্ষার্থীরাও অসামান্য দৃঢ়তার সাথে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুললে, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে ও প্রতিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে, দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও আপন আপন শিক্ষাঙ্গনে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে। এভাবে, সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী আন্দোলনের ইতিবাচক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক চাকরির কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনের এহেন দেশব্যাপী বিদ্রোহাত্মক বিস্তারের প্রেক্ষাপটে, ক্ষমতালীপ্সু লীগ-সরকার রাষ্ট্রের সশস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে, বিশেষত পুলিশ ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)কে, নির্মমভাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য তাদের ওপর সরাসরি গুলি চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। পুলিশ ও র‌্যাবের উচ্চ পদস্থ দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তারা, যাদের ভাগ্য ইতিমধ্যেই লীগ-সরকারের স্থায়ীত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, অতি উৎসাহে মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরত অধ:স্তন কর্মকর্তাদেরকে প্রতিবাদী মিছিল ও সমাবেশের ওপর লাঠি, টিয়ারগ্যাস ও গুলি করার নির্মম নির্দেশ প্রদান করে এবং প্রদত্ত নির্দেশের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার তত্বাবধানে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই যে, সেদিন, ১৬ জুলাই, সারাদেশে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রোহী ছাত্র আবু সাঈদ সহ সারাদেশে কমপক্ষে ছয় জন তরুণ প্রাণ হারান, আর অসংখ্য প্রতিবাদী তরুণ-তরুণী গুলিবিদ্ধ হন। মধ্য জুলাইয়ের তপ্ত দুপুরে আপন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে আক্রমণকারী পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লড়াকু সাঈদকে তিন তিন বার সরাসরি গুলি করে হত্যা করার ভিডিওটি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে, ইতিপূর্বে সৃজিত প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ অনতিবিলম্বে এক অজেয় বিদ্রোহের দাবানলে পরিণত হয়। মৃতুঞ্জয়ী সাঈদ হয়ে ওঠেন দ্রোহী তারুণ্যের অদম্যতার প্রতীক।

পুলিশের গুলিতে সাঈদের মৃত্যু গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে বিকশিত করেছিল। নয় কি?

নূরুল কবীর: এ দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের ঘাতক বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে-কোনো মানুষের প্রাণদানই বেদনাদায়ক, তথাপি আন্দোলন প্রক্রিয়ায় সকল মৃত্যুই ইতিহাসে সমান ভূমিকা রাখতে পারে না, কোনো কোনো মৃত্যু লড়াকু সংগ্রামের বিশেষ উজ্জিবনী প্রতীকে পরিণত হয় – যে মৃত্যু নানা কারণে সংশ্লিষ্ট সংগ্রামকে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিমান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের পাকিস্তান পর্বে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিকতন্ত্র-বিরোধী ছাত্র-গণআন্দোলনটি পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র আসাদুজ্জামানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯, শক্তিমান ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়- যা স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহীর পতনের সূচনা করে এবং দু’মাসের মাথায়, ২৫ মার্চ, সেই সরকারের পতন নিশ্চিত করে। আবার, বাংলাদেশ আমলে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সামরিকতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে, ১৯৮০’র দশকে, বহু সংগ্রামী ছাত্র ও সাধারণ মানুষের প্রাণ দানের ঘটনা ঘটলেও, মিছিলরত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু প্রতিবাদী ছাত্র নাজির উদ্দিন জেহাদের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট অসাধারণ রাজনৈতিক আবেগ, ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর, প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র সমাজের সবকটি সংগঠনকে আন্দোলনের অভিন্ন মঞ্চে সমবেত করে দেয়, গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। তারপর, সরকারি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডাঃ শামসুল হক মিলনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, ২৭ নভেম্বর, তিনি বিদ্রোহের প্রতীকে পরিণত হন এবং সামরিকতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামটি তাৎক্ষণিকভাবে বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করে। কোথায়, কখন ও কার মৃত্যু বা আত্মদান কোন আন্দোলন-সংগ্রামের বৈপ্লবিক প্রতীকে পরিণত হয়, তার সঙ্গে সাধারণত, সংশ্লিষ্ট সংগ্রামের শ্রেনি চরিত্র ও আত্মদানকারী ব্যক্তির শ্রেনি-পরিচয়ের একটা যোগ থাকে। যাই হোক, এবারও, আবু সাঈদের মৃত্যু শেখ হাসিনার নৃংশস স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে সূচিত ছাত্র-ছাত্রীদের লড়াকু সংগ্রামকে বিকশিত করে একটি বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের দৃঢ় পাটাতন তৈরি করে দেয়।

আবু সাঈদের সাহসী আত্মদানের মাধ্যমে হাসিনার স্বৈরশাসনের ভয়ে সেযাবৎকাল নির্বাক শহরগুলি সহসা প্রতিবাদে বাঙময় হয়ে ওঠে। সারাদেশের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশী বাধার মুখে পড়লে, সারা দেশে উভয়পক্ষের ভেতর সংঘর্ষের সূচনা হয় – যা মধ্যরাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। প্রতিবাদী ছাত্র-আন্দোলনের এহেন বৈপ্লবিক বিস্তারের মুখে, তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার সেদিনই, ১৬ জুলাই, সন্ধ্যায় সারাদেশের সকল স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলি থেকেও শিক্ষার্থীদের বিতাড়িত করে, যাতে তারা আপন আপন শিক্ষাঙ্গনে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদী মিছিলে অংশগ্রহণ করতে না পারে।

প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের ভেতর আন্দোলনের বিস্তার ও গভীরতা সম্পর্কিত তথ্যের আদান-প্রদান করতে না পারে, এবং আন্দোলনকে আরো বিকশিত করার জন্য নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রয়োজনীয় শলাপরামর্শ ও মত বিনিময় প্রক্রিয়া যাতে ব্যাহত হয়, সেই জন্য সরকার ঐ দিনই গোটা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া, আন্দোলন দমন করার জন্য একই দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন সকল বিভাগীয় শহরগুলিতে সরকার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস (বিজিবি) মোতায়েন করে।

পরদিন, ১৭ জুলাই ছিল আশুরার ছুটির দিন। এদিনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আন্দোলনে শহীদদের ‘গায়েবানা জানাজা’ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ছিল। সেদিন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতীকী ‘কফিন মিছিলে’র ওপর যুদ্ধংদেহী পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্র লীগের সশস্ত্র কর্মীরা হামলা চালায়। ফলে, প্রতিরোধ সংগ্রামও ব্যাপকতা লাভ করে। শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ গুড়িয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ ঝাঝাঁল কাঁদুনে গ্যাস, অসংখ্য সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে, কিন্তু প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যেই অদম্য হয়ে উঠেছিল এবং সাধারণ মানুষও তাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিতে শুরু করেছে। জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব এদিন শিক্ষার্থীদের সংগ্রামে তাঁদের দল ‘সরাসরি সম্পৃক্ত নয়’ বলে দাবি করেও ঘোষণা দেন যে, সংগ্রামে তাঁদের ‘পূর্ণ সমর্থন রয়েছে’।

স্পষ্টতই, পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার ভারতীয় কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা সেদিন ইতিহাসের এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল, উভয় পক্ষের ‘জাতীয় স্বার্থ’ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ বিবেচনা সেই কৌশলগত ভারত-বাংলাদেশ মেলবন্ধন রচিত হওয়ার পেছনে সক্রিয় ছিল না। এটাকেই ইংরেজিতে বলে রিয়েলপলিটিক।

শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত লীগের জন্য আত্মঘাতী প্রমাণীত হয় – শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-ভিত্তিক প্রতিরোধ সংগ্রাম এবার বিকেন্দ্রীভূত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীরা, এমনকি স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীরাও, আপন আপন আবাসিক এলাকায় জড়ো হয়ে লীগ সরকারের বৈধ ও অবৈধ বিভিন্ন বাহিনীর সমূহের বিরুদ্ধে লাঠি আর ইট-পাটকেল সম্বল করেই রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে গলিতে, সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজধানী শহরের কিছু এলাকায় কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও এদিন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে, গড়ে তোলে শক্ত প্রতিরোধ। কিন্তু, পুলিশ ও লীগের অবৈধ অস্ত্রধারী কর্মীদের আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে অসংখ্য তরুণ-তরুণী লাঠি-পেটা আর ঝাঁক ঝাঁক রাবার বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হন। পুলিশের গুলিতে সেদিন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ওদিকে, উল্টো, অগণিত আহত মানুষের বিরুদ্ধে সরকার অসংখ্য মামলা রুজু করতে থাকে।

এদিন সন্ধ্যা ৭:৩০ টায়, শেখ হাসিনা কালো শাড়ি পরে, অশ্রুসজল নাটকীয় ভঙ্গিতে, ‘জাতির উদ্দেশ্যে’ প্রদত্ত এক মেকি বক্তৃতায়, তাঁরই নির্দেশে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রদের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করার জন্য একটি ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত’ কমিশন গঠন করার কথা ঘোষণা করেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দেন। কিন্তু তাঁর পরিতাপবোধহীন বেদনার্ত ভঙ্গি, মানুষকে তাঁর ও তাঁর সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল করার পরিবর্তে, আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে। আবার, সেদিনই তাঁর সন্ত্রাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উল্টো, প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ‘দুবৃত্ত’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ গ্রহণের প্রকাশ্য হুমকি প্রদান করেন। সন্ধ্যায় হাসিনা ছাত্রদের মৃত্যুতে মায়াকান্না দেখালেও, তাঁর পুলিশ ও র‌্যাব মধ্যরাতে শহরের নানা আবাসিক এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে অসংখ্য তরুণকে গ্রেফতার করে। স্বভাবতই, ফেইসবুক আর দেয়ালের প্রাফিতিতে তরুণদের শ্লোগান ওঠে – ‘দিনে নাটক, রাতে আটক’।

স্পষ্টতই, লীগ-সরকার শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত দাবির ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে এবং দ্রুত বিকাশমান আন্দোলনকে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক শক্তি ও তাঁর দলের অবৈধ অস্ত্রধারী পেশীবাজ গোষ্ঠী সমূহের মাধ্যমে দমন করার ফ্যাসিবাদী কৌশল নিয়ে অগ্রসর হয়। কিন্তু ন্যায়বোধে উজ্জীবিত মর্যাদাবান শিক্ষার্থীরাও ধনুকভাঙ্গা পণ নিয়ে, সম্মিলিতভাবে, তা মোকাবেলা করার অনড় সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ফলে, পরদিন, ১৮ই জুলাই, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সকল শহরগুলিতে প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রী ও আগ্রাসী সরকারি বাহিনীসমূহ মুখোমুখি দাঁড়ায় – একদিকে লাঠি আর ইটপাটকেল হাতে ছাত্র-ছাত্রীরা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্রধারী পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও ছাত্র/যুবলীগের অবৈধ অস্ত্রধারী নেতা-কর্মীরা। উভয়পক্ষের অসম সংঘর্ষের মধ্যে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, রাজধানী শহরের প্রায় সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তেজোদ্দীপ্ত শিক্ষার্থীরা, ইতিমধ্যেই প্রতিরোধরত অপরাপর সহমর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিতে থাকে। ফলে, সংগ্রামে নতুন বেগ ও গতি সঞ্চারিত হয়ে আরো লড়াকু রূপ পরিগ্রহ করে। এই দিন থেকে, প্রধানত, প্রাইভেট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই শিক্ষাঙ্গনের বাইরে, রাজপথের রনাঙ্গণে, সারা দেশে স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী সফল ছাত্র-গণআন্দোলনে অগ্রসেনার ভূমিকা পালন করেন। সরকারি বাহিনীগুলোর গণবিরোধী সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ সংগ্রামে, এমনকি নিহত-আহতের সংখ্যা বিবেচনায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায়, তাঁরাই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

 

ছাত্র আন্দোলনটি কি ঠিক সময়েই গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হতে শুরু করে? প্রায় সকল শ্রেনির জনগণ আন্দোলনে যোগ দিল কেন?

নূরুল কবীর: হ্যা, ঠিক এদিনই ১৮ই জুলাই, ছাত্র আন্দোলনটি ছাত্র-গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হতে শুরু করে।

আওয়ামী দুঃশাসনের বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি ভীষণভাবে দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়েছিল, যা সমাজে ভয়ানক রকমের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতির অমোঘ বিষফল হিসেবে ব্যবসায়ী পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠে অসংখ্য অর্থগৃধনু সিন্ডিকেট, যাদের দুর্নীতিপরায়ন তৎপরতায় বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে, এমনকি সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠিভুক্ত চাকরিজীবীরাও সৎভাবে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশীম খেতে থাকে।

স্বভাবতই, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ হাসিনার লীগ-সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়, দিশেহারা মধ্যবিত্ত সরকারের ওপর নাখোশ হয়ে পড়ে, কিন্তু লীগ-শাসিত সমাজে সরকারের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ায় তাঁরা ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকে। অন্যদিকে, লুট-পাটের মাধ্যমে রাতারাতি বিত্তবান হয়ে যাওয়া লীগভুক্ত একশ্রেণীর মানুষের ‘ক্ষমতার’ অব্যাহত অপব্যবহারে মানুষের রাগ ক্রমশ চাপা ক্ষোভে পরিণত হতে থাকে। এমতাবস্থায়, ‘বৈষম্য বিরোধী’ শিক্ষার্থী আন্দোলন বিস্তার লাভ করলে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর যখন সশস্ত্র সরকারি নিপীড়ন শুরু হয়, তখন লীগ-সরকারের দুবৃত্তায়িত অর্থনীতি-প্রসূত বৈষম্যমূলক জীবন-ব্যবস্থার নির্মম শিকার শহরের এই সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত বিক্ষুব্ধ তরুণ-তরুণীসহ অসংখ্য মানুষ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী মিছিলে যোগ দিয়ে রাজপথের লড়াইকে শক্তিমান করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে, এই দিনই ছাত্র-আন্দোলন একটি ছাত্র-গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে।

কিন্তু ক্ষমতার মদমত্ততায় অন্ধ লীগ-সরকার সে আন্দোলনের গভীরতা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। ফলে, সংগ্রামরত শিক্ষার্থীদের সাথে কার্যকর সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিনয়ী উদ্যোগ না নিয়ে, সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে চাকরির কোটা সংক্রান্ত মামলাটির পূর্বনির্ধারিত শুনানীর তারিখ ৭ আগস্ট থেকে এগিয়ে এনে, ২৯ জুলাইতে পুনঃনির্ধারনের মাধ্যমে, আইনী প্রক্রিয়ায়, আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়ার অপপ্রয়াস গ্রহণ করে। কিন্তু ছাত্র-আন্দোলনের চৌকষ নেতৃত্ব, পূর্বের মতোই, লীগের এই আদালতাশ্রয়ী অপকৌশলগত রাজনৈতিক লেবেনচুস গিলতে অস্বীকার করে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পথে অটল থাকে। ছাত্র আন্দোলনের এই সিদ্ধান্তে ক্ষমতাদর্পী প্রধানমন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং তাঁর অধীনস্থ সকল পেশীশক্তিকে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ‘কঠোরভাবে’ দমন করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর আদেশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীসমূহ চরম নৃশংসতা নিয়ে আন্দোলন দমন করার আওয়ামী প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রসর হয় – যার নির্মম ফলাফল হলো সহস্রাধিক নাগরিকের মৃত্যু, কয়েক সহস্র মানুষের পঙ্গুত্ব আর নানা বানোয়াট মামলায় অগণিত মানুষের গ্রেফতার ও কারা নির্যাতন ভোগ। এ প্রসঙ্গে এখানেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, বরাবরের মতোই, এবারের বিজয়ী ছাত্র-গণআন্দোলনেও- কি প্রাণদানের সংখ্যাগত বিবেচনায়, কি আহতদের সংখ্যার ভিত্তিতে, কি কারাভোগের পরিমাপে – এদেশের গরিব শ্রেনিভুক্ত মানুষই সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

যাই হোক, আন্দোলন বিকাশের এই পর্যায়ে, সরকারি বাহিনীসমূহের আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে নানা শহরের নানা লোকালয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও বস্তিবাসী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সমাজের প্রায় সকল অংশের তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা যোগ দিতে থাকে। ঝকঝকে জিন্স আর টি-শার্ট পরা মধ্যবিত্ত তরুণ, সাধারণ প্যান্ট-শার্টে নিম্নমধ্যবিত্ত যুবক, পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মাদ্রাসার ছাত্র, আধময়লা জামাকাপড়ে ছিন্নমূল কিশোর – সকলেই স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের পতনের দাবিতে উচ্চারিত নানা শ্লোগানে একযোগে কণ্ঠ মেলায়। সে দিনগুলিতে সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক বিভিন্নতাজাত বিরোধও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় – জিন্স আর শার্ট পরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রীদের পাশেই লড়তে দেখা যায় তাঁদের হিজাব পরিহিতা সতীর্থদের। আন্দোলনের মূল স্রোতের পাশাপাশি অবাঙালি/পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরাও রাস্তায় নেমে আসে। কোথাও থেকে কোন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা ছিল না, কিন্তু সাধারণভাবে ন্যায়-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সকলেই সোচ্চার। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে এ ছিল এক অবিস্মরণীয় সামাজিক বিস্ফোরণ – এক জীবনবাজি উৎসবমুখর প্রতিরোধ সংগ্রাম। অন্যদিকে, এই সংগ্রামী গণপ্রতিরোধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য লীগ-ঘনিষ্ঠ একটি লুটেরা গোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষাবলম্বী সরকার ও তার সরকারি-বেসরকারি সন্ত্রাসী বাহিনীসমূহ লাঠি, গুলি ও তীব্র কাঁদানে গ্যাস ব্যবহারে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। বিশাল ঢাকা নগরীর কয়েকটি অঞ্চলে, বিশেষত উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়, নিরস্ত্র জনতা ও সশস্ত্র সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষে প্রতিবাদী তরুণদের লাশ পড়তে থাকে, ঝাঁক ঝাঁক গুলির আঘাতে বহু শিক্ষার্থীর চোখের আলো চিরতরে নিভে যায়, অসংখ্য গুলিবিদ্ধ তরুণের হাত কিংবা পা চিরকালের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, লাঠির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় অসংখ্য তরুণ শরীর। রাজপথে সরকারি বাহিনীর মুহুর্মুহু তাড়া-খাওয়া তৃষ্ণার্ত সহযোদ্ধাদের পানি পান করাতে গিয়ে, এই ১৮ জুলাই দুপুরেই, উত্তরার রাস্তায় পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর স্নাতোকত্তর পর্যায়ের টগবগে ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ প্রাণ হারান।

পুলিশ ও অবৈধ অস্ত্রধারী লীগ বাহিনীর গুলিতে সেদিন কমপক্ষে আরো ৪০ জন প্রতিবাদী মানুষের প্রাণ ঝড়ে পড়ে। তবে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ মুগ্ধ’র মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ভিডিওটি মুহূর্তেই নেট জগতে ছড়িয়ে পড়লে, মধ্যবিত্ত সমাজের অসংখ্য নর-নারী রাস্তায় নেমে আসে। জুলাই আন্দোলনে সরকারি গুলিতে ইতিমধ্যে আরো কয়েকশ তরুণের প্রাণ ঝড়ে পড়লেও, আবু সাঈদের পর মুগ্ধ’র উচ্ছল অবয়ব লড়াকু সংগ্রামের দ্বিতীয় আইকনে পরিণত হয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াইয়ে সাঈদ-মুগ্ধ সহ অপরাপর অসংখ্য শিক্ষার্থীর অকাতর প্রাণদানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়ে রচিত হতে থাকে যুগপৎ বেদনা ও সাহস সঞ্চারী সৃজনশীল গান, কবিতা আর শ্লোগান। বিদ্রোহী প্রানের আবেগে আর চেতনার দৃঢ়তায় শহরের দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কিত হতে থাকে অসংখ্য প্রাফিতি আর কার্টুন। একই সঙ্গে, ইতিহাসের ভেতর থেকে জেগে ওঠে পুরনো সব মহৎ লড়াইয়ের সময়ে রচিত সঞ্জিবনী গান, কবিতা আর শ্লোগান। গণতন্ত্রপরায়ন ছাত্র আন্দোলনের নিরাপোষ যোদ্ধারা এই সব নতুন-পুরনো গান, কবিতা আর শ্লোগানে আরো উজ্জীবিত হয়ে, মাঠ পর্যায়ে, শেখ হাসিনার স্বৈরাতান্ত্রিক সরকারের পতন দাবি করতে শুরু করে। অন্যদিকে, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত ক্ষমতালীপ্সু লীগ-সরকার এই সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহ দমনে, সেদিন সন্ধ্যায়, সারাদেশে প্যারা-মিলিটারী বিজিবি মোতায়েন করে। জবাবে, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সারাদেশে ঘোষণা করে ‘কমপ্লিট শাট-ডাউন’ বা ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ ।

এই ‘সর্বাত্মক অবরোধ’কে কেন্দ্র করে পরদিন সকালেই, ১৯ জুলাই, বিদ্রোহী শিক্ষার্থী আর দরিদ্র জনগণের সঙ্গে সমাজের মধ্যবিত্ত সমাজের নারী-পুরুষরাও আপন আপন সন্তানের সাথে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে সরকার-বিরোধী অবরোধে যোগ দিতে শুরু করে। সেদিন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী বিজিবি সদস্যদের উচিয়ে রাখা অসংখ্য সঙ্গীণ উপেক্ষা করে, বিক্ষুব্ধ তরুণ-তরুণীরা আপন দেশের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধে ব্যর্থতার জন্য বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছে প্রকাশ্য রাজপথে কৈফিয়ত দাবি করে এবং ‘সীমান্তে ব্যর্থ’ বিজিবিকে ‘খুনি হাসিনার নির্দেশে’ স্বদেশের শিক্ষার্থী হত্যায় এগিয়ে আসার জন্য ভর্ৎসনা করতে থাকে। কিন্তু লীগ-সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বাহিনী-প্রধানদের নির্মম নির্দেশে রাস্তায় অবস্থানরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও লীগের সশস্ত্র হামলা অব্যাহত থাকে। অগ্নিগর্ভ ঢাকা সহ সারাদেশে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধও বৈপ্লবিক পর্যায়ে বিকশিত হয়। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সঙ্গে দিনভর সংঘর্ষের প্রক্রিয়ায় দেড় শতাধিক প্রতিবাদী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান, অসংখ্য মানুষ গুলি ও লাঠির আঘাতের পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এতদসত্বেও, সংগ্রামী ছাত্র-জনতা পিছু হঠতে অস্বীকার করে। সারা দেশের সদর রাস্তায়, এমনকি ওলিতে-গলিতে, নতুন শ্লোগান ওঠে, ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ’। একই সাথে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রাজপথ ক্রমশই উত্তাল হতে থাকে। এ পর্যায়ে, প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ওপর একটি সমঝোতা বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার জন্য, সরকার আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ককে Ñ আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদ, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে যায় এবং পরদিন, ২০ জুলাই, হাসিনা সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সাথে আনিসুল হক, আরাফাত ও নওফেল তাঁদের এক প্রহসনমূলক সংলাপ ও সরকারি চাপের মুখে প্রণীত একটি ৮-দফা দাবিনামা বিবেচনা করার আশ্বাসমূলক নাটক পরিবেশন করে। এই দাবিনামায় ছাত্র হত্যার দায়ে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের পদত্যাগ, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এমন সব এলাকার উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত ও তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের, কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরদের পদত্যাগ, নিহত-আহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিমধ্যে সংঘটিত সরকারি গণহত্যা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে বিকশিত আন্দোলনের তীব্রতার বিবেচনায়, এই দাবিনামা ছিল খুবই নিরীহ প্রকৃতির, তথাপি সংশ্লিষ্ট তিন ‘সমন্বয়ক’কেই তাঁরা আটকে রাখে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, আন্দোলনের তীব্রতা প্রশমিত করাই ছিল ছাত্রনেতাদের দিয়ে এই ৮-দফা প্রণয়ন ও বন্দি দশায় সরকারের কাছে পেশ করানোর উদ্দেশ্য।

ওদিকে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে বেপরোয়া হাসিনার সরকার ছাত্র-গণআন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সারাদেশে কারফিউ জারি করে এবং তা বলবৎ করার জন্য রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। পাশাপাশি, দেশব্যাপী সংগ্রামরত ছাত্র-জনতার ভেতর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য ইন্টারনেট সার্ভিস পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। কারফিউ চলাকালীন সময়ে রাস্তায় মানুষ ‘দেখা মাত্র গুলি’ করা হতে লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জনমনে ভীতির সঞ্চার করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা ২০ জুলাই সকাল থেকেই কারফিউ উপেক্ষা করে সড়ক অবরোধ অব্যাহত রাখে এবং পুলিশ, বিজিবি ও সশস্ত্র লীগ-কর্মীদের সাথে সংঘর্ষে সারাদেশে প্রায় আরো একশ নিরস্ত্র মানুষ সরকারি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কিন্তু প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে।

আপনি ১৯৬৯ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ওপর গবেষণামূলক বই লিখেছেন, ৮০’দশকের সামরিকতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে নিজে সক্রিয় ছিলেন এবং ১৯৯০ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ভেতরের দিক থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন, এবার একজন গণতন্ত্রপরায়ণ সক্রিয় সাংবাদিক হিসেবে সদ্য সমাপ্ত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে নিবীড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অতীতের তুলনায় এবারের আন্দোলনের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য আপনার চোখে পড়েছে?

নূরুল কবীর: প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতরেই কতগুলো ‘সাধারণ’ বৈশিষ্ট্য থাকে, আবার কালের ব্যবধানে কিছু কিছু ভিন্ন উপাদান প্রতিটি সংগ্রামকে বিশিষ্টতা দেয়। এবারের সংগ্রামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো – আন্দোলনটির ওপর জাতীয় পর্যায়ের কোন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল না, আবার আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাধান্য ছিল না, প্রধানত রাজনীতি সচেতন স্বাধীন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গঠিত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নির্দলীয় সমন্বয়কদের নেতৃত্বেই জুলাই-আগস্টের এই বিজয়ী সংগ্রামটি সংঘটিত হয়। পাকিস্তানী জমানায় জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-মার্চ, শ্রমিক ও কৃষকের ব্যাপক রাজনীতি-সচেতন সংঘবদ্ধ অংশগ্রহণ ছিল। বাংলাদেশ আমলে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময়েও, ১৯৯০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯৮৪ সালে গঠিত শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে সারা দেশের শ্রমিক-কর্মচারীদের সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছিল। কিন্তু এবারের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের তরঙ্গ গ্রামাঞ্চলের কৃষক সমাজ পর্যন্ত পৌঁছায়নি, শ্রমিকরাও কেবল বিচ্ছিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের সুবিধাবাদী অবস্থান জারি রেখেছেন, যদিও তাদের অনেকের হৃদয়বান তরুণ সন্তান-সন্ততি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে করেছেন। পূর্বের গণঅভ্যুত্থান দুটির পেছনে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক দলসমূহের প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন সামাজিক শক্তিসমূহের পরিকল্পিত ভূমিকা ছিল, আর এবারের গণঅভ্যুত্থানে জনগণের অংশগ্রহণের পেছনে স্বতস্ফূর্ত রাজনৈতিক আবেগই বেশি ক্রিয়াশীল ছিল।

যাই হোক, এবারের আন্দোলনের একটি অনন্য ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যাপকহারে নারীর অংশগ্রহণ। অতীতের প্রতিটি আন্দোলনেই নারী শিক্ষার্থীদের কম-বেশী অংশগ্রহণ ছিল, কিন্তু এবারের সংগ্রামে তাঁরা অনেক ব্যাপক সংখ্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তাছাড়া, রক্তস্নাত এই আন্দোলনের একটি অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য হলো, আন্দোলনের সাথে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের মায়েদের সম্পৃক্তি। দিবানিশি রাজপথে সংগ্রামরত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেনিভুক্ত তরুণ-তরুণীদের সাহায্যার্থে তাঁদের মায়েরা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রাজপথে নেমে এসেছিলেন। এই মায়েদের কেউ কেউ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর তরুণ-তরুণীদের ভেতর রাস্তায় খাবার ও পানি বিতরণ করেন, কেউ কেউ গ্রেফতারকৃত সন্তানদের আদালতে ঢোকার প্রাক্কালে পিঠ চাপড়ে সাহস যোগান, কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ সন্তানকে নিয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ছোটেন। এমন মাকে এমনকি অবরোধে অংশগ্রহনকামী তরুণ সন্তানকে ঘর থেকে বেরুনের প্রাক্কালে পুলিশ বাহিনীর খুনে বুলেট থেকে প্রাণ রক্ষার জন্য শরীরে ভেস্ট বেঁধে দেয়ার দৃশ্যও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রাষ্ট্র-ক্ষমতার মোহ শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার ও দলীয় আদলে গড়ে তোলা প্রশাসনকে এতটাই অন্ধ করে দিয়েছিল যে, তাঁরা একথা উপলব্ধি করতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হন যে, যখন কোন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ছাত্র-গণআন্দোলনের সময় মায়েরা তাঁদের নিরস্ত্র তরুণ সন্তানদের সশস্ত্র পুলিশের সাথে রাস্তার লড়াইয়ে প্রাণীত করেন, নিজেরাই রাজপথে দাঁড়িয়ে লড়াইরত সন্তানদের সাহস যোগান, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে, লড়াইয়ের ময়দান ত্যাগ না-করা লড়াকু তরুণদের রাজপথেই খাদ্য ও পানীয় যোগান, তখন সেই ছাত্র-গণআন্দোলন কোনোভাবেই পরাজিত হতে পারে না, সংশ্লিষ্ট স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন বরং অনিবার্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ লীগ-সরকার সংগ্রামের সাফল্য-অসাফল্যের এই রাজনৈতিক ব্যাকরণ বুঝতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ, ক্ষমতার মোহগ্রস্ত অবস্থায়, এবার ইতিহাসের নাড়ি বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ে।

ইতিহাসের নাড়ি বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়লে যে-কোনো রাজনৈতিক শক্তিই নানা ভুল পদক্ষেপ ক্ষমতার মোহগ্রস্ততার কারণে, নিতে বাধ্য। লীগ-সরকারের পরবর্তী ভুল পদক্ষেপ কি ছিল?

নূরুল কবীর: এবার প্রথম থেকেই আওয়ামী কর্তৃপক্ষ মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ফলে, জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে লীগের পক্ষে কোন বিজয়প্রসূ পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ ছিল না। তবে, অহমিকা ও জেদের বশবর্তী না থেকে, তখনও যদি লীগ-সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো, তাহলে অনেক সংগ্রামী তরুণের জীবন রক্ষা পেত, গণহত্যার অভিযোগে লীগ-নেত্রীকে কারাগারে যেতে হতো ঠিকই, কিন্তু অপমানজনকভাবে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে তাঁর দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যত বিপন্ন করতে হত না, তাঁর সহযোগীদের অনেকেই হয়ত সমাজ থেকে হঠাৎ অন্তর্ধানের অপমান থেকে রক্ষা পেত। কিন্তু লীগ ও তার নেত্রী সে পথে পা না বাড়িয়ে আরো মারাত্মক ভুলের দিকে অগ্রসর হয়, ক্ষমতা ত্যাগের পরিবর্তে বল প্রয়োগের মাধ্যমে একটি অদম্য সংগ্রামকে কাবু করার জন্য রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ওপর নিজের নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে, সরকার একটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে, শিক্ষার্থী-আন্দোলনের একজন অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে অবৈধভাবে তুলে নিয়ে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিনস্থ ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের (ডিবি) কুখ্যাত গোপন কারাগারে আটকে রেখে, আন্দোলন বন্ধ করার জন্য তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। পরদিন, ২১ শে জুলাই, বেদম প্রহারে গুরুতর অসুস্থ নাহিদকে নগরীর এক রাস্তায় ফেলে যায় এবং রাজপথে সংগ্রামরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা অব্যাহত রাখে। প্রায় ৪০ জন প্রতিবাদী মানুষ এদিন সরকারি গুলিতে রাস্তায় প্রাণ হারায়।

অন্যদিকে, এদিনই, ২১ জুলাই, সরকার-নিয়ন্ত্রিত সর্বোচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে পাঁচ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি, এক শতাংশ জাতীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও এক শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত জন-সম্প্রদায় ও প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত রেখে, অবশিষ্ট ৯৩ শতাংশ চাকরি মেধা-ভিত্তিক প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত রেখে রায় প্রদান করেন। কিন্তু ততদিনে কয়েক’শ মৃত্যু, শত শত পঙ্গুত্ব আর হাজার হাজার গ্রেফতারের পর, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তরফে সেই রায়ের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনা-সরকারের পদত্যাগের আহ্বান ঘোষিত না হলেও, সর্বত্র লড়াইরত ছাত্র-জনতার দিক থেকে সরকারের পতনই রণাঙ্গনের শ্লোগানে পরিণত হয়। ইতিমধ্যে, আন্দোলনের কার্যকরন সম্পর্ক বুঝতে অক্ষম, ফলে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী, লীগ নেতা-নেত্রী ও তাঁদের অনুগত বুদ্ধিজীবীরা স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের পেছনে দেশি-বিদেশি নানা দক্ষিণপন্থী ইন্ধন ‘আবিষ্কার’ ও তা প্রচারণায় কালাতিপাত করতে থাকে। তাছাড়া, লীগ-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্র আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দিনভর বিভিন্ন খুনে তৎপরতা ও রাতভর বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইডের’ মাধ্যমে শত শত তরুণের অবৈধ গ্রেফতার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে।

পরদিন, ২২ জুলাই, এদেশের স্থ’ল স্বার্থপরায়ন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের একটি দল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করার মাধ্যমে নিজেদের জন্য এক কলঙ্কজনক ইতিহাস রচনা করনে। সেদিন শেখ হাসিনার আহ্বানে তাঁরা গণভবনে সমবেত হন এবং সেখানে হাসিনার গোয়েবলসতুল্য তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত গণতন্ত্রকামী তরুণদের সংগ্রামী আত্মত্যাগকে অপমান করে, সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক আবু সাঈদকে ধর্মান্ধ ‘জঙ্গিতুল্য মাদকবিদ্ধ তরুণ’ হিসেবে তুলে ধরেন এবং ব্যবসায়ীদের সামনে ‘বিপথগামী’ তরুনদের ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ রুখে দাঁড়ানোর ‘প্রয়োজনীয়তা’ ব্যাখ্যা করেন। এ দেশের অতীত কোনো গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা বিবর্জিত এই জ্ঞান ও বিবেক প্রতিবন্ধী তরুন মন্ত্রী উপলব্ধি করতেই অক্ষম যে, আবু সাঈদ নামের ন্যায়নিষ্ঠ তরুনটি সমাজে তাঁর গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য আপন ‘প্রাণীসত্তাকে’ বিসর্জন দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

বাংলাদেশ-যুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অতএব ‘অতিরিক্ত’ আদিখ্যেতা দেখানোর কিছু নেই – তাঁদের বরং উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রশাসন অনেক হিসেব-নিকেশ করেই, নিজেদের ভবিষ্যত রাজনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধার জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর সেই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই লাভবান হয়েছে। ফলে, এক্ষেত্রে ‘উপকার’ ও ‘কৃতজ্ঞতা’র প্রশ্নটি একপাক্ষিক হতে পারে না, উপকৃত বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ।

ওদিকে, সমবেত ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিনার সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এ সমাবেশে দেশের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শেখ হাসিনাকে আজীবন, এমনকি ‘মৃত্যুর পরেও’, সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। কিছু দিন আগে, ‘হাসিনা পালানোর পথ পাবে না’ বলে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের উচ্চারিত দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে, এ সভাতেই হাসিনা দাবি করেছিলেন, ‘হাসিনা কখনো পালায় না’। যাই হোক, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যখন একটি খুনি সরকারকে সক্রিয় সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, ঠিক তখন দেশের রাজপথে সরকার ও লীগের অবৈধ বুলেটে তরুনদের প্রাণ ঝরে চলেছে – ইতিপূর্বে গুলিবিদ্ধ আহত তরুণদের মৃত্যুর খবরও থেকে থেকে আমাদের কাছে পৌঁছুচ্ছিল।

ইতিমধ্যে, ২৪ জুলাই, নিখোঁজ থাকার পাঁচদিন পর, ইতিপূর্বে ধরে নিয়ে যাওয়া ছাত্র-আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ককে ডিবির নিপীড়ক কর্মকর্তারা অসুস্থ অবস্থায় চোখ বেঁধে রাজধানীর এক রাস্তায় ফেলে যায়। পরদিন সকালে, ২৫ জুলাই, পুলিশের গুলিতে আহত-নিহত শত শত তরুণ-তরুণীর একজনের ব্যাপারেও খোঁজ-খবর না নিয়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্র সরকারি বাহিনীসমূহ ও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার মধ্যে সংঘর্ষকালে কিঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্থ রাজধানীর মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনটি পরিদর্শনে যান এবং তাঁর চিরকেলে নাটকীয় নৈপুন্যে একটি টিকিট কাউন্টারের ভাঙ্গা কাঁচের দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে নিজের মহান উন্নয়ন কর্মকান্ড ধংস করার জন্য ছাত্র আন্দোলনকে অভিযুক্ত করেন। মিরপুরের কাজিপাড়া স্টেশনটিও লীগ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে খানিকটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এমতাবস্থায়, তাঁর সহজাত অসত্যবাদীতার বশবর্তী থেকে, অশ্রুসিক্ত নয়নে, আন্দোলনের কারণে মেট্রোরেলের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমান সম্পর্কে, প্রায় এক ডজন দালাল টিভি ক্যামেরার সামনে, হাসিনা একটি রাজনৈতিক অসুদ্দেশ্য-প্রণোদিত অসত্য বয়ান হাজির করেন। তিনি দাবি করেন, ‘ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ’ এই মেট্রোরেল স্টেশনটি সারিয়ে তুলে পুনরায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে ‘কমপক্ষে তিনশ কোটি টাকা’, আর ‘এক বছর’ সময় লাগবে। আসলে, ছাত্র-গণআন্দোলনকে নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিত্রিত করে, দেশে-বিদেশে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল শেখ হাসিনার এই নাটুকে মিথ্যাচারের লক্ষ্য – যা তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট সকলের সামনে উম্মোচিত হয়ে পড়ে। কেননা, ডঃ মুহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ১৭ দিনের মাথায়, ২৫ আগস্ট, মাত্র ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে, কাজী পাড়ার মেট্রো স্টেশনটি সারিয়ে তুলে রেল-যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। আবার, মিরপুর-১০ স্টেশনটি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার তিন মাসের মাথায়, ১৫ অক্টোবর, মাত্র ১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে, পুনরায় চালু করা হয়। স্পষ্টতই, আন্দোলনকালে জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্থ দুটি মেট্রো স্টেশনকে পুঁজি করেও চরম ধোকাবাজ দুর্নীতিগ্রস্ত লীগ-সরকার দুটি নতুন দুর্নীতিমূলক প্রকল্প গ্রহণের আয়োজন করেছিল।

যাই হোক, আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ বন্ধ করতে তাঁদের ওপর পুলিশ ও র‌্যাবসহ আওয়ামী লীগের বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আক্রমণ অব্যাহত থাকে – চলতে থাকে গণগ্রেফতার ও হাজার হাজার গায়েবী মামলা রুজু করা। পাশাপাশি, গ্রেফতারকৃত তরুণদের রিমান্ডে এনে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে, পুলিশ তাঁদের ওপর নির্মম নিপীড়ন চালাতে থাকে। কিন্তু তাতেও সরকার তার কাক্সিক্ষত ফল লাভে ব্যর্থ হতে থাকে।

লীগ-সরকারের প্রাক-অনুমোদনের ভিত্তিতে পুলিশের ডিবি’র গোপন বন্দিশালায় নির্মম নির্যাতনের শিকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চার নেতা, ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিবাদের মুখে বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়ার পর, চিকিৎসার জন্য ২৫ জুলাই রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আন্দোলন দমনের জন্য সরকার ফের এই নেতাদের বন্দি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরদিন সন্ধ্যায়, ২৬ জুলাই, ডিবি’র ছদ্মবেশী কর্মকর্তারা, হাসপাতালে উপস্থিত আত্মীয় পরিজনের মানবিক আর্তনাদ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, অসুস্থ ছাত্রনেতাদের চারজনকেই আবারও ধরে নিয়ে যায়। তার দুদিন পর, ২৮ জুলাই, শিক্ষার্থী আন্দোলনের নারী-সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও বলপূর্বক তুলে নিয়ে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অবৈধ কারাগারে বন্দি করে এবং কুখ্যাত ডিবি’র ও তার ততোধিক কুখ্যাত প্রধান, হারুন অর রশিদ, সেখানে সমবেত করা আন্দোলনের তরুণ নেতৃবৃন্দকে আন্দোলন প্রত্যাহারমূলক একটি পূর্বাহ্নে প্রস্তুতকৃত বিবৃতি, জোড় করে, বন্দুকের নলের মুখে, স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করে। এই বিবৃতিটি ছাত্র-সমাজের আন্দোলন সম্পর্কে কিছুটা সাময়িক বিভ্রান্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল বৈকি।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা জালের বাইরে অবস্থানকারী আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের তিনজন – মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নানকে অজ্ঞাত স্থান থেকে এদিন রাতেই ইতিপূর্বে সরকারের কাছে পেশকৃত ৮-দফা নিরীহ দাবিনামা সহ বন্দি নেতাদের বিবৃতি ‘প্রত্যাহার’ করেন এবং একটি নতুন ৯-দফা দাবি আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ‘সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার’ আহ্বান জানান। নতুন দাবিনামার ভেতর পুরনো দাবিগুলি আরো জোর দিয়ে বলা হয়েছিল, আর তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ‘ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘প্রকাশ্য ক্ষমা’ চাওয়ার দাবি। স্পষ্টতই, মাঠে প্রতিদিন সরকারের পদত্যাগ দাবিতে শ্লোগান উঠলেও, ছাত্র-নেতৃত্ব তখনও সেই দাবিটি নিজেদের পক্ষ থেকে উত্থাপন করেনি। তবে, সংশ্লিষ্ট সকলকে ‘সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার’ আহ্বানটি সরকারি ষড়যন্ত্রপ্রসূত বিভ্রান্তি কেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ইতিমধ্যে, ১০ দিন বন্ধ রাখার পর, ব্যবসায়ীদের চাপে ও দেশে-বিদেশে নিন্দিত হওয়ার মুখে, এদিনই সরকার মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিস উম্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে, তিন সমন্বয়কের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত নতুন বিবৃতিটি সহজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূরিভূত হয়। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরুণ কর্মীরা সড়কে তাদের তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করে। সারাদেশে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ অব্যাহত থাকে, ফলে আকাশ যোগাযোগও যথেষ্ট বিঘ্নিত হয় – যার মাধ্যমে গোটা দুনিয়ায় বাংলাদেশে চলমান স্বৈরতন্ত্রবিরোধী ব্যাপক সংগ্রামের খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ এ সময় রাজনীতির ময়দানে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।

জন্যই কি হঠাৎ করে শেখ হাসিনা সময় তাঁর ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন?

নূরুল কবীর: ঠিক তাই। আন্দোলনের তোড়ে দিশেহারা লীগ-সরকার আন্দোলনকে স্তিমিত করার কৌশল বের করার জন্য তার বহুদিন উপেক্ষিত ১৪ দলীয় জোটভুক্ত রাজনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে ২৯ জুলাই তারিখে শলাপরামর্শে বসে। তাঁরা সে বৈঠকে দুটো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমত, জনস্বার্থপরায়ণ এই গণ-আন্দোলনের সর্বদলীয় সক্রিয় সমর্থকদের রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত করার জন্য পুরো আন্দোলনটির গায়ে জামায়াতে ইসলামীর তক্মা এঁটে দেয়া ও সে প্রক্রিয়ায় অসাম্প্রদায়িক ছাত্র-জনতার লড়াকু মেজাজকে ভোতা করে দেয়া। লীগ-বিরোধী ছাত্র-গণআন্দোলনে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন, ইসলামী ছাত্র শিবির, নিশ্চয় সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু তারা মোটেই এই বিজয়ী সংগ্রামের নিয়ন্তা ছিল না। তবুও আন্দোলনকে প্রশমিত করার বদুদ্দেশ্য পূরণে জামায়াতকে এই সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে চিত্রিত করে লীগ-সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা আরো দু’দিন পর, ১ আগস্ট, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, ১৯৭১ সালে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যাকে সক্রিয় সহযোগিতা দানের অপরাধে জামায়াতকে, সংগঠন হিসেবে, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী আইনের অধীনে বিচার করে নিষিদ্ধ করার দাবি সমাজে বহুদিন ধরে জাগরুক আছে। কিন্তু লীগ-সরকার তার সুবিধাবাদী রাজনীতি চর্চার পথ খোলা রাখার বদুদ্দেশ্যে জামায়াতকে শাস্তি দানের সেই পথে অগ্রসর হয়নি। কিন্তু এবার, গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতার মসনদ টলে উঠলে, সেই আন্দোলনকে কলঙ্কিত করে গদি রক্ষার অপপ্রয়াস হিসেবে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

উপমহাদেশের সমকালীন উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ডামাডোল একদিন বন্ধ হলে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভারতের যথাযথ ‘অবদান’ যথাযথ মাত্রায় সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করবে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে ভারত কীভাবে উপকৃত হয়েছে, সেদিন তারও যথাযথ স্বীকৃতি মিলবে।

দ্বিতীয়ত, এই বৈঠকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র’কে ‘আরো শক্ত’ অবস্থান গ্রহণের, অর্থাৎ আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক সংগঠনগুলিকে আরো নৃশংস ভূমিকা গ্রহণের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এদিকে, একই দিনে, সরকার কর্তৃক ছাত্র-নেতাদের কাছ থেকে জোড় করে অসত্য বিবৃতি আদায়ের প্রতিবাদে, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে, বিশেষত ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, সংগ্রামী শিক্ষার্থীগণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটি অংশও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে যোগ দেন। অন্যদিকে, সরকারের বৈধ ও অবৈধ নানা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীও জাহাঙ্গিরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে ডজন ডজন প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীকে আহত করে। আবার, ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধেই প্রতিদিন রুজু হতে থাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা সহ বিভিন্ন মামলা।

সারাদেশের পথে পথে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার লড়াইয়ের পাশাপাশি, সাইবারপরিসরেও এই সংগ্রামটি বিস্তৃত হয়েছিল। আন্দোলনের সাফল্যের পেছনে সাইবার জগতের সংগ্রামের ভূমিকা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

নূরুল কবীর: অধুনা দেশে দেশে নানা রাজনৈতিক সংগ্রামে রাজপথের পাশাপাশি, বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমও, বিশেষত ফেইসবুক, একটি রনাঙ্গন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের সদ্য সংঘটিত ছাত্র-গণআন্দোলনও তার বাইরে ছিল না। পুরো আন্দোলন কাল জুড়ে, এমনকি তার পূর্ব থেকেই, অসংখ্য তরুণ-তরুণী সরকারের নানা অপরাধ ও অপকর্ম সম্পর্কে ইউটিউব ও ফেইসবুকের মাধ্যমে সমাজকে অবগত রেখেছে, সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয় অবদান রেখেছেন। হাসিনার খুনি সরকারের বিরুদ্ধে নেট দুনিয়ায় দ্রোহী তারুণ্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার এক অনন্য অভিপ্রকাশ ঘটে ৩০ জুলাই, যেদিন সরকারি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে হাজার হাজার মানুষের আপন আপন ‘ফেইসবুক প্রোফাইল’ লাল রঙে রাঙিয়ে ক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এদিন সংগ্রামরত শিক্ষার্থীরা পুলিশি হত্যাযজ্ঞের বিচারের দাবিতে মুখে লাল কাপড় বেঁধে সারাদেশে মিছিল করেছিলেন। শিক্ষকদের একাংশও সেই মিছিলে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। নাটক ও চলচ্চিত্র কর্মীদের একাংশও এই দিন সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক তৎপরতার বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ফেইসবুক সহ সর্বত্র এই প্রতিবাদী তৎপরতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকারপন্থী সাইবার কর্মীরা তাঁদের ফেইসবুক প্রোফাইলগুলি কালো রঙের ফ্রেমে উপস্থাপন করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখেনা, সংখ্যার দিক থেকে, লালের বিরুদ্ধে কালোর পরিমাণ ছিল নিতান্তই নগণ্য। এখানে উল্লেখ্য, দেশে-বিদেশে অবস্থানরত গণতন্ত্রপরায়ন বাঙালি সাইবার এক্টিভিস্টরা, যদিও তাঁদের কেউ কেউ এই আন্দোলনের শুরুতে আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয়াপন্ন ছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁরা প্রায় সকলেই আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দেশি ও প্রবাসী সংশ্লিষ্ট সকলের তৎপরতার ফলে ইতিমধ্যে, হাসিনা-সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী সংগ্রাম দমনে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার কথা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এদিনই, ৩০ জুলাই, জাতিসংঘের মহাসচিব, আন্তোনিও গুটিয়েরেস বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনাসমূহ স্বচ্ছ তদন্তের ভিত্তিতে অপরাধীদের শাস্তি দানের জন্য লীগ-সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু সরকার সারাদেশে সংগ্রামী তরুণদের ধরপাকড় ও তাদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা দায়ের করা অব্যাহত রাখে। তবে, নানামুখী সরকারি সন্ত্রাসে সারা দেশে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করলেও, ছাত্র-জনতার ক্ষোভ এখানে-সেখানে বিক্ষোভ আকারে প্রকাশিত হতে থাকে। এই ক্ষোভ সঞ্চারে এবং বিক্ষোভের বিস্তারে সাইবার পরিসরে তরুণ-তরুণীদের সংগ্রমী তৎপরতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

আমরা আবার রাস্তার আন্দোলনের বর্ণনায় ফিরি।

নূরুল কবীর: হ্যাঁ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের গ্রেফতার এড়িয়ে থাকা নেতাদের আহ্বানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ৩১ জুলাই দেশব্যাপী ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ দিবস পালনের এবং তাঁদের মাধ্যমে আন্দোলনে শহীদ সারাদেশের বীর যোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। এদিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ঢাকাস্থ ডিবি অফিসে গিয়ে, সেখানে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা তাঁদের শিক্ষার্থী ‘সমন্বয়কদের’ নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। কিন্তু ডিবি কর্মকর্তারা শিক্ষকদের সাথে অশোভন আচরণ করে তাড়িয়ে দেন। স্বভাবতই, শিক্ষার্থী-জনতার ভেতর রাগ তীব্রতর হতে থাকে।

পরদিন, ১ আগস্ট, শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন ক্রমশই আরো গভীরতা লাভ করতে থাকে। দেশে-বিদেশে স্বৈরতন্ত্রী লীগ-সরকারের হত্যাযজ্ঞ একটি সুস্পষ্ট ‘গণহত্যা’ হিসেবে আলোচিত ও নিন্দিত হতে থাকে। রাজপথের লড়াইয়ে ছাত্র-জনতার কণ্ঠে হাসিনার আশু পদত্যাগের দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায়, সরকার অবৈধভাবে আটককৃত ডিবি’র অবৈধ বন্দিশালা থেকে আন্দোলনের ছয় জন ‘সমন্বয়ক’কে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু দিনে-রাতে সরকারের গণ-গ্রেফতার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

এবার, ২ আগস্ট, সংগ্রামী শিক্ষার্থীগণ তাদের ৯-দফা দাবিতে সারা দেশে গণমিছিলের কর্মসূচি পালন করেন, যেখানে সর্বস্তরের জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। একই দিনের বিকেলে রাজধানী শহরে অধ্যাপক আনু মুহম্মদের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী, শ্রমিক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও প্রকৌশলী সমাজসহ নানা পেশার প্রায় ১৫ হাজার মানুষের অংশগ্রহণে ‘শিক্ষার্থী-জনতার দ্রোহযাত্রা’ অনুষ্ঠিত হয়। এই ‘দ্রোহযাত্রা’ থেকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, আটক সংগ্রামীদের মুক্তি, কারফিউ প্রত্যাহার ও গণহত্যাকারী হাসিনা-সরকারের পদত্যাগের দাবি উত্থাপিত হয় – যা গোটা সমাজকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। ইতিপূর্বে, এদিন সকাল বেলায়, ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’ এর ব্যানারে ঢাকা শহরে গণতন্ত্রপরায়ন তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, আর সেখান থেকেও পরিস্কারভাবে হাসিনার পদত্যাগের দাবি উত্থাপিত হয়।

ইতিমধ্যে, দিনমান ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের থেকে থেকে সংঘর্ষে কমপক্ষে আরো তিনজন সংগ্রামী গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। গ্রেফতারকৃত প্রতিবাদীর মোট সংখ্যা এদিনে ১৫ হাজার অতিক্রম করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি অব্যাহত ‘নৈতিক সমর্থন’ জানিয়ে যাচ্ছিল এবং তাদের ‘মধ্য পর্যায় থেকে নিম্নপর্যায়ের কর্মীরা’ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ জারি রেখেছিল। ফলে, ছাত্র-জনতার সংঘবদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ গুড়িয়ে দিতে মরিয়া লীগ-সরকার আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষের প্রতিরোধও প্রবলতর রূপ পরিগ্রহ করে।

আন্দোলন ততক্ষণে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। নয় কি?

নূরুল কবীর: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বের দিক থেকে সেদিনও সরকারের পদত্যাগের দাবি ঘোষিত হয়নি।

পরদিন, ৩রা আগস্ট, দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রী সরকারের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। প্রথমত, এদিন সকালে, দেশের সেনাবাহিনী প্রধান তার সেনা কমান্ডারদের সভা ডেকে বিদ্যমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় কি জানতে চাইলে, বিশেষত তরুণ কর্মকর্তারা আন্দোলনরত জনতার প্রতি আর কোনো গুলি না ছোঁড়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ইতিপূর্বে কিছু এলাকায় কোনো কোনো সেনা-কর্মকর্তাকে প্রতিবাদী জনতাকে টার্গেট করে গুলি ছুঁড়তে দেখা গিয়েছিল। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের বার্তা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয়ত, এদিন সায়াহ্নে দেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘সমবেত কয়েক লক্ষ প্রতিবাদী মানুষের সামনে, ছাত্রনেতৃবৃন্দ, নিজেদের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে, পূর্বে প্রণীত তাঁদেরই ৯-দফা দাবিনামা ছুঁড়ে ফেলে, চূড়ান্তভাবে ‘এক-দফা’ – শেখ হাসিনার পদত্যাগ- কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাজপথের সংগ্রামে হাসিনার পদত্যাগের দাবিটি প্রথম থেকেই জনপ্রিয় শ্লোগান হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছিল, কিন্তু ছাত্রনেতৃবৃন্দ এ পর্যন্ত এই শ্লোগানের ব্যাপারে, সম্ভবত কৌশলগত কারণে, ‘সংযমী’ অবস্থান জারী রেখেছিলেন। এদিন রাজপথের ‘জন-দাবি’ আর লীগ-সরকারের নিরন্তর নিপীড়নের মুখে, তাদের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং জন-আকাক্সক্ষার প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে সংগ্রামের স্তরকে চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেন। হাসিনার পদত্যাগ দাবির প্রাক্কালে ছাত্র-নেতৃবৃন্দ পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেন যে, তাঁরা সংগ্রামী ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবেই এক-দফা দাবি ঘোষণা করছেন। জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র ক্ষমতা ব্যবহার না করার বার্তাটিও নিশ্চয় ছাত্র-নেতৃবৃন্দকে এক-দফার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বিশেষ প্রনোদনা যুগিয়েছে।

নিশ্চয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারতো, হওয়া উচিৎ ছিল, প্রয়োজনও ছিল, এখনও তা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জগতের সর্বত্র সবসময় ঔচিত্যমূলক ঘটনা ঘটে না, ভারত-বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটেনি, আর তার জন্য প্রধানত দায়ী ভারতের দূরদৃষ্টিহীন শাসকশ্রেণি, তার অসত্যপরায়ন রাষ্ট্র, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত অসত্য বয়ানে বিভ্রান্ত এক শ্রেণির ভারতীয় ও বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।

একই দিনে সংঘটিত এই দুটো জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মাঝখানে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক উপাখ্যান রচিত হয়। এদিন বিকেলে ঢাকা-ভিত্তিক একদল অতিচেনা তোষামুদে ‘সিনিয়র সাংবাদিক’ – যাঁরা আসলে চিন্তার পরিপক্কতার দিক থেকে নিতান্তই নাবালগ, রাজনৈতিক স্বভাবের দিক থেকে স্বৈরাচারী লীগের ধামাধারা, আর নৈতিকতার দিক থেকে স্থূল ব্যক্তিস্বার্থপরায়ণ সুবিধাবাদী – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এক দীর্ঘ বৈঠকে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী ছাত্র-গণআন্দোলনকে একটি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন, গণতন্ত্রপরায়ণ সংগ্রামী তরুণদের উন্নয়নবিধ্বংসী সন্ত্রাসী অভিহিত করেন, গণতন্ত্রপরায়ন আন্দোলনটিকে আরো ‘কঠোরভাবে’ দমনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাছাড়া, যে কয়েকটি পত্র-পত্রিকা আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠ খবর ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে চলেছিল, এই কথিত সাংবাদিকদের কেউ কেউ সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরামর্শও পেশ করেন। সর্বোপরী, ইতিমধ্যেই তরুণ-তরুণী, শিশু ও বৃদ্ধসহ সহস্রাধিক সংগ্রামী মানুষকে সরকারি হুকুমে হত্যা করার পরও, এই ‘সাংবাদিকগণ’ হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি না করে বরং সরকারের খুনে তৎপরতার প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন এবং তাঁদের অনেকেই  খুনি লীগ-সরকারের প্রতি সকল প্রকার সমর্থন অব্যাহত রাখার নির্লজ্জ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এই সব সরকারি ধামাধরা সাংবাদিকদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতাকে একটি ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে খুন-জখমের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়ার সরকারি কার্যক্রমে প্রণোদনা যোগানো ছাড়া অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।

যাই হোক, এদিন সন্ধ্যায়, ছাত্র-নেতৃত্বের দিক থেকে ‘এক-দফা’ ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রতিটি দল, যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের পুরো জনশক্তিকে রাজপথে নিয়োজিত করেন। সেদিন রাজপথেই রচিত হয়ে যায় স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের পতনের ইশতেহার।

হাসিনা তাঁর গণহত্যার রাজনীতির সাথে সেনাবাহিনীর দূরত্ব রচনা ও আন্দোলনের নেতৃত্ব কর্তৃক সরকারের পদত্যাগ দাবিতে চূড়ান্ত সংগ্রামের ঘোষণার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে, নিজের সহজাত চড়া সূর ও স্বর এবার নরম করে, হাসিনা ছাত্র-নেতৃবৃন্দের সাথে সমঝোতার জন্য প্রত্যক্ষ সংলাপের আহ্বান জানান, তিনি সেযাবৎকাল উপেক্ষিত শিক্ষার্থীদের নয়-দফার দাবির আলোকে কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি মেনে নেয়ারও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন। কিন্তু ততদিনে বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে, অনেক আগেই সমঝোতার সুযোগ হারিয়েছেন লীগ নেত্রী। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে হাসিনার সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিক্রিয়া হিসেবে, হাসিনার সরকার আবারো, একদিকে ‘ইন্টারনেট সার্ভিস’ বন্ধ করে দিয়ে সংগ্রামী শিক্ষার্থী ও অন্যান্যদের ভেতর দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের পথ রুদ্ধ করে দেয়, অন্যদিকে রাজপথে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ‘কঠোরভাবে’ প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রের সশস্ত্র সংগঠনসমূহ ও তাঁর সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দেন।

স্বভাবতই, পরদিন, ৪ আগস্ট, হাসিনার অনুগত পুলিশ বাহিনী ও লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সংগ্রামী শিক্ষার্থী ও জনতার বিরুদ্ধে মরণ কামড় বসানোর মতলবে সকাল থেকেই রাস্তায় সমবেত হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিলগুলিতে আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, চাপাতি ও লাঠি নিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। কয়েকটি স্থানে অতি উৎসাহী কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকেও গুলি করতে দেখা যায়। ওদিকে, লড়াকু ছাত্র-জনতাও লাঠি ও ইট-পাটকেল দিয়ে সর্বত্র দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দিনমান সংঘর্ষে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান, যার বিপুল অধিকাংশই ছিলেন প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার অন্তর্ভুক্ত। বাকিরা ছাত্রলীগ, যুব লীগের কর্মী। ইতিমধ্যে, রাজধানী ঢাকার খামারবাড়ি এলাকায় একটি তরুণকে গুলি করে মৃতপ্রায় অবস্থায় একটি রিক্সার পাদানীতে শুইয়ে দিয়ে রিক্সাচালককে অন্যত্র নিয়ে যেতে হুকুম দেয়। রিক্সাচালক তরুণটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে, সশস্ত্র লীগ কর্মীরা বাঁধা দেয়। রিক্সার পাদানীর দু’দিকে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ তরুণের মাথা ও পায়ের হৃদয়বিদারক ছবিটি ইন্টানেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশের অসংখ্য মানুষের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গিয়েছিল।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আরো কয়েকটি পুলিশি-নির্মমতার ভিডিও-চিত্র সংবেদনশীল মানুষের স্মৃতি থেকে কোনোদিনই অন্তর্হিত হবে না। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন গুলিবিদ্ধ প্রতিবাদী তরুণকে পুলিশের গাড়ি থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলে তরুনের শরীরটি রাজধানীর বড় রাস্তার ডিভাইডারের ওপর ঝুলে থাকে। এমতাবস্থায়, গাড়ী থেকে নেমে এক পুলিশ সদস্য টেনে-হিচড়ে রাস্তায় নামিয়ে বুটশুদ্ধ পা দিয়ে ডিভাইডারের পাশে ফেলে যাচ্ছে। তরুণটির রক্তে ভেজা শরীরে তখনও প্রণি ছিল, নিথর হয়ে যাওয়ার পূর্বে শরীরটি কয়েকবার কেঁপে উঠেছিল। কয়েকজন পুলিশ সদস্য জনতার ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের বন্দুকের গুলি শেষ করে ফেলেন, তাঁদের কেউ-বা আবার জনতার ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে গিয়ে তাদের রুদ্ররোষের শিকারে পরিণত হয়ে প্রাণ হারান। দেশের কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে গুলিবর্ষণকারী পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায় এবং উভয় গ্রুপের সংঘর্ষে প্রতিবাদী সাধারণ মানুষ ও প্রতিরোধকারী পুলিশ সদস্যগণ মৃত্যু বরণ করেন।

প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা তাঁদের এক-দফা আন্দোলনকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য, এদিনই, প্রথমে ৬ আগস্ট, এবং পরে তা এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট, রাজধানী ঢাকামুখী ‘লং-মার্চের’ কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং নানা সামাজিক গণমাধ্যমে ‘ঢাকায় আসো জনতা, ছাড়তে হবে ক্ষমতা’র শ্লোগান সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। এ কর্মসূচি সারা দেশের গণতন্ত্রপরায়ন তরুণ-তরুণীদের ভেতর লড়াকু উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।

ইতিপূর্বে, এদিন বিকেলেই, সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইকবাল করিম ভূইঞার নেতৃত্বে প্রায় অর্ধশত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, একটি বৈঠকে দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ শেষে, সংগ্রামী শিক্ষার্থী ও জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান না গ্রহণ করার জন্য বর্তমান সেনা-নেতৃত্বের প্রতি প্রকাশ্য আহ্বান জানান এবং একই সাথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাঠ থেকে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানান। একটি গণহত্যাকারী সরকারের বিরুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের আলাদা ও সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণের প্রেক্ষিতে আন্দোলন আরো তেজদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিক্ষুব্ধ জনতা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কিছু কিছু শহরে অত্যাচারী মন্ত্রী, এমপি সহ নেতৃস্থানীয় লীগ-সন্ত্রাসীদের অফিস ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এমতাবস্থায়, ভীত-সন্ত্রস্ত লীগনেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যেতে শুরু করে।

পরদিন, ৫ আগস্ট, ঢাকায় সুর্যোদয় হয়েছিল রাস্তায় প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে লীগ-সরকারের বশম্বদ পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তাদের অধীনস্থ সশস্ত্র সদস্যদের আগ্রাসী অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে। অন্যদিকে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ছাত্র-জনতাও ইটপাটকেল নিয়ে শহরের নানা জায়গায় সরকারি বাহিনীর মারমুখী তৎপরতা মোকাবেলা করে এবং সে প্রক্রিয়ায় সরকারি বাহিনীগুলি সাধারণ মানুষসহ অনেক প্রতিবাদী তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোরদের হত্যা করে।

ইতিমধ্যে, শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখী লংমার্চ কর্মসূচির অধীনে, রাজধানী শহরের সবকটি প্রবেশমুখ দিয়ে হাজার হাজার লড়াকু মানুষ গণহত্যাকারী লীগ-সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, প্রাণ হাতে নিয়ে, গগণবিদারী গণতান্ত্রিক শ্লোগান কণ্ঠে, ঢাকায় ঢুকতে থাকে। সেদিন সকালের ঐ শত শত খণ্ড ও অখণ্ড বিদ্রোহী মিছিলের অভিমুখ ছিল ‘গণভবন’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন।

কোনো দেশে ইতিহাসবোধ-সম্পন্ন যথার্থ দেশপ্রেমিক ও সাহসী রাজনীতিকদের নেতৃত্বে যথাযথ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গড়ে ওঠা প্রকৃতই জনস্বার্থপরায়ণ এক বা একাধিক রাজনৈতিক শক্তির প্রবল উত্থান ও সক্রিয় উপস্থিতিই সে দেশের তরফে কোনো আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শোষণ-নিপীড়নমূলক আচরণ থেকে মুক্ত থাকার প্রধান পথ। ভারতের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্পের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্যও ভিন্ন কোনো পথ নেই।

এমতাবস্থায়, ঢাকা শহরের শাহবাগ এলাকায় জড়ো হওয়া কয়েক হাজার প্রতিবাদী মানুষের সবাবেশটি মিছিল রূপে গণভবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে, আর উত্তরা এলাকা থেকে শুরু হওয়া লক্ষাধিক প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীর একটি বিশাল মিছিল ‘গণভবন’ অভিমুখে মোড় ঘুরতেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী’ তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং অনতিবিলম্বে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর প্রাণ রক্ষার আর কোন পথ নেই বলে জানিয়ে দেন। হাসিনা সে মুহূর্তে তাঁর সামনে উপস্থিত জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের ‘গণভবন’ অভিমুখী মিছিলকে প্রতিহত করার আদেশ দেন। কিন্তু একটি রক্তের নদী সৃষ্টি করা ছাড়া ঐ আদেশ কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। সেনাপতিগণ সেই পথে অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না মনে করেন এবং তাঁরা হাসিনা ও গণভবনে উপস্থিত তার বোন রেহানাকে বরং দেশত্যাগের পরামর্শ দেন। শোনা যায়, তারপরও হাসিনা অগ্রসরমান জনতাকে অস্ত্রের মুখে থামিয়ে দেয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু ততক্ষণে অগ্রসরমান জনতার রুদ্র শ্লোগানের শব্দ নিকটবর্তী হতে থাকে। এমতাবস্থায়, সেনাপতিগণ তাঁকে আর সময় দেননি। এতদিনের দোর্দন্ড প্রতাপ হাসিনা অতএব অশ্রুসজল নয়নে, বোনকে নিয়ে, ইতিমধ্যে প্রস্তুতকৃত একটি অত্যাধুনিক সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে, ভারতের উদ্দেশ্যে তাঁর বহুবছরের শোষণ-নিপীড়নের লীলাভূমি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। আর তাঁর পেছনে পড়ে থাকে দেড় হাজারেরও বেশি দেশপ্রেমিক মানুষের লাশ ও ২২ হাজারের বেশি মানুষের পঙ্গুত্ব বাংলাদেশের সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সংগ্রামী আকঙ্খা।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ সম্পর্কে ঢাকার একটি প্রভাবশালী দৈনিক লিখেছিল যে, আগস্ট সকালে, গণভবন অভিমূখী বিশাল প্রতিবাদী মিছিলের অগ্রসরমানতার মুখে, হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য সশস্ত্র বাহিনী প্রধানগণ মাত্র ৪৫ মিনিট সময় দিয়েছিলেন, আর সেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাসিনা তাঁর বোনকে নিয়ে, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সেনা হেলিকপ্টারে চেপে বসেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর অন্য দেশে পলায়নের উপাখ্যান কি একটা ৪৫ মিনিটের ব্যাপার হতে পারে?

নূরুল কবীর: এই বয়ানকে বস্তুনিষ্ঠ মনে করা বেশ কঠিন বৈকি। বৈশ্বিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারনা রয়েছে, এমন ব্যক্তিমাত্রই এই বয়ানকে একটা আষাঢ়ে গল্প হিসেবে উড়িয়ে দেবেন।

খুন-খারাবি ও লুটতরাজের দায়ে অভিযুক্ত একটি দেশের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে সেদেশের ফৌজদারী আইনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অন্য একটি দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কথাগুলি জটিল রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের সীমান্তবর্তী আগড়তলা শহরে গ্রহণ করে, একটি ভারতীয় বিমানে করে, আরো দুটো সামরিক বিমানের প্রহরায় দিল্লীর অনতিদূরে গাড়িয়াবাদের বিমানঘাটিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকারকেও নিশ্চয় ঐ জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। হাসিনাকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত পাকা করার পূর্বে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নিশ্চয় তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নেতাদের সাথে, এমনকি বিরোধী দল ভারতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথেও পৃথকভাবে আলোচনা করতে হয়েছে। এসব আলোচনায়, ভারতকে নিশ্চয় হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের লাভালাভের প্রশ্নটি হিসেব করা ছাড়াও, আশ্রয়দানের ঘটনাটির সম্ভাব্য জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াসমূহ বিবেচনা করতে হয়েছে। এসব যাবতীয় বিচার-বিশ্লেষণ শেষে, কিংবা পাশাপাশি, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথেও মোদীকে কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ করতে হয়েছে। সবশেষে, হাসিনাকে আশ্রয় দানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর, ভারতের আগড়তলা থেকে কয়েকঘণ্টা উড়িয়ে নিয়ে উত্তর প্রদেশে অবতরণ করানোর জন্য একটি যাত্রীবাহী অ্যারোপ্লেনসহ দুটি নিরাপত্তামূলক অ্যারোপ্লেন প্রস্তুত করার জন্যও কয়েক ঘণ্টা সময় খরচ করতে হয়েছে। ফলে, সহজেই অনুমেয় যে, ৫ আগস্ট সকালে মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে, হাসিনার ভারতে পলায়নের সময়সীমা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের বয়ানটি আষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছু নয়।

আমার ধারণা, ছাত্র-গণআন্দোলনের বিস্ফোরকমূলক মাত্রায় বিকাশ লাভের মুখে, ৩ আগস্ট, সেনাবাহিনীর ‘দরবারে’ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার প্রতি গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে মত প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সামরিকচক্র নিজেদের অবশ্যম্ভাবী পতনের অনিবার্যতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করেন।

হাসিনা ও তাঁর ভারতপন্থী সামরিক চক্র ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই ‘প্রয়োজনে’ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্তৃপক্ষসমূহের- রাজনৈতিক, কুটনৈতিক, এমনকি সামরিক বাহিনীর -সঙ্গে সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ইতিমধ্যেই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেছে যে, ৪ আগস্টেই তাঁর মা ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে’ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথ উম্মুক্ত রেখেই, ৫ আগস্টে হাসিনা আরো হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা আকড়ে থাকার চেষ্টা করেছিলেন – যা শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কেননা, বাংলাদেশের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীসমূহ সে প্রচেষ্টায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে, ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত আন্দোলনের দুর্জয় বিজয়ের মুখে গৃহীত হলেও, সশস্ত্র বাহিনী সমূহের এই ভূমিকা হাসিনার পলায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে, রাজনীতি করার জন্য যে দিল্লী থেকে হাসিনা ১৯৮১ সালের মে মাসে ঢাকায় এসেছিলেন, রাজনীতি-চর্চা শেষে ২০২৪ এর আগস্টে সে দিল্লীতেই তিনি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, একটি কানাডা-ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ২৮ আগস্ট দাবি করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার কথা তিনি জানতেন না। বিশ্বাস করেন?

নূরুল কবীর: না। বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও হয় না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারতে পলায়নের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চয় জড়িত ছিলেন। পলায়নপর হাসিনাকে বহনকারী সামরিক হেলিকপ্টারের পাইলট ও ক্রুসহ হেলিকপ্টারটি প্রস্তুত করা নিশ্চয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের বাইরে অন্য কেউ করতে পারেন না। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার যদি সে বিষয়ে অপরিজ্ঞাত থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে, সেনাবাহিনীর ওপর তাঁর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই, বা সে সময়ে ছিল না। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে এহেন অবস্থা তৈরি বলে, তা আমাদের সকলের নিশ্চয় খুব বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হবে। আমার ধারণা, এমন নাজুক অবস্থা সেদিন সৃষ্টি হয়নি। সে যাই হোক, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যাযজ্ঞের জন্য প্রধানত দায়ী শেখ হাসিনাকে, বন্দি করে প্রচলিত আইনে বিচারের আওতায় আনার পরিবর্তে, বিদেশের নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর যে-সব সেনাপতি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের পরিচয় প্রকাশ করা ও তাঁদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সেনা-প্রধানের অপরিহার্য কর্তব্য।

দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে, স্বৈরতান্ত্রিক লীগ সরকারের পতনের অব্যবহিত পর পর, সেই সরকার-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিতর্কিত রাজনীতিক ও পুলিশ কর্মকর্তা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং কিছু দিন পর তাঁরা নিজ দায়িত্বে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। আমি মনে করি, এই সব বিতর্কিত রাজনীতিক ও পুলিশ কর্মকর্তারা জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। সেনা-নেতৃত্বের তরফে এসব গণবিরোধী ব্যক্তিবর্গকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে দেয়া অন্যায় হয়েছে। যাই হোক, সেনা কর্মকর্তারা কোন্ কোন্ রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে নিরাপদে আরো নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, তার একটি বিশ্বাসযোগ্য তালিকা প্রকাশ করা সেনাবাহিনীর কর্তব্য।

ভারত সরকার শেখ হাসিনার মতো একজন খুনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিতে আগ্রহী কিংবা সম্মত হলো কেন বলে মনে করেন?

নূরুল কবীর: এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেতে আমাদের নিশ্চয় আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রাথমিক বিশ্লেষণে সহজেই বলা যায় যে, প্রথমত, হাসিনা ও তার লীগের প্রতি ভারতের কৃতজ্ঞতা পোষণের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে, অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে, যে পরিমান অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে, তা এদেশের অন্য কোনো সরকার দেয়নি। ফলে, হাসিনা ও তাঁর লীগের বিপন্ন দশায় তাঁর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া ভারত সরকারের জন্য একটি নৈতিক দায় হিসেবে হাজির হয়েছে।

তাছাড়া, ভারতের দিক থেকে এই নৈতিক দায় গ্রহণের পেছনেও একটা কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে আধিপত্যকামী ভারত একটি করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলকে তার লেজুড় হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে, যারা আপন আপন দেশে ক্ষমতাশীন থাকার সময় ভারতের স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। কোন দেশে এমন একটি রাজনৈতিক দল বিপন্ন হয়ে পড়লে, ভারত যদি তাকে সহযোগিতা প্রদান না করে, তাহলে অন্য দেশে তার লেজুর দলটি ভারতের ওপর আস্থা হারাবে। শেখ হাসিনা ও তার দলীয় অপরাপর নেতাদের বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা করার প্রয়াসের পেছনে অতএব ভারতের এই কৌশলগত স্বার্থ-ভাবনা সক্রিয় রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, লীগ সরকারের অপমানজনক পতন ও পলায়নের মাধ্যমে বহু বছর পর বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদী স্বার্থ বেশ খানিকটা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এই বাস্তব ঝুঁকি কাটিয়ে উঠে ফের বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পরাজিত ও বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগকে পুনঃসংগঠিত করা ভারতীয় শাসকশ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ফলে, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, হাসিনা ও তার দলবলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে শলাপরামর্শ করার জন্যও, হাসিনার ভারতে অবস্থান করা, অন্তত কিছু সময়ের জন্য, ভারতীয় শাসকশ্রেণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করছি যে, ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকশ্রেণীর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলি স্বৈরতন্ত্রী হাসিনা-সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণতন্ত্রপরায়ন মহান ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে, একটি নিছক ধর্মান্ধ মৌলবাদী উপাখ্যানের তকমা দিয়ে, এদেশের মানুষের সংঘবদ্ধ লড়াকু সংগ্রামকে দুনিয়াব্যাপী কলঙ্কিত করার হাস্যকর অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। একটি ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার অসাধারণ বিজয়কে ম্লান করে দিয়ে, জনবিচ্ছিন্ন লীগকে অচিরেই পুনর্বাসন করার অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই এই ভারতীয় অপপ্রচার ও অপতৎপরতার লক্ষ্য। এ বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের গোপন বৈঠকের খবরও ইতিমধ্যে ফাঁস হয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে মুদ্রিত হয়েছে।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বার্থের বিরুদ্ধে এই ভারতীয় অপতৎপরতা এদেশের মানুষকে আরো বেশি ‘ভারত-বিদ্বেষী’ করে তুলবে, তুলতে বাধ্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন পলায়নের পর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের প্রক্রিয়া বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

নূরুল কবীর: শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে, ৫ আগস্ট, তাঁর নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপি নেতৃস্থানীয় কর্মীরাও পালিয়ে যায়। ফলে, তাৎক্ষণিকভাবে দেশ সরকারশূন্য হয়ে পড়ে এবং ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া পূর্ব পর্যন্ত দেশে এই অভূতপূর্ব অবস্থা বিরাজ করে।

ইতিপূর্বে, হাসিনার পলায়নের পরপরই, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রথমে জাতীয়তাবাদী দল, জামায়াতে ইসলামী ও জনসংহতি সহ বিরোধী শিবিরের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে সরকার গঠন সম্পর্কে পরামর্শ সভা করেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য সেনা-প্রধানকে পরামর্শ দেন। সেনা-প্রধানের সাথে ছাত্র-নেতৃবৃন্দের আলোচনার পর, জাতীয়তাবাদী দলসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সমর্থনক্রমে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তা শেষ পর্যন্ত ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় বাস্তবায়িত হয়। ইউনূসের মন্ত্রীপরিষদ গঠনের প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনী তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইতিপূর্বে, ৬ আগস্ট, রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পু জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন এবং প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত, ৮ আগস্ট, ‘রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণের জরুরি প্রয়োজনে ও ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্ত’ রাষ্ট্রপতিকে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে’ একজন ‘প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা’ নিযুক্ত করার আইনগত ন্যায্যতার পক্ষে মত প্রদান করেন।

নিজের বিপুল ভৌগোলিক আয়তন, বিশাল জনগোষ্ঠী আর বৃহত্তর অর্থনীতির গুণে ভারত, স্বাভাবিকভাবেই, দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নাতীত নেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারতো; কিন্তু একদিকে চানক্য নীতির আলোকে সকল প্রতিবেশীর প্রতি শত্রæভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের জন্য, অন্যদিকে শত্রæবিবেচিত প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে নানা উপায়ে অন্যায্য সুবিধা আদায়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বভাবের কারণে, ভারতের পক্ষে তা হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ভারতের এই সহজাত স্বভাব সহসা বদলানোর সম্ভাবনাও নেই। ওদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় রাজনীতিতে বর্ণবাদক্লিষ্ট হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবল উত্থানের কারণে ভারতীয় জনগণের গণতন্ত্রপরায়ণ অংশও ভীষণ কোনঠাসা হয়ে পড়েছে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইতিপূর্বে শিক্ষার্থী-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদেশে একাধিকবার সরকার পরিবর্তন হলেও, নতুন সরকারে- তত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন অভ্যুত্থানের কোন ছাত্র-প্রতিনিধি গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু এবার বিজয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ছাত্র নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো প্রচলিত সাংবিধানিক বা আইনগত ন্যায্যতা নেই, তবে স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সফল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতা-নেতৃদের প্রস্তাবে, সমাজে সক্রিয় প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা দানের আশ্বাসে ও সেনবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত হওয়ার ফলে সরকারের প্রয়োজনীয় সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায্যতা রয়েছে। কিন্তু গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বিবেচনা করলে, এই ক্রান্তিকালীন সরকারে প্রধান দুর্বলতা হল, যে রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিসমূহ এই সরকার গঠনে সম্মতি ও সহযোগিতা দিয়েছে, তারা এই সরকারের মেয়াদ ও কর্মপরিধি নির্দিষ্ট করে দেয়নি। সরকার নিজেও এখন পর্যন্ত তার কর্মসূচি ও মেয়াদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা জনগণের সামনে তুরে ধরেনি। এটা বিপজ্জনক। কেননা, কোন যথার্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র-পরিচালনার জন্য কোন অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষকে যেমন অনুমোদন করে না, তেমনি কোন নির্বাচিত কর্তৃপক্ষকেও কোন অনির্দিষ্ট মেয়াদ মঞ্জুর করে না। এমতাবস্থায়, বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব, সে আন্দোলনের সমর্থনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আস্থাশীলতার সময়কাল দিয়েই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট হবে। দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার অবশ্য ইতিমধ্যেই, সেপ্টেম্বর ২৫, পশ্চিমা নিউজ এজেন্সি রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির কতগুলি মৌলিক সংস্কার শেষে ‘দেড় বছরের’ মধ্যে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করবে বলে ‘আশা’ পোষণ করেছেন। জাতীয়তাবাদী দলসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলি সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে’ প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিমূর্ত দাবি জানিয়ে আসছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভেতর সংগ্রামী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি থাকলেও, নির্বাচনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ছাত্রনেতৃত্ব এখনও নিরব রয়েছে।

শেখ হাসিনার নৃশংস শাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক ইউনুসের সরকারের কাছে গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। সহস্রাধিক মানুষের পরিবর্তনকামী মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের পর, ভিন্ন নাম ও পরিচয়ে, মানুষ আর স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি, লুটপাট ও পুঁজি পাচারের অর্থনীতি ও জনবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার পুনরাবির্ভাব আর প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন, নির্বাচনের টিকিট বিক্রির ব্যবসা, হানাহানি, চাঁদাবাজি, দখলদারি ইত্যাদি দেখতে চান না।

ওদিকে, ছাত্র নেতৃবৃন্দও বারম্বার দাবি করছেন যে, তাঁদের লড়াকু সংগ্রামের মাধ্যমে তারা ইতিহাসের ‘রিসেট বাটন’ টিপে দিয়েছেন। ফলে, পুরনো বাংলাদেশ এখন এক পরিত্যক্ত অতীত, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে অতীতের ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ আর ফিরে আসবে না – ফিরে আসার সমস্ত রাজনৈতিক ভিত্তির বিলোপ সাধনের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠবে ‘নতুন বাংলাদেশ’। অধ্যাপক ইউনূসও কথাটা বেশ পছন্দ করেছেন বলে প্রতিয়মান হয়, কেননা, তিনি দেশে-বিদেশে এই শ্লোগানটি বেশ সোৎসাহে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছেন। ইতিহাসের অগ্রগতির নিয়মটা এত সহজ ও সরল হলে আমাদের নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ থাকত। কিন্তু, আমরাতো জানি, ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও কষ্টকর আয়াসসাধ্য ব্যাপার, ‘রিসেট বাটন’ টিপলেই অতীতের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বর্তমানের বিচ্ছিন্নতা ঘটেনা, গড়ে ওঠে না কোন এক অবিমিশ্র গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত। বর্তমানের ভেতর যেমন কিছু অতীত নিহিত রয়েছে, ভবিষ্যতের মধ্যেও খানিকটা বর্তমান সক্রিয় থাকবে। তাছাড়া, অতীতের সব কিছুর সাথে আমাদের পরম বিচ্ছিন্নতা ঘটানোর প্রয়োজনও নেই। আমাদের সামাজে সাম্য, ন্যায় ও নাগরিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকারের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে সংগঠিত বাংলাদেশের বিজয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের এক খণ্ড সোনালি অতীত। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিতাড়িত লীগ-সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ প্রতিষ্ঠার নামে বরং সামাজে নিদারুণ বৈষম্য ও ভয়ংকর অন্যায় প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ নাগরিকদের ‘মানবিক মর্যাদা’কে ভুলুণ্ঠিত করে ফেলেছিল। হাসিনার নেতৃত্বধীন লীগোত্তর বাংলাদেশে রবং ৫৩ বছর পূর্বে সংঘটিত মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে সক্রিয় সেই মৌল চেতনাসমূহকে বাস্তবায়ন করার অকৃত্রিম কর্মসূচি গ্রহণ করাই আমাদের ইতিহাসের দায়। লীগ-বিরোধী লড়াকু সংগ্রাম চলাকালে আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণদের কণ্ঠে উচ্চারিত নানা শ্লোগানের মধ্যদিয়ে সমাজের এ প্রত্যাশাই উচ্চারিত হয়েছে। অধ্যাপক ইউনুসের সরকারের কর্তব্য অতএব সে ঐতিহাসিক দায় মেটানোর কার্যক্রম গ্রহণ করা।

কিন্তু ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানুষের প্রত্যাশা কতটা মেটাতে পারবেন, তা দৃঢ়তার সাথে এখনি বলা কঠিন। কেননা, তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, যাঁরা যথাক্রমে অধ্যাপক ইউনূস, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক মনোনিত হয়েছেন, তাঁদের সবাই বিগত ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বিকশিত ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চৈতন্য ও আকাক্সক্ষার গভীরতা উপলব্ধি করেন কি-না, কিংবা তা উপলব্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক মননে তাঁরা প্রত্যেকেই ঋদ্ধ কি-না, তা এখনও স্পষ্ট নয় – অন্তত তাঁদের গতানুগতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে তা এখনও ফুঠে ওঠেনি।

ছাত্র-জনতার লড়াকু সংগ্রামের মুখে স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের পতন ঘটলেও, দীর্ঘ ১৫ বছরব্যাপী লীগের দলীয় স্বার্থে, তারই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক তত্ত্বাবধানে, গড়ে তোলা রাষ্টযন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোটি, তার লুটেরা অর্থনীতি ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতিসহ, পুরোপুরি অক্ষত রয়েছে। এই সরকার, থেকে থেকে, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলছেন বটে, কিন্তু তার কোন সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এখনও তাঁরা উপস্থাপন করেননি।

অধ্যাপক ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি ইতিহাসের দায় কাঁধে নিয়ে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে পরামর্শ করে, অনতিবিলম্বে তার সুনির্দিষ্ট সংস্কার কর্মসূচি ও মেয়াদকাল ঘোষণা করেন, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়কাল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়ে অগ্রসর হন, এবং রাষ্ট্রের যথার্থ গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া খানিকটাও এগিয়ে নিতে পারেন, তাহলে এদেশের ইতিহাসে তিনি একজন ক্রান্তিকালের ত্রাণকর্তা হিসেবে বেঁচে থাকবেন। অন্যদিকে, তিনি যদি ইতিহাসবোধ-বিবর্জিত ও জনবিচ্ছিন্ন ‘সুশীল’ ব্যক্তিবর্গ দিয়ে পরিবেষ্টিত থেকে, অনির্দিষ্ট কালের জন্য অস্পষ্ট কর্মসূচি মাথায় নিয়ে অগ্রসর হন, তাহলে ইউনূস-প্রশাসন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধীতার সামনে পড়বে, তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে, এবং সে অবস্থায় তাঁর উদ্দিষ্ট কর্মসূচি, যা অবশ্য তিনি এখনও স্পষ্ট করেননি, অসমাপ্ত রেখে তাঁকে বিদায় নিতে হতে পারে। এমন হলে, তাঁর নিজের জন্য তো বটেই, গোটা দেশের জন্যও তা হবে দুঃখজনক। আমরা তা চাই না।

-অধ্যাপক ইউনূসের সরকার সম্পর্কে এখানে একটা বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা ইতিমধ্যেই আমি জনসমক্ষে বলেছি। দেশের নানা সংগঠিত শক্তি হিসেবে যারা এই সরকার গঠনে অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের চৈতন্যের ভেতর একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে।

-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম অংশীজন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার, হাসিনার পতন ও পলায়নের পর, ৫ আগস্ট বিকেলে, গোটা জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায়, তাঁর পাশে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নামোচ্চারণ করতে গিয়ে প্রথমেই তিনি তখনো নিষিদ্ধ দক্ষিণপন্থীদল জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা শকিকুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেন – তাও একবার নয়, দুবার। তারপর, লীগের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয় মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নাম মনে করতে তাঁকে হিমশিম খেতে দেখা যায়। আবার, সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রগতিশীল তরুণ রাজনীতিক জোনায়েদ সাকি ও তাঁর দলগত পরিচয় দিতে গিয়েও সেনা প্রধানকে অন্যের সহযোগিতার আশ্রয় নিতে হয়। অথচ ১৫ বছর ধরে চলা গণসংগ্রামে অসংখ্যবার পুলিশি নির্যাতনের শিকার হিসেবে সাকি সারাদেশেই একটি পরিচিত মুখ।

ওদিকে, দেশের লীগ-শাসনোত্তর পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা সম্পর্কে জানার জন্য অধ্যাপক ইউনূস ৩১ আগস্ট জাতীয়তাবাদী দল ও কয়েকটি ধর্মাশ্রয়ী সংগঠনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই দফায় তিনি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়াইরত বামপন্থী দল ও জোটগুলির সাথে আলোচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেননি।

আবার, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ‘পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন’-এর সুপারিশের জন্য শিক্ষামন্ত্রনালয় কর্তৃক গত ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত একটি ১১-দফা বিশিষ্ট ‘সমন্বয় কমিটি’, কতিপয় দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিবর্গের সামান্য প্রতিবাদের মুখে, ২৮ সেপ্টেম্বর ভেঙ্গে দেয়া হয়। দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিবর্গ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বামপন্থী বলে পরিচিত খ্যাতিমান অধ্যাপক, তাঁদের বিরুদ্ধে ড. কামরুল হাসান মামুন ও ড. সামিনা লুৎফা -‘ইসলাম বিদ্বেষী’র তকমা লাগিয়ে এই অন্যায় দাবি উত্থাপন করার পর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিটিটি ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনার মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূস সরকারের দক্ষিণপন্থার প্রতি অনুরাগ আর বামপন্থার প্রতি বিরাগের প্রবণতা আরো প্রকটিত হয়ে ওঠে।

এহেন দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি অধ্যাপক ইউনূস-সরকারের এই নতজানু নীতির সুযোগে, স্পষ্টতই, প্রথমোক্তরা সমাজের ওপর নিজেদের জোর করে চাপিয়ে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছে বাউল সম্প্রদায়ের ওপর বারম্বার আক্রমণ, দরগাহ্পন্থীদের বিরুদ্ধে আক্রোশমূলক সহিংসতা, নারী সম্প্রদায়ের স্বাধীনচেতা অংশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা, প্রভৃতি বৃদ্ধির মাধ্যমে তার অভিপ্রকাশ ঘটছে।

আবার লক্ষ্য করুন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরির জন্য সরকার যে নয়-সদস্য বিশিষ্ট কমিশন ঘোষণা করেছেন, সেখানে নারীর অনুল্লেখযোগ্য হারের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনই প্রতিনিধিত্ব নেই। স্পষ্টতই, কমিশনটি শুধুই এদেশের বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানকে সংশ্লিষ্ট দেশের পুরো জনগোষ্ঠির ‘সাধারণ ইচ্ছার’ অভিপ্রকাশমূলক একটি রাজনৈতিক দলিল হয়ে উঠতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠতে হলে, প্রস্তাবিত সংবিধানকে নারী-পুরুষ, বাঙালি-অবাঙালি, মুসলমান-অমুসলমান সহ এদেশের সকল জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনমূলক দলিল হয়ে উঠতে হবে। এমতাবস্থায়, সংবিধান সংস্কার কমিশনটিও সংশ্লিষ্ট সকল জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া উচিৎ ছিল -বাঙালি-মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী অবয়ব ধারণ করা উচিৎ ছিল না। তবে, এই অনুচিৎ ঘটনাটি যে সরকারের দিক থেকে নিছক একটি ভুলের ব্যাপার ছিল না, বরং তার সহজাত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই ঘটেছে, অপরাপর সংস্কার কমিশনের গঠন ও বিন্যাসের মধ্যেই তার প্রমাণ নিহিত রয়েছে। এ পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি সংস্কার কমিশনে মোট ৪৫জন সদস্য রয়েছেন, আর তার মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৫ জন। সর্বোপরী, কোনো কমিশনেই কোনো অমুসলমান ও অবাঙালি সদস্য নেই। এ প্রবণতা নি:সন্দেহে ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক চেতনার পরিপূর্ণ পরিপন্থি।

বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য এই প্রবণতা বিপজ্জনক। তাছাড়া, ইতিবাচক পরিবর্তনকামী বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির জন্যও এই প্রবণতা শ্রেফ আত্মঘাতি।

আমরা একটু অন্যদিকে ফিরি। বছরের জানুয়ারি মাসে লীগ-সরকারের সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে, বাংলাদেশে থেকে থেকে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনে’ব্যাপারে সমাজে বেশ কথাবার্তা হচ্ছিল। সাম্প্রতিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে লীগ সরকারের পতন পলায়নের পর ভারত, বিশেষত তার মূলধারার সংবাদমাধ্যম, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তার বিজয় সম্পর্কে ভয়াবহ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ শ্লোগানটির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা কতটুকু?

নূরুল কবীর: বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানটি ঠিক ‘হঠাৎ’ করে আসেনি, তার বরং একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে। বর্তমান বছরের শুরুর দিকে শ্লোগানটি প্রথমে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ নেটিজেন বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে উত্থাপন করেন এবং তা দেশের ভেতরেও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এই শ্লোগানটি উত্থাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের জনস্বার্থের প্রতি ভারত সরকারের অব্যাহত বৈরী নীতি দৃশ্যমান পর্যায়ে শত্রুতায় পর্যবসিত হওয়ার পর, যা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ‘ডামি নির্বাচনে’র প্রতি নির্বিবেক ভারত-সরকারের অপরাধী সহযোগিতা ও নির্বিচার স্বীকৃতির ভেতর সুষ্পষ্ট অভিপ্রকাশ ঘটে। এই শ্লোগানটিকে মূলত ভারত রাষ্ট্রের বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতার প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতি-সচেতন দেশপ্রেমিক তরুণদের এক অনন্যোপায় ‘প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এই তরুণরা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্মেষ ও বিকাশ দেখতে চান, আর তার প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানা স্তরে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথার্থ জনপ্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠানের অভ্যুদয়কে যথার্থই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন; কিন্তু তাঁরা দেখতে পান যে, আওয়ামী লীগ অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ওপর দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে কখনও ‘এক দলীয় নির্বাচন’ (২০১৪), কখনও পূর্বাহ্নেই ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করার জন্য ‘রাতের নির্বাচন’ (২০১৮), আবার কখনও বা ‘ডামি নির্বাচনে’র (২০২৪) মাধ্যমে বছরের পর বছর রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করে রেখেছিল।

এই তরুণরা আরো দেখতে পান যে, একদিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রপরায়ণ জনগণ, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি অঙ্গিকারাবদ্ধ বহু রাষ্ট্র ও সংস্থা আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক তৎপরতাকে সমর্থন না করলেও, প্রভাবশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত রাজনৈতিকভাবে অন্যায্য পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠিত লীগ-সরকারকে সর্বময় সমর্থন যুগিয়ে চলছিল। শুধু তাই নয়, লীগের অনৈতিক নির্বাচন-কৌশলকে সহযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর সর্বজনবিদিত চাপ প্রদান – ঐ দেশপ্রেমিক তরুণদের মর্যাদাবোধকে আহত করে। আবার, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত লীগ-সরকারের পক্ষে, কোনো কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ে, ভারত কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়েছে। তাছাড়া, লীগের এক তরফা নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে সক্রিয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা নিয়েও বাংলাদেশের মাঠে-ময়দানে তখন প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনা শোনা যেত।

রাজনৈতিক-দার্শনিক অর্থে ‘বিপ্লব’ হল সেই বস্তু, যা কোন দেশে ইতিহাস-সচেতন রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে – নিরস্ত্র কিংবা সশস্ত্র, কিংবা উভয়বিধ – কোন পশ্চাদপদ শাসকশ্রেণীকে তার ইতিপূর্বে সংগঠিত রাষ্ট্রপাট ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাসহ উচ্ছেদ করে, পুরনো প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার ভগ্নস্তুপের ওপর বিজয়ী শাসিতশ্রেণীর স্বার্থের পক্ষাবলম্বী নতুন প্রগতিশীল রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ তৈরি করে।

ভারতের সক্রিয় সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে একটি জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত করে ফেলেছিল, যার বিষ ফল হিসেবে দেখা গেছে যে, ‘জাতীয় সংসদে’ তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের বিপুল অধিকাংশই একটি ক্ষুদ্র লুটেরা শ্রেনিভুক্ত ধনী ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। অবশিষ্ট ১০০ জনের মধ্যে অধিকাংশই আবার কয়েকটি বিশেষ এলিটধর্মী পেশার ধনবান প্রতিনিধি হিসেবেই পরিচিত ছিল। ২০২৪ এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘ডামি নির্বাচনের’ মাধ্যমে ‘বিজয়ী’ ২৯৯ জন সদস্যের মধ্যে ১৯৯ জনই ছিল ব্যবসায়ী। স্পষ্টতই, এ দেশের ‘জাতীয় সংসদ’কে, নানা শ্রেনি, সম্প্রদায় ও পেশার প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে, প্রধানত একটি ক্ষুদ্র লুটেরা বিত্তবানশ্রেণির রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অধঃপতিত করা হয়েছিল। এই রাজনৈতিক প্রপঞ্চের অবশ্যম্ভাবী কুফল হিসেবে, বাংলাদেশে ধনী-গরিবের আয়-বৈষম্য এদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রদত্ত সরকারি হিসেব অনুসারেই, দেশের বিত্তবান শ্রেনির সবচেয়ে ধনবান পাঁচ শতাংশ পরিবার জাতীয় সম্পদের ৩০.০৪ শতাংশের মালিক হয়েছে। অন্যদিকে, দেশের গরিব শ্রেনির অন্তর্গত সবচেয়ে গরিব পাঁচ শতাংশ পরিবারের হাতে রয়েছে মোট জাতীয় সম্পদের মাত্র ০.৩৭ ভাগ। সমাজে আধিপত্যশীল এই বিত্তবান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শ্রেনিটি রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগে তার দলগত ও গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই শ্রেণিটির কোনো জবাবদিহিতা নেই, কেননা রাষ্ট্রের কোনো বিভাগের ওপরই জনগণের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে, শেখ হাসিনার শাসনামলে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একটি ‘গণতান্ত্রিক রিপাবলিক’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ারও ন্যায্যতা হারিয়েছিল।

নিজ দেশে বিকশিত এই জনস্বার্থ-বিরোধী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রবাসী তরুণদের প্রায় সকলেই স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও, তাঁদের অধিকাংশকেই তৎকালে সংগ্রামশীল রাজনৈতিক শিবিরের কোনো দলের সঙ্গেই সরাসরি যুক্ত বলে প্রতীয়মান হয় নি। বাংলাদেশের লীগ-বহির্ভূত রাজনৈতিক শিবিরের নানা দলের আদর্শ-উদ্দেশ্য সম্পর্কে, এমনকি লড়াইয়ের কৌশল সম্পর্কেও, বরং এই দেশপ্রেমিক তরুণদের নানা সমালোচনা ছিল, কিন্তু সে দলগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার মতো সামর্থ তাঁদের ছিল না। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জনস্বার্থের পরিপন্থী পররাষ্ট্রনীতি চর্চার জন্য ভারতকে নিরস্ত করার কোনো প্রত্যক্ষ শক্তিও এই তরুণদের করায়ত্ব ছিল না – এখনো নেই। নিজেদের এহেন ‘অসহায়’ পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা বন্ধের জন্য ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে একটা পরিষ্কার বার্তা দেয়ার জন্য, এই দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী তরুণরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা বাস্তবায়ন করার জন্য-কি বিরোধী, কি সরকারি – কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থাকার প্রয়োজন ছিল না, জনগণের মধ্যেও ঐ আহ্বানের ইতিবাচক সাড়া পড়া শুরু হয়েছিল।

একটি স্বৈরতন্ত্রবিরোধী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ভারতের প্রতি সংশ্লিষ্ট তরুণদের রাগ নিশ্চয় খানিকটা প্রশমিত হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনে ভারত সরকার ও তার বশবিদ সংবাদ মাধ্যমসমূহ দৃশ্যতই ভিষণ অসন্তুষ্ট। ফলে, এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের গায়ে দেশে-বিদেশে কালিমা লিপ্ত করার জন্য তাঁরা, পলাতক লীগ নেতা-কর্মীদের মতই, বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায়, ভারতীয় পণ্য বর্জনের শ্লোগনটির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা ও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

ভারতীয় পণ্য বর্জনের শ্লোগানটি বাংলাদেশে কোনো সামাজিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছিল কি? এটা কি কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে পারত? আর তা হলেই কি ভারতের বাংলাদেশ-নীতি পরিবর্তনে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে?

নূরুল কবীর: দেখুন, আপনি নিজেই বলেছেন, এই শ্লোগানটি চালু হওয়ার পর তা নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ কথা-বার্তা হয়েছে, লীগ-আমলে দেশের পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শিবিরগুলিও বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বির্তকে লিপ্ত হয়েছিল। তার মানে, এই শ্লোগানটি আমাদের সমাজে এক ধরনের ‘প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া’ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে তখন জেনেছিলাম, ঢাকায় মধ্যবিত্ত সমাজভুক্ত রাজনীতি-সচেতন অংশের অনেকেই এই শ্লোগানের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, ঢাকার বাইরে কর্মরত কোনো কোনো সাংবাদিক সহকর্মীও আমাকে অভিন্ন ধরনের খবর জানিয়েছিলেন। ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে এই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার জন্য পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী ভারতীয় কোম্পানিগুলি বাংলাদেশের বাজারে তখন কিছুটা মূল্যছাড় দেয়াও শুরু করেছিল। আমার ধারণা, পতিত লীগ-সরকারের কাছেও এসব তথ্য ছিল, নতুবা প্রধানমন্ত্রীসহ তিন/চারজন মন্ত্রী আর লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবী ভারতীয় পণ্য বর্জনের শ্লোগানদাতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিষোদ্গার উদগীরনে লিপ্ত হতেন না। ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এই শ্লোগানের বিরুদ্ধে তখন তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। যার মানে, ভারতীয়দের অনেকেই আপন দেশের অর্থনীতির ওপর এই শ্লোগানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আশঙ্কা করছিলেন।

যাই হোক, এই শ্লোগানটি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি ‘সামাজিক আন্দোলনে’ রূপান্তরিত হবে কি-না, তা বেশ কয়েকটি উপাদানের ওপর নির্ভর করবে। সাধারণভাবে, কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তার প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর জন্য অপরাপর দেশের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ আর ভারতও এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। ওদিকে, প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে, এমনকি বিত্তবান শ্রেনির অর্থনৈতিক জীবনে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্যও, কী ধরনের পণ্য ক্রয় ও ব্যবহার করে তা, সাধারণত, নির্ভর করে নির্দিষ্ট পণ্যের- কি দেশি, কি বিদেশি। গুণগত মান ও মূল্যের ওপর। সেক্ষেত্রে, একদিকে, বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভারতীয় নানা পণ্যের বিকল্প কি কি ধরনের পণ্য রয়েছে, তার গুণগত মান ও মূল্য কী রকম, অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানিকৃত শিল্পের কাঁচামালের বিকল্প উৎস কী কী, আর সেসবের মান ও মূল্যের কি অবস্থা, ইত্যাদি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হবে।

তবে, ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ আন্দোলনটি মর্মের দিক থেকে, ততটা জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে বিকশিত হয়নি, যতটা বাংলাদেশের বিভিন্ন ‘জাতীয় স্বার্থের’ প্রতি ভারতীয় বৈরিতার বিরুদ্ধে, যেমন- বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জনগণের গণতান্ত্রিক স্বার্থ-বিরোধী হস্তক্ষেপ, সীমান্তে নিরন্তর বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, বাংলাদেশকে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদানে অনীহা, বাংলাদেশ থেকে নানা ধরনের একপাক্ষিক সুবিধা আদায়, ইত্যাদি দেশপ্রেমিক তরুণদের সংক্ষুব্ধ ‘রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে অভিব্যক্ত হয়েছে।

কিন্তু, বাংলাদেশের জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যদি ভারতের নেতিবাচক বাংলাদেশ-নীতির বিরুদ্ধে কখনো সুচিন্তিত ‘রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের আকারে’ গ্রহণ করে, তাহলে এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে অর্থনীতির ‘সাধারণ তত্ত্ব’ পুরোপুরি কার্যকর থাকবে না – দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের কিছু সাময়িক ক্ষয়-ক্ষতি মেনে নেবে তেমন অবস্থায় ভারতীয় পণ্য বর্জন ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। মনে রাখবেন, কিছু কিছু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও অঙ্গিকার, বিশেষত ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ, কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রাণপণ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বর্তমান ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ আন্দোলনের পেছনে সক্রিয় দেশি ও প্রবাসী চৌকষ তরুণরা যদি তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত রাখেন, আর বাংলাদেশের কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি যদি এ আন্দোলনে এমনকি গোপন সমর্থনও জারি রাখে, তাহলে এই আন্দোলন একটি তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে, ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী তরুণদের ন্যায্য অভিযোগগুলি কী কী, তা খতিয়ে দেখে ভারতীয় শাসকশ্রেনিকে তার বিদ্যমান বাংলাদেশ-নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে বৈকি। কেননা, ভারত বাংলাদেশে ২০২২-২০২৩ সালে আইনিভাবেই এক লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য রফতানি করেছে, আর বেআইনিভাবে, সীমান্তপথে, ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেনি আরো দ্বিগুণ পরিমাণ, অর্থাৎ আরো দুই লক্ষ কোটি মূল্যের পণ্য সামগ্রী বাংলাদেশের বাজারে পাঠিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন। এই তিন লক্ষ কোটি টাকার ১০ শতাংশ পরিমাণ রফতানিও যদি ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ শ্লোগানের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ভারতীয় অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়তে বাধ্য। তাছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যের হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের ট্যুরিজম ও স্বাস্থ্য শিল্প বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে নির্ভরশীল। দেশি-বিদেশি নানা নির্ভরযোগ্য গবেষণা অনুযায়ী, ভারত ভ্রমণকারী টুরিস্টদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা সর্বোচ্চ – বছরে পঁচিশ লাখের বেশি, আর ভারতে স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়কারী বিদেশিদের বেশি অর্ধেকই বাংলাদেশি। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ একটি সামাজিক-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করাটা ভারতের শাসকশ্রেণির জন্য বিপজ্জনক বৈকি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের যে সকল দেশপ্রেমিক তরুণ জাতীয় স্বার্থে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ শ্লোগান উত্থাপন করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সমাজে একটি ইতিবাচক সাড়া আশা করেছিল, তাদের কিন্তু অনেক বিরূপ সমালোচনার মোকাবিলা করেই এগুতে হবে। ভারতীয় রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীগণ তো বটেই, দিল্লী-কলকাতার তাঁবেদার বাংলাদেশী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীগণও তাঁদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত থাকবে। লীগ-সরকারের পতনের পূর্বে তার লক্ষণও স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, শ্লোগানটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্লোগানদাতাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের মাত্রাও তীব্রতর হবে। লীগ-সরকারের অপমানজনক পতন, লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন ও আশ্রয় লাভ, তাঁর পতিত এমপি-মন্ত্রীদের সীমান্তপথে ভারতে আশ্রয় লাভের সফল-অসফল প্রচেষ্টার পর এই আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়।

ইতিহাসের কথা বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের শ্লোগান’ এবারই প্রথম ওঠেনি। এই শ্লোগানটি প্রথম উত্থাপন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৭৩ সালের জুনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ভারতীয় শাসকশ্রেনির একাংশ, ‘ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে’ – এরকম একটি অপবিশ্বাসের ভিত্তিতে, বাংলাদেশকে একটি ‘করদ রাজ্য’ হিসেবে বিবেচনা করে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলে, মওলানা তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। তিনি, সে বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে, চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক জনসভা থেকে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান’ জানান। বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রভাবশালী প্রধান নেতার এই আহ্বানে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের একাংশ তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠে এবং মওলানার বিরুদ্ধে নানাবিধ কুৎসা রটনা ও অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। কলকাতা-ভিত্তিক ভারতীয় দৈনিক আনন্দবাজার ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা প্রথম তিন সপ্তাহেই, মওলানাকে ‘শয়তান’, ‘বেঈমান’, ‘ধূর্ত’, ‘ধুরন্ধর’, ‘পাগল’, ‘নিমকহারাম’, ‘বুড়া’, প্রভৃতি অশালীন বিশেষণে ভূষিত করে। দৈনিক অমৃতবাজার, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডারড ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকাও অভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করে। এইসব পত্র-পত্রিকা মওলানার টুপি ও দাঁড়ি নিয়েও কটাক্ষ করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র অভিযোগ উত্থাপন করে।

বাংলাদেশের কয়েকজন দেশপ্রেমিক ও সাহসী বুদ্ধিজীবী সেদিন মওলানার পক্ষাবলম্বন করে স্বার্থান্ধ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীতার কিছু প্রতিবাদও করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী আমহদ ছফা, ‘মওলানা ভাসানীর অপমান – গোটা জাতির অপমান’ শিরোনামে, সে বছরের অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, মওলানাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে চিত্রিত করা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীতার তরফে ‘ধৃষ্টতা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িতাবিরোধী রাজনীতির জনক’। তাছাড়া, বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক ইতিহাসে’ মওলানা ভাসানী ‘পিতামহ ভীষ্মের ভূমিকা পালন করেছেন’ জানিয়ে, ছফা ‘ভারতীয় সাংবাদিকবৃন্দের কাছ থেকে সভ্য মানুষসুলভ ব্যবহার প্রত্যাশা’ ব্যক্ত করেছিলেন।

স্পষ্টতই, বাংলাদেশী তরুণদের সাম্প্রতিক ভারতীয় পণ্য বর্জনের শ্লোগানের প্রেক্ষিতে, স্বভাবতই, ভারতীয় সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের একাংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল এবং ভবিষ্যতেও তাই করবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের চিন্তাশীল দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীতাও নিশ্চয় ভারতীয় প্রতিক্রিয়ার প্রত্যুত্তরও যোগাবে।

ভারতীয় গণমাধ্যমসমূহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় নাগরিকও বাংলাদেশী তরুণদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনকে ভারতের প্রতি সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশীদের ‘ঐতিহাসিক অকৃজ্ঞতা’ হিসেবে চিত্রিত করছিল। ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

নূরুল কবীর: ভারতের শাসকশ্রেনিভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাদেশী তরুণদের দেশপ্রেমিক শ্লোগানের প্রতি যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল, তা ছিল বাংলাদেশে বিকাশমান ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের সম্ভাব্য সাফল্যের প্রতি তাঁদের ভীত প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অন্যদিকে, যে ভারতীয় গণমাধ্যমকর্মীরা গণতন্ত্রপরায়ণ বাংলাদেশী তরুণদের একটি দেশপ্রেমিক আহ্বানকে ভারতের প্রতি ‘ঐতিহাসিক অকৃতজ্ঞতা’ হিসেবে চিত্রিত করেছে, তাঁরা, আমার ধারণা, বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অনবগত – স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান সম্পর্কে স্বার্থান্ধ ভারতীয় শাসকশ্রেনিভুক্ত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের নির্মিত অনৈতিহাসিক বয়ানের অসহায় বুদ্ধিবৃত্তিক শিকার। এঁদের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে পারলে, অনুমান করি, এঁদের অনেকেই নিজেদের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তন করবে।

ভারতীয় শাসকশ্রেনির বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তার আপন শ্রেনির রাজনীতিকদের মতোই অপপ্রচার করে বেড়ায় যে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের শাসকশ্রেনিভুক্ত আজ্ঞাবহ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশও বাংলাদেশের জন্ম সম্পর্কে অভিন্ন সরলিকৃত বয়ান জারি রেখেছে। শুধু তাই নয়, ৫৩ বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তানের সরকারসমূহ এই অসত্য বয়ান তাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ দিয়ে, উভয় দেশে, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস প্রসঙ্গে একটি করে রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরি করেছে। বাস্তব সত্য হলো- তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শাসকশ্রেনির নয়া-উপনিবেশবাদী শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের দীর্ঘ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৭০ সালের শেষে, ভোটের রাজনীতিতে পূর্বের কাছে পশ্চিম পরাজিত হয়; কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রদত্ত জন রায়কে মেনে নিতে নারাজ পশ্চিম-ভিত্তিক শাসকশ্রেনি অস্ত্রের বলে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য পূর্বের নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর, ১৯৭১ এর মার্চে, গণহত্যামূলক সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে। পশ্চিমের এই গণহত্যা, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, পূর্বাঞ্চলে প্রতিরোধ-সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটায়। রাজনীতি-সচেতন বেসামরিক তরুণদের প্রতিরোধ প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে, পূর্বের গ্যারিসনে গ্যারিসনে আত্মমর্যাদাবান তরুণ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকগণ তাঁদের পশ্চিমা কমান্ডারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রুখে দাঁড়ালে প্রাথমিক ‘প্রতিরোধ সংগ্রাম’ অনতিবিলম্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হয়।

ওদিকে, সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী পূর্ব-পাকিস্তানভিত্তিক আওয়ামী লীগের দিক থেকে, তখনো পর্যন্ত, আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত পেশাদার (পশ্চিম) পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে লড়াই করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সামরিক প্রস্তুতি ছিল না- ইতিহাসের রাজনৈতিক বিচারে, লীগের দিক থেকে, তখন তা থাকার কথাও ছিল না। এমতাবস্থায়, পূর্বের প্রধান রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করেন, আর তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের অপরাপর নেতারা গ্রেফতার এড়িয়ে স্থল-সীমান্ত পথে পার্শ্ববর্তী ভারতে প্রবেশ করেন এবং সেখান থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সূচিত সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে সুসংগঠিত রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত-সরকারের সহযোগিতা কামনা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন দুঃসাহসী বাঙালি মেজর, জিয়াউর রহমান, মুজিবের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জনসাধারণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানালে, বাংলার উজ্জীবিত তরুণ সম্প্রদায় তাৎক্ষণিকভাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়।

পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী সাধারণভাবে পুরো বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্য শুরু করলেও, প্রথমদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাঙালিকে তার নৃশংস আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। ফলে, জীবন রক্ষার জন্য, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি, বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশও সীমান্তপথে বিনাবাঁধায় ভারতে (অনু)প্রবেশ করে। পাকিস্তানি নৃশংস আক্রমণের শিকার এই অসহায় বাঙালিদের ভারত সরকার, ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, দ্রুততার সাথেই আশ্রয় দেয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওদিকে, বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে, ভারত সহযোগিতা করবে কি-না, করলেও তা প্রত্যক্ষ-না-পরোক্ষভাবে করা উচিৎ, তাতে ভবিষ্যতে ভারতের কি ধরনের লাভ-ক্ষতি হতে পারে, বাংলাদেশের যুদ্ধ-প্রয়াসের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ালে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে, ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বহু তর্ক-বিতর্কের পর ভারত-সরকার, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে, বা অন্য কথায়, নিজেদের তৎকালীন প্রধান ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত শত্রু হিসেবে বিবেচিত ‘পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করাই ভারতের জন্য লাভজনক’ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ভারত-সরকারের তৎকালীন নীতি-নির্ধারকদের ভেতর অনুষ্ঠিত উপরোক্ত বিতর্কে দুটি ‘চরম’ বিপরীতধর্মী যুক্তিও প্রদর্শিত হয়েছিল। একপক্ষ ‘পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করাই ভারতের জন্য লাভজনক’ মনে করে ‘অনতিবিলম্বে’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওকালতি করেছিল। এই পক্ষের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ-প্রয়াসটি শত্রুদেশ পাকিস্তানকে টুকরো করে ফেলার জন্য ভারতের সামনে এমন এক ‘সুযোগ’ তৈরি করেছে, যা ‘শতাব্দীতে একটির বেশি মেলে না। অন্য পক্ষটি পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করা ভারতের জন্য শেষ বিচারে ক্ষতিকর হবে বিবেচনা করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রয়াসকে সাহায্যদান থেকে বিরত থাকার জন্য ওকালতি করেছিল। দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তি ছিল, মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলে, শেষ পর্যন্ত শত্রু হিসেবে ‘ভারতের দুই পাশে দুটি বৈরী পাকিস্তান’ বিরাজ করবে।

ভারতীয় শাসকশ্রেণীভুক্ত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের ভেতর এসব বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শেষে, তৎকালীন ভারত-সরকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পাকিস্তানের খণ্ডিভবনের ভেতরই ভারতের চূড়ান্ত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নিহিত রয়েছে এবং সে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তবে, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিকাশের সেই পর্যায়ে, বাংলাদেশের তরফে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে, ভারত বরং পেছন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্র যোগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশও, ভারতের সহযোগিতায়, নিজের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিজেই চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

স্পষ্টতই, পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ভারতীয় কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা সেদিন ইতিহাসের এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল, উভয় পক্ষের ‘জাতীয় স্বার্থ’ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ বিবেচনা সেই কৌশলগত ভারত-বাংলাদেশ মেলবন্ধন রচিত হওয়ার পেছনে সক্রিয় ছিল না। এটাকেই ইংরেজিতে বলে রিয়েলপলিটিক।

পরর্বতীকালে, ভারতীয় শাসকশ্রেনিভুক্ত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীসম্প্রদায় প্রচার করে বেড়ায় যে, বাংলাদেশের মানুষের জাতিগত আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকারের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি ‘নীতিগত’ ভাবাদর্শিক অবস্থান থেকে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করেছেন। ভারতীয়দের এই দাবির পেছনে আদৌ কোনো সত্য নেই। কেননা, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও নিপীড়নের শৃংখল ভাঙ্গার জন্য লড়াই করছিল, ঠিক তখন ভারতীয় শাসন-শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজো ও নাগা জনগোষ্ঠীও তাঁদের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’র সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল, কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নাগা ও মিজোদের আঞ্চলিক ‘জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে’ বরং ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে নৃশংসভাবে দমন করেছে – ঠিক বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতার লড়াইকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ যেসব অপবাদ দিয়ে দমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরী জনগণের প্রতিও অভিন্ন আচরণ করে ভারত-সরকার করে চলেছে এখনও।

আবার, ভারতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে ‘মানবিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেছিল বলেও দাবি করে থাকেন, কিন্তু এই দাবিও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ভারতের, এমনকি সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের, বহু হৃদয়বান নাগরিক ব্যক্তিগতভাবে, বাংলাদেশে সংঘটিত নির্মম ও নিষ্ঠুর পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। বহু ভারতীয় লেখক-শিল্পী বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য কষ্ট করে টাকা-পয়সা জোগাড় করেছেন, আবার এঁদের অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করার কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোনো রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার বস্তুগত, ভাবদর্শগত কিংবা কৌশলগত স্বার্থের বাইরে, কেবলমাত্র মানবিক কারণে, বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে ভারতও দাঁড়াইনি। কোনো গণহত্যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের যদি তেমন কোনো নীতিগত চিরকালীন ‘মানবিক’ অবস্থান থাকতো, তাহলে ভারত নিশ্চয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ৫ এপ্রিল ২০২৪ অনুষ্ঠিত বৈঠকে, প্যালেস্টাইনে ইসরাইলী গণহত্যা বন্ধের জন্য, জায়নবাদী ইসরাইল সরকারকে অস্ত্রসরবরাহ স্থগিত করার জন্য আনীত ‘মানবিক’ প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থাকতো না।

যাই হোক, বাংলাদেশের হাজার হাজার মুক্তিকামী তরুণ নিজেদের যুদ্ধ প্রধানত নিজেরাই করেছেন। ভারত তাদের অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে নিশ্চয় সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রয়াসী সেই যুদ্ধ-প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, ভারতে প্রশিক্ষিত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতাদর্শভিত্তিক নানা গ্রুপের স্বাধীন উদ্দ্যোগে প্রশিক্ষিত-পাকিস্তান বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ মুক্তি-গেরিলাদের সহযোগিতা করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যাকাণ্ডসহ নানা বর্বর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, নিরাপত্তার তাগিদে কয়েক কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে চেনা-অচেনা নানা এলাকায় অসহায়ের অনিশ্চিত জীবনযাপন করেছেন, অসংখ্য বাংলাদেশী নারী হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার স্থানীয় দালালদের যৌন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওদিকে, ভারতে আশ্রিত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী, স্বদেশে অবস্থানরত সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মতো প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয় নিয়ে জীবন যাপনের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকলেও, দীর্ঘ নয় মাস ধরে শরণার্থী জীবনের অসম্মান হজম করেছেন। আবার, তাঁদের একটি বিরাট অংশ, ন্যূনতম ৫ লক্ষ মানুষ, অনিবার্য ক্ষুধা ও অসুখের অসহায় শিকার হিসেবে নানা শরণার্থীশিবিরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। অর্থের অভাবে অনেক শরণার্থী আত্মীয়-পরিজনের মৃতদেহ যথাযথ পদ্ধতিতে সৎকার করতেও সমর্থ হননি, নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

এদিকে, চরম বৈরী পরিস্থিতির ভেতরও তরুণ বাংলাদেশী মুক্তিসেনারা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে, যুগপৎ গেরিলা যুদ্ধ ও সম্মুখ সময়ের মাধ্যমে, অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে, একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। ফলে, ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষে, একদিকে পাকিস্তানি বাহিনী সারা বাংলায় মার খেতে খেতে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অনিবার্য পরাজয়ের মুখে, পাকিস্তান-সরকার ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারতের ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করে এবং ভারতের প্রতি-আক্রমনের মুখে সঙ্গে সঙ্গেই ‘বাংলাদেশ-যুদ্ধ’ একটি ত্রিমাত্রিক লড়াইয়ে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয়ের গ্লানিকে লাঘব করার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজনেই, পাকিস্তান-সরকার ভারতের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে -যাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিজ দেশের জনসাধারণের সামনে ‘মুখ রক্ষা’র জন্য দাবি করতে পারে যে, তারা বাংলাদেশের ‘অপেশাদার’ মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়, অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিমান ও পেশাদার ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করেছে।

যাই হোক, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ আক্রমণের মুখে, মাত্র ১৩ দিনের মাথায়, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ঢাকায় আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীন উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে, ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান রাজনৈতিক, সামরিক ও নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তার মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার ‘পরাশক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বাংলার মাটিতে, মার্কিনী গবেষক গ্যারি জে. বাসের দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড পুস্তকে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী, ১,০২১ জন ভারতীয় সৈনিক, ভারতীয় সেনাপতি জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তাঁর সারেন্ডার এট ঢাকা: বার্থ অফ এ নেশন নামক পুস্তকে এই সংখ্যা ১,৪১১ বলে উল্লেখ করেছেন – বাংলার রনাঙ্গণে আত্মাহুতি দিয়েছেন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে সাথে ভারতীয় কূটনীতিকগণ সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সাহায্য করেছেন, ভারত-সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট অংশকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, প্রায় এক কোটি বাংলাদেশীকে নয় মাস ধরে আশ্রয় দিয়েছে, এগুলো সবই অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক ঘটনা। ভারতের এসব সহযোগিতার জন্য ‘সাধারণভাবে’ বাংলাদেশের মানুষ এবং ‘বিশেষভাবে’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিশ্চয় ‘কৃতজ্ঞতা’ পোষণ করে।

কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা বাংলাদেশকে কৃতজ্ঞতার কারাগারে চিরবন্দি একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখতে চান, তাঁদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রধানত বাংলাদেশীরাই লড়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাটি মোটেই পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল ভারতীয় বাহিনীর ১৩ দিনের যুদ্ধ আর ১,০২১ কিংবা ১,৪২১ জন ভারতীয় সৈন্যের আত্মদানের ফসল নয়। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁরা এই সত্যটি উপলব্ধি করতে অসমর্থ, তাঁদের যথাযথ উপলব্ধির জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে, ১৯৮৭ সালের জুনে, ভারত প্রথমে নিজেদের মাটিতে প্রশিক্ষিত পার্শ্ববর্তী শ্রীলংকার তামিলদের পক্ষে ও পরে তামিলদের বিরুদ্ধে সিংহলী সরকারের পক্ষে শ্রীলংকায় ভারতীয় সৈন্যের একটি বিরাট বহর পাঠিয়েছিল। কিন্তু তারা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে সে দেশে যুদ্ধ করে, শ্রীলংকার সিংহলী ও তামিলদের জাতিগত সংঘাতের ভেতর নিপতিত হয়ে – ভারতের প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ভি.পি. মালিক তাঁর ‘ইন্ডিয়া’স মিলিটারি কনফ্লিকটস অ্যান্ড ডিপ্লোমেসী’ পুস্তকে যেমন লিখেছেন – নিজেদের ১,১১৫ জন্য সৈন্য হারিয়ে, ‘অত্যন্ত অসম্মানজনক ভাবে’, ১৯৯০ এর মার্চে ভারতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সেনাবাহিনী নিশ্চয় শ্রীলংকায় তাঁদের ঐ শোচনীয় ব্যর্থতার কথা ভুলে যায়নি।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের ‘সাফল্যের’ কারণ ভিন্ন। দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আপন দেশের স্বাধীনতার জন্য হাজারে হাজারে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা অকাতরে প্রাণ দিয়ে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীকে ক্লান্ত ও পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, ভারতের ওপর পাকিস্তানি হামলার প্রেক্ষাপটে, ভারতীয় বাহিনী সরাসরি বাংলাদেশ-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের স্বাধীনতার জন্য ‘মিত্র শক্তি’ হিসেবে ভারতীয় বাহিনীকে সক্রিয় সহায়তা যুগিয়েছিলেন, আর এসব কারণেই কথিত ‘১৩ দিনের যুদ্ধে’ পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল।

বাংলাদেশ-যুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অতএব ‘অতিরিক্ত’ আদিখ্যেতা দেখানোর কিছু নেই – তাঁদের বরং উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রশাসন অনেক হিসেব-নিকেশ করেই, নিজেদের ভবিষ্যত রাজনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধার জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর সেই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই লাভবান হয়েছে। ফলে, এক্ষেত্রে ‘উপকার’ ও ‘কৃতজ্ঞতা’র প্রশ্নটি একপাক্ষিক হতে পারে না, উপকৃত বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মকর্তা ছিলেন যাঁরা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ভূমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেশ বিদেশে প্রচার করার ভবিষ্যৎ কুফল উপলব্ধি করে, শুরুতেই ভারতীয় আদিখ্যেতা বন্ধ করার উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন তৎকালীন কর্মকর্তা, শশাঙ্ক এস. ব্যানার্জী, বহু বছর পরে, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে, ঢাকা-ভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাকে জানিয়েছেন যে, ১৯৭২ সালের শুরুতে ভারত-সরকার একটি ‘গোপন সার্কুলার এর মাধ্যমে’ ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদেশে কর্মরত সকল কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে ‘বেশি কৃতিত্ব দাবি না করার’ নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘আপন স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষ অসংখ্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং এ স্বাধীনতা মূলত বাংলাদেশের জনগণেরই অর্জন’।

ভারতের সরকারি গোপন সার্কুলার ছাড়াও, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো কোনো চিন্তাশীল ভারতীয় নাগরিক, যেমন ড. অশোক মিত্র, শুরুতেই পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে ভারত সরকারকে বাংলাদেশের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল নির্বিকারত্বের নীতি’ চর্চার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, “বাংলাদেশীদের স্বাধীন হতে সাহায্য করেছি বলেই তাঁরা আমাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে না; আমরা যদি এখন থেকে নিজেদের সন্তর্পণে সামান্য সরিয়ে রাখি, খুব বেশি ওদের ব্যাপারে নাক না-গলাই, তাতেই উভপাক্ষিক মঙ্গল।” অশোক মিত্র পরবর্তীকালে আপন স্মৃতিকথায় – আপিলা-চাপিলা – লিখেছেন, ‘[কিন্তু] কে শোনে কার কথা’। অর্থাৎ, সেদিন তাঁর পরামর্শে ভারতীয় প্রশাসন কর্ণপাত করেনি। বাংলাদেশে ‘ভারত-বিদ্বেষ’ ‘মাথাচাড়া দিয়ে’ ওঠার জন্য অশোক মিত্র প্রধানত ভারতীয় বাড়াবাড়িকেই দায়ী করেছেন। স্পষ্টতই, এই বাড়াবাড়ির ফল কোনো পক্ষের জন্যই শুভ হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য ভারতের প্রাপ্য সার্বজনীন ধন্যবাদটুকুও এখন হারাতে বসেছে – এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের ‘পরিপূর্ণ’ কৃতিত্ব দাবির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটি ‘সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া’। এতে অবশ্য চিন্তাশীল ভারতীয়দের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। একজন ইতিহাস গবেষক হিসেবে আমি উপলব্ধি করি, তাঁরাও নিশ্চয় উপলব্ধি করেন, উপমহাদেশের সমকালীন উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ডামাডোল একদিন বন্ধ হলে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভারতের যথাযথ ‘অবদান’ যথাযথ মাত্রায় সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করবে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে ভারত কীভাবে উপকৃত হয়েছে, সেদিন তারও যথাযথ স্বীকৃতি মিলবে।

আপনার তত্ত্বায়ন অনুযায়ী, স্বাধীনতা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত উভয়েই উপকৃত হয়েছে। উভয় দেশে এই উপলব্ধি জাগ্রত থাকলে তো ভারত বাংলাদেশের ভেতর সত্যিকার অর্থেই একটি কার্যকর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিকশিত হতে পারত, কিন্তু বাস্তবে তো হয়নি। কেন?

নূরুল কবীর: নিশ্চয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারতো, হওয়া উচিৎ ছিল, প্রয়োজনও ছিল, এখনও তা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জগতের সর্বত্র সবসময় ঔচিত্যমূলক ঘটনা ঘটে না, ভারত-বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটেনি, আর তার জন্য প্রধানত দায়ী ভারতের দূরদৃষ্টিহীন শাসকশ্রেণি, তার অসত্যপরায়ন রাষ্ট্র, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত অসত্য বয়ানে বিভ্রান্ত এক শ্রেণির ভারতীয় ও বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। আনুষ্ঠানিকভাবে, কূটনৈতিক পর্যায়ে, দুদেশের সম্পর্ককে যতই বন্ধুত্বমূলক হিসেবে বর্ণনা করা হোক না কেন, বিগত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় শাসকশ্রেণী ও তার বিভিন্ন সরকারের নিরন্তর বৈরী আচরণের ফলে, বাংলাদেশের মানুষের ভেতর ভারত সম্পর্কে একটা গভীর বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় প্রথম প্রহর থেকেই দু’দেশের সম্পর্ক তেতো হতে শুরু করে। কয়েকমাস আগে, গত ২৫ জুন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের একাঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে রেল যোগাযোগের অনুমোদনের ব্যাপারে ‘সামাজিক মাধ্যমে বিরূপ সমালোচনা’র প্রতি এক তোষামুদে লীগপন্থী সংবাদকর্মী দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, লীগ-প্রধান ও অধুনা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লীগপন্থী সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ১৯৭১ সালে ‘[পাকিস্তানি] হানাদার বাহিনী ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল’। ইতিহাসের এই অতিসরলীকৃত বয়ান হাজির করার মাধ্যমে হাসিনা বাংলাদেশের বিজয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং এই বিতর্কিত বয়ানের মাধ্যমে তিনি, প্রকারান্তরে, ভারতকে তাঁর সরকার-প্রদত্ত নানা অন্যায্য সুবিধা দানের ওপর ন্যায্যতা আরোপের চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস শেখ হাসিনার এই ‘ভারত পন্থী’ বয়ানকে সমর্থন করে না। ইতিহাসের তাবৎ তথ্য-উপাত্ত স্বাক্ষ্য দেয় যে, প্রধানত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারাই আপন দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেছেন, বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও তা জানে, তখনও জানতো, কিন্তু ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, আত্মসমর্পন-দলিলে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানির স্বাক্ষর তো ছিলই না, তিনি যাতে বাংলাদেশের এই গৌরবজনক মুহূর্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে না পারেন – সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সতর্কতার সঙ্গে সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিল। বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর পক্ষে বাংলাদেশের বিজয়-দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এই ঐতিহাসিক দলিলটির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ণায়ক ভূমিকাকেই শুধু ম্লান করা হয়নি, তাঁদের এই বীরোচিত ভূমিকাকে, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রীতিমত গায়েব করে দেয়া হয়েছে।

পরবর্তীকালে এ ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দৃশ্যমান হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে, কোনো কোনো ভারতীয় কূটনীতিক, যেমন স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের প্রথম ডেপুটি হাই কমিশনার ও পরে সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব, জে এন দীক্ষিত (১৯৩৬-২০০৫), ঘটনাটিকে তাঁর পুস্তকে – লিবারেশন এন্ড বিয়ন্ড: ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশন্স – তৎকালীন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে ‘একটি’ অপরিনামদর্শী ‘ভুল’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু, বাংলাদেশের চিন্তাশীল নাগরিকগণ এটাকে নিছক একটি নিরীহ ‘ভুল’ হিসেবে উপেক্ষা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন না, বরং বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের ওপর ভারতীয় আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যে একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করেন। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের গায়ে একটি ‘কুৎসিৎ জন্মদাগ’ হিসেবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে একটি দগদগে ঘায়ের মতো চিরদিন বিরাজ করবে, আর তার পাশাপাশি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশীদের ‘জাতীয়তাবাদী অহম’কে নিরন্তর আহত করে চলবে, যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে নীরবে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে থাকবে। আমি মনে করি, উভয় দেশের ভবিষ্যৎ সুসম্পর্কের স্বার্থে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অনুতাপ প্রকাশ করা উচিৎ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে, সে স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের অপরিমেয় আত্মত্যাগকে, ছোট করে দেখার কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশকে অধীনস্ত করে রাখার ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর প্রবণতাটি স্বাধীনতার প্রাক্কালেই বরং পরিস্ফুট হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই, যখন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কাছে নিজ দেশের স্বাধীনতা আসন্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ‘প্রশাসক’ নিয়োগ শুরু করেন এবং ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তৎকালীন ১৭টি জেলায় ‘প্রশাসক’ নিয়োগ দান সম্পন্ন করেন। ভারত-সরকারও নিশ্চয় বাংলাদেশের আসন্ন স্বাধীনতা আঁচ করে থাকবে। এমতাবস্থায়, কলকাতা-কেন্দ্রীক বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা কিংবা অনুমোদন ছাড়াই, বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালনার জন্য ভারত-সরকার, ১১ ডিসেম্বর, তিনজন ভারতীয় কমিশনার ও ১৭ জন ‘জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট’ বাংলাদেশে নিয়োগ দান করেন এবং তাঁদের কেউ কেউ ১৬ ডিসেম্বর বিকেলেই বাংলাদেশে পৌঁছে জেলা-সদরে অবস্থিত কয়েকটি সার্কিট হাউসে উঠে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাজ করার আনুষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রের সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও কয়েকজন ভারতীয় কর্মকর্তা ঢাকার রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্রে এসে হাজির হয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে, তাঁরা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমসমূহে দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে পারেনি, কিন্তু এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের আদি আকাংক্ষা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায় বৈকি!

ইতিপূর্বে, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অভিযানের মুখে ৭ ডিসেম্বর তারিখেই যশোর শহর ও সেনানিবাস পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। সে বিজয়ী অভিযানের সর্বাগ্রে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর একটি দল, তার পেছনে ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে রণাঙ্গনে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একটি দল, আর সবার পেছনে ছিল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল, কিন্তু যশোরে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা-কেন্দ্রীক প্রভাবশালী ভারতীয় দৈনিক, আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘যশোর আমাদের’ শিরোনামে বড় করে ঐ সংবাদটি পরিবেশন করেছিল – যা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে এতটাই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিনই সংবাদ-শিরোনামটির জন্য ‘ভুল স্বীকার করে’ পরদিন একটি সংশোধনী ছাপানোর অনুরোধ জানাতে খ্যাতিমান বাংলাদেশী সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু গাফফার চৌধুরী তাঁর ‘আমরা বাংলাদেশী, না বাঙালি’ পুস্তকে লিখেছেন, আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদের সেই ন্যায়সঙ্গত অনুরোধ রক্ষা করেনি।

আবার, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র ভারতীয় বাহিনী শত শত ট্রাক বোঝাই করে ভারতে নিয়ে যায় – যা ন্যায়ত বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল। এ নিয়ে তখুনি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীন যাত্রার সেই প্রথম প্রহর থেকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এহেন আধিপত্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দু’দেশের মধ্যে একটি সুস্থ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বিকাশের অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।

অন্যদিকে, উভয়দেশের সম্পর্কের ভেতর কূটনৈতিক অবিশ্বাসের আদি বীজটাও ভারতীয় সরকারই বুনেছিল। দুদেশের ভেতর প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টাই দেখুন না কেন!

পাকিস্তানি জমানায়, ১৯৬১ সালে, বাংলাদেশের সীমান্তের প্রায় ১৭ কিলোমিটার উজানে, গঙ্গা নদীর ওপরে, ফারাক্কায়, ভারত-সরকার একটি বাধ নির্মাণ শুরু করেছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক নদী আইনের অধীনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আপত্তির কারণে সে বাঁধ নির্মাণ করতে ভারত ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে, ভারত সরকার ‘বাংলাদেশের সাথে আলাপ না করেই’ ফারাক্কা বাঁধ পুনঃর্নিমাণ শুরু করে এবং ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে গঙ্গার পানি প্রবাহিত করার জন্য ‘ফিডার ক্যানেল’সহ, বাঁধ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করে।

আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী, কোনো উজানের দেশই ভাটির দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে, একতরফাভাবে উজানে পানি প্রত্যাহারের অধিকার রাখে না। আর বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশের জন্য গঙ্গাসহ অন্যান্য নদীর পানি প্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে, ভারতের সঙ্গে ৫৪ টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বন্ধুত্বসুলভ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করে পানির সুষ্ঠু বণ্টনের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই আন্তরিক ছিল। এমতাবস্থায়, ভারতের বিশেষ অনুরোধে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার, সরল বিশ্বাসে, ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সর্বমোট ৪০ দিন, গঙ্গা থেকে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে ১১ হাজার কিউসেক পানি ভাগীরথী ও হুগলী নদীতে, ‘পরীক্ষামূলকভাবে’, প্রবাহিত করার অনুমতি প্রদান করেছিল। কিন্তু নির্ধারিত ৪০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অবিশ্বস্ত প্রতিবেশীর ন্যায়, ভারত তার ‘পরীক্ষামূলক’ পানি প্রবাহের প্রক্রিয়া আর কখনও বন্ধ করেনি। পরবর্তীকালে, নানা সরকারের আমলে, স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন অসম চুক্তির অধীনে, গঙ্গা নদীর পানির অন্যায্য বণ্টন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশের অব্যাহত অনুরোধ সত্ত্বেও, তিস্তাসহ ভারতের সাথে অপরাপর ৫৩টি অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষম বণ্টন ব্যবস্থা, ভারতের অনীহার কারণে গত ৫৩ বছরেও অমিমাংসীত রয়ে গেছে।

ভারত ও বাংলাদেশের ভেতর ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ‘ল্যান্ড বাউন্ডারি ডিমার্কেশন’ চুক্তি বাস্তাবয়নের প্রশ্নেও দিল্লী বহুবছর অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় থেকে অখণ্ড পাকিস্তানি জমানার ২৩ বছর ধরে, দিল্লী ও ইসলামাবাদের ভেতর বৈরী সম্পর্কের কারণে, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভেতর সীমানা চিহ্নিত করা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সম্পাদিত এই চুক্তির অধীনে এক দেশের অভ্যন্তরে অন্যদেশের ছিটমহল গুলি চিহ্নিত করে উভয় দেশের মধ্যে বিনিময়ের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে, ১৯৭৫ সালে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত বহুলালোচিত ‘বেরুবাড়ী’ গ্রামসহ বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময়ের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সরল বিশ্বাসে, সকল আইনী জটিলতা অতিক্রম করে, সে বছরই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনও করেছিল। কিন্তু ছিটমহলগুলোর বিনিময় প্রক্রিয়া ভারত সরকার, নানা আইনী ও বেআইনী অজুহাতে, ৪০টি বছর ঝুলিয়ে রাখে। শেষ পর্যন্ত, বহু দেন-দরবার শেষে, ২০১৫ সালে, একটি নতুন চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়। ভারতীয় শাসকশ্রেনির নানা সরকারের তরফে এই বিলম্বের প্রধান বোধগম্য কারণ হল, দুই দেশের ভেতর সম্পাদিত চুক্তির অধীনে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য ছিট মহলগুলো হস্তান্তর করলে, ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ-কিলোমিটার আয়তন-বিশিষ্ট বিশাল ভারতকে, মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গ-কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য সামান্য ০.১৬ বর্গ-কিলোমিটার বা ৪০৪৭ বর্গ-মিটার জমি ছেড়ে দিতে হত। বলার অপেক্ষা রাখেনা, ক্ষুদ্র হৃদয়-বিশিষ্ট ভারতের এহেন স্থূল স্বার্থপরায়ন কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের কাছে এই দেশটিকে মোটেই সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেশীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেনি।

বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতর প্রকৃত অর্থে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দিল্লীর এসব ‘উপনিবেশবাদী’ বৈরী কর্মকাণ্ড এক বিশাল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির রয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের প্রতি ভারতীয় রাষ্ট্রের অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধার সবচেয়ে দৃশ্যমান অভিপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক, নিয়মিত বিরতিতে, বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের অবৈধ হত্যাকণ্ডের ভেতর। উল্লেখ্য, ২০০০ ও ২০২০ সালের মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোট ১২৩৬ জন বাংলাদেশীকে সীমান্তে গুলি করে হত্যা করেছে। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের এই খুনের সংখ্যা যথাক্রমে ১৭, ২৩ ও ৩০ জন; আর ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের ১৩ জন নাগরিক ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। এ ধরনের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপক্ষ নিহত বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে পণ্যের চোরাচালান ও ভারতীয় সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ ও অজুহাত তুলে ধরে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিশ্চয় চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে, আর সীমান্ত অঞ্চলে চোরাচালানীর কর্মকাণ্ডে উভয় দেশের সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী, এমনকি উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাও জড়িত থাকে – একথা সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত। ভারত ও বাংলাদেশের ভেতর বিরাজিত ‘অবৈধ সীমান্ত অর্থনীতি’ নিয়ে গবেষণালব্ধ প্রচুর তথ্যাদিসংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষেরই অধিকারে রয়েছে। অন্যদিকে, সীমান্তে চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে উভয়দেশেই আইন ও বিচারের মাধ্যমে শাস্তি বিধানেরও ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা বরাবরই তাদের গ্রেফতার করেছে, কখনই গুলি করে হত্যা করেনি; কিন্তু ভারতে বেআইনী অনুপ্রবেশের অপবাদে কিংবা অপরাধে, বাংলাদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে নিরন্তর আইন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালনার ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম অস্তিত্বের প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আধিপত্যবাদী অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে চলেছে।

এ বছর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী এমনকি বাংলাদেশের খোদ স্বাধীনতা দিবসে, ২৬ মার্চ, একজন বাংলাদেশী নাগরিককে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ অভিযোগে খুন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে একজন বাংলাদেশীকে আইন ও বিচারবহির্ভূতভাবে খুন করার একটি প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে – এই খুনের মাধ্যমে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতর বিরাজিত ‘গভীর বন্ধুত্বমূলক’ সম্পর্কের আওয়ামী দাবিকেই শুধু অট্টহাস্যে উড়িয়ে দেয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেও পরিষ্কারভাবে অবজ্ঞা করেছে। ভারতের দিক থেকে এটা শুধু আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন নয়, এমনকি একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধ মাত্রও নয়, বরং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদী ভারতীয় শাসকশ্রেনির একটি উপনিবেশবাদী রাজনীতি-চর্চা। বাংলাদেশ সীমান্তে, এমনকি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অভ্যন্তরে, বাংলাদেশের নাগরিকদের নিয়মিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি অন্যত্র ব্যাখ্যা করেছি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদী ভারত একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, যার উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের মানুষের ভেতর এই মর্মে একটি হীনমন্যতাবোধ জাগ্রত করা যে, বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অসমর্থ্য, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বরং ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন – পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলো পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে প্রায় সাড়ে চারশ বছর ধরে এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশিত জনগণের মনোজগতে এই হীনষ্মন্যতাবোধ সঞ্চার করা ও জাগ্রত রাখার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ জারি রেখেছে। ফলে, ভারতের উস্কে দেয়া এই উপনিবেশবাদী মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয় লাভ করা বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যাই হোক, বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতর প্রকৃত অর্থে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দিল্লীর এসব ‘উপনিবেশবাদী’ বৈরী কর্মকাণ্ড এক বিশাল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির রয়েছে।

আপনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ‘সাধারণভাবে’, আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী শরণার্থীগণ ‘বিশেষভাবে’ কৃতজ্ঞতা পোষণ করেন। এই ‘সাধারণ’ ও ‘বিশেষ’ কৃতজ্ঞতার কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি?

নূরুল কবীর: একটি দেশের জনগণের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত একটি জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় লাভের মাধ্যমে যখন সে দেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদেশের মানুষ একদিকে যেমন জাতিগতভাবে গর্বিত বোধ করেন, অন্যদিকে তার বিজয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল বিদেশি ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র সহযোগিতা করে, তাঁদের প্রতি ‘সাধারণভাবে’ কৃতজ্ঞতা পোষণ করেই – করাই উচিৎ। আবার, কোনো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল বিদেশি ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র যে মাত্রায় সহযোগিতা করে, সে দেশের মানুষ তাঁদের প্রতি সে মাত্রায়-ই কৃতজ্ঞতা পোষণ করেন। বাংলাদেশের সফল স্বাধীনতা যুদ্ধে, অপরাপর দেশ ও তাদের জনগণের তুলনায়, ভারত ও তার জনসাধারণ সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন। স্বভাবতই, বাংলাদেশের মানুষ ভারত ও তার জনগণের প্রতি, সাধারণভাবে, সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা পোষণ করবেন।

অন্যদিকে, যে-কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধে নানা রাজনৈতিক ভাবাদর্শপন্থী বিভিন্ন সংগঠন অংশগ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম ছিল না। মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগ ছাড়াও, বামপন্থী রাজনৈতিক শিবিরের একাধিক দল ও গ্রুপ স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে; কিন্তু তৎকালীন ভারত-সরকার ও প্রশাসন তাদের মতাদর্শগত রাজনৈতিক স্বার্থে, একদিকে যেমন আওয়ামী লীগকে নানাভাবে সমর্থন যুগিয়েছে, অন্যদিকে যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ওপর নিজেরই স্বার্থে আওয়ামী লীগের দলীয় নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার জন্য, বামপন্থী রাজনৈতিক শিবিরভুক্ত বিভিন্ন দল ও গ্রুপগুলোর প্রতি বৈরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যুদ্ধ প্রক্রিয়াকে বামপন্থার প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য ভারত-সরকার এমনকি বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও প্রদানের বিরুদ্ধে, লীগ-নেতৃত্বের সহযোগিতায় কঠোর অবস্থান জারি রেখেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ভারতভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশ-সরকারের নেতৃত্বের প্রশ্নে, যুদ্ধ পরিচালনার রণ নীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন প্রশ্নে, এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধ অব্যাহত রাখা কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিত্যাগ করে পাকিস্তানি সামরিকজান্তার সাথে আপস-মীমাংসার প্রশ্নে, কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অব্যাহত রাখার জন্য এবং সে যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ওপর লীগের নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক প্রভাব বলবৎ রাখার জন্য, ভারত-সরকার ও তার প্রশাসন অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত লীগের বিভিন্ন উপদলগুলোর ভেতর সমঝোতা সৃষ্টির সক্রিয় প্রয়াস গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তদুপরি, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যাতে তার নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক আধিপত্য জারি রাখতে সক্ষম হয়, স্বাধীন যুদ্ধ-তৎপরতার মাধ্যমে ক্রমশ শক্তিমান হয়ে ওঠা বামপন্থী রাজনৈতিক শিবির যাতে স্বাধীন দেশে নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখতে না পারে, সেই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার বাছাই করা তরুণ কর্মীদের সমন্বয়ে, আওয়ামী লীগেরই যুবনেতাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংগঠন রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানলিসিস (র)-এর তত্ত্বাবধানে, প্রবাসী লীগ-সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন ‘মুক্তিবাহিনীর’ সমান্তরালে, ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে -যে বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যগণ এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোথাও কোথাও বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

এমতাবস্থায়, ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৃতজ্ঞতাবোধ, আর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অপরাপর বাংলাদেশী সংগঠনসমূহের কৃতজ্ঞতাবোধ সমপর্যায়ভুক্ত হতে পারে কি? তাছাড়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণভাবে সহযোগিতা করেও, রাষ্ট্র হিসেবে যে ভারত বাংলাদেশের ভিন্নমতাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বৈরী আচরণ করেছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারত কতটা কৃতজ্ঞতা আশা করতে পারে?

বাংলাদেশের জনগণের প্রশ্নেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের তৎকালীন ৭.৫০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৬.৫০ কোটি মানুষ স্বদেশেই অবস্থান করেছিলেন দেশের অভ্যন্তরে গণহত্যকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী-আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকায় প্রতিটি দিন মৃত্যু ও নিপীড়নের ঝুঁকি নিয়ে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়িয়ে, ভয়াবহ অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, আর সে প্রক্রিয়ায় এখানে-সেখানে হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী শরণার্থীগণ উদ্বাস্তু জীবনের অসম্মানজনক জীবনযাপন করলেও, প্রতিদিন সম্ভাব্য পাকিস্তানি সশস্ত্র হামলার আতঙ্কময় জীবনের দুর্বহ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তাঁদের দিনাতিপাত করতে হয়নি। শরণার্থী জীবনের বেদনাদায়ক দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করলেও, নিজের চোখের সামনে সন্তানের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতার মোকাবিলা করতে হয়নি। সেক্ষেত্রে, ভারতের প্রতি এক কোটি দুঃখী বাংলাদেশী শরণার্থীর কৃতজ্ঞতাবোধের মাত্রা আর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নিপীড়নের প্রত্যক্ষ শিকার – শারীরিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক, স্বদেশে অবস্থানরত সাড়ে ছয় কোটি মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধের মাত্রা কি অভিন্ন হতে পারে? সে জন্যই বলেছি, বাংলাদেশের সফল স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষই ভারতের প্রতি ‘সাধারণভাবে’ কৃতজ্ঞতা পোষণ করতে পারে, আর সেই যুদ্ধে ‘বিশেষভাবে’ উপকৃত হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ‘বিশেষভাবে’ কৃতজ্ঞতা পোষণ করার কারণ রয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লীগ-বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরভুক্ত কিছু কিছু দল বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারতের প্রতি ‘সাধারণ’ কৃতজ্ঞতাবোধের অনুভূতিও অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।

নূরুল কবীর: এটা একটা ‘আপতিক’ বাস্তবতা। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উত্থানের পর বাংলাদেশের কতকগুলো নিজস্ব রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তৈরি হয়েছে Ñ যা কখনো কখনো ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মধ্যে এই সব স্বার্থের সংঘাতকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, উভয় পক্ষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নিয়ে, বন্ধুত্বপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।

কিন্তু আমরা বরাবরাই দেখতে পাই যে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্নগুলি নিরসনের জন্য ভারত কখনই বাংলাদেশের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত পথে অগ্রসর হয় না, বরং অন্যায়ভাবে সুবিধা নেয়ার জন্য ভারতের প্রতি ‘বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ’ আওয়ামী লীগকেই সরকারে আনতে বা অন্যায়ভাবে সরকারে থাকতে সাহায্য করে চলে। বহু বছর ধরে ভারতের এই আচরণের ফলে লীগ-বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের ভেতর ভারত-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার ও পুঞ্জিভবন ঘটেছে কিন্তু বাংলাদেশের এই সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক শিবিরের নেতৃস্থানীয় কাউকে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবদানকে কখনোই অস্বীকার করতে শুনিনি। অস্বীকার করা উচিতও নয়। তবে, একথা সত্য যে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ভারতের নেতিবাচক ভূমিকার জন্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শিবির ছাড়া, অন্যকোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে ভারতের প্রতি নিরন্তর কৃতজ্ঞতা আশা করা নিতান্তই অযৌক্তিক।

পক্ষান্তরে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কৃতজ্ঞতাবোধের মাত্রা ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে- যা ভিন্নমতাবলম্বী অনেক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ক্ষেত্রে ঘটে নি। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত লীগ-সরকার তার বামপন্থী প্রতিপক্ষ শক্তিসমূহকে দমন করার জন্য, প্রধানত ‘মুজিব বাহিনী’ কর্মকর্তাদের অধীনে যে প্যারামিলিটারি ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠন করেছিল, ভারতীয় সেনাকর্মকর্তারা ঢাকায় এসে সে বাহিনীর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। লীগ, সেকারণে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করতেই পারে, কিন্তু ভারত-প্রশিক্ষিত ‘রক্ষী বাহিনীর’ অবিচার-অত্যাচারের নির্মম শিকার অসংখ্য বামপন্থী নেতা-কর্মী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে ভারত নিশ্চয় কৃতজ্ঞতা আশা করতে পারে না।

অন্যদিকে, ভারতের প্রতি পলাতক শেখ হাসিনার ভেতর এমনকি বিশেষ ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতাবোধও ক্রিয়াশীল রয়েছে, যা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কেননা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন লীগ-সরকারের রক্তাক্ত পতন ও পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে, লীগেরই নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি লীগ-সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে, জেনারেল জিয়ার শাসনামলে, নতুন লীগ-প্রধান হিসেবে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তারিখে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তাঁর জীবনের দুর্বিসহ সময়কালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষই হাসিনাকে বোন ও স্বামী-সন্তানসহ ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল।

তাছাড়া, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত যে তিনটি ‘প্রহসনমূলক’ জাতীয় নির্বাচনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, যে তিনটি নির্বাচন দেশে-বিদেশে যথাক্রমে ‘একদলীয় নির্বাচন’, ‘রাত্রীকালীন নির্বাচন’ ও ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে, সেগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারত আওয়ামী লীগকে একদিকে যেমন সক্রিয় সহযোগিতা দান করেছে, অন্যদিকে সেই সব ‘নির্বাচনে’ কথিত ‘বিজয়’ অর্জন করার জন্য, কর্তৃত্ববাদী চীনের পাশাপাশি, হিন্দুত্ববাদী ভারতও লীগকে প্রয়োজনীয় ‘স্বীকৃতি’ যোগান দিয়েছে। কিন্তু লীগ-সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত এই একের পর এক প্রহসনমূলক নর্বাচনের মাধ্যমে এ দেশের নির্বাচন-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল এবং জনগণের তরফে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নানা স্তরে যথার্থ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার গণতান্ত্রিক অধিকার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন-ব্যবস্থা ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে লীগের ক্ষমতাভোগে সহায়তা করার জন্য, ভারতের প্রতি লীগ-নেতৃত্ব বিশেষ কৃতজ্ঞতা পোষণ করতেই পারে, কিন্তু বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলোসহ এদেশের জনসাধারণ কীভাবে কৃতজ্ঞতা পোষণ করবে?

পরিশেষে, লক্ষ করুন, লীগের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ ছাত্র-জনতা যখন এক তুমুল রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ আগস্ট লীগ-সরকারের পতন ঘটাতে সমর্থ হয়, যখন দেড় দশক জুড়ে গুম, হত্যা, লুটপাট ও অর্থপাচার সহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য লীগের শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা সহ অপরাপর নেতা-কর্মীদের বিচারের সম্মুখীন হওয়ার উপক্রম হয়, তখন একদিকে বিচারের কাঠগড়া থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, অন্যদিকে জনরোষে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগকে পুনঃসংগঠিত করার প্রয়াস গ্রহণের জন্য, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও তার বোনকে, হাসিনার অনুরোধ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লীগ-পন্থী কর্মকর্তাদের একাংশের দৌত্যে, ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা ও প্রায়োগিক সুযোগ প্রদান করে। বিপদাপন্ন হাসিনার ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর, তাঁর অনেক দুর্নীতিবাজ এমপি, মন্ত্রী ও হরেক পেশার সভাসদরা পালিয়ে ভারতে নিশ্চিত আশ্রয় গ্রহণ করে, এখনও করে চলেছে। ওদিকে, শেখ হাসিনার মার্কিন প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতীয় দৈনিক ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’ স্বাক্ষাৎকার দিয়ে গত আগস্ট ১৪ বাংলাদেশে ৯০ দিনের ভেতর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও আওয়ামী লীগকে পুনঃসংগঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। এমতাবস্থায়, ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের ‘বিশেষ কৃতজ্ঞতা’ পোষণ করা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি হাসিনার  খুনি ও লুটেরা চক্রের বিচার-প্রত্যাশী বাংলাদেশের গণতন্ত্রপরাপয়ণ জনগোষ্ঠীর দিক থেকে, ভারতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাও অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশের তরফে ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগ শিবিরের এই ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘প্রায়োগিক-রাজনৈতিক’ কৃতজ্ঞতার সম্ভাব্য পরিণাম কী?

নূরুল কবীর: ভারতের প্রতি লীগের একতরফা সর্বাত্মক কৃতজ্ঞতার পরিণামটি ক্ষমতাচ্যুত লীগ-সরকারেরই প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন কর্তৃক, ২০২০ সালের মে মাসে প্রদত্ত একটি প্রকাশ্য স্বীকারোক্তির মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছিল। মোমেন বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের’ মতো। আমাদের উপমহাদেশে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর ভেতর ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’, সাধারণভাবে, একটি অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে স্ত্রীর আশা-আকাক্সক্ষা হামেশাই মার খায়। ফলে, বাংলাদেশের বৃহৎ ও বলবান প্রতিবেশী ভারতকে ‘স্বামী’র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলে, অপেক্ষাকৃত ছোট ও দুর্বল বাংলাদেশকে ‘স্ত্রী’র অধঃস্তন মর্যাদা কবুল করেই পাশাপাশি বসবাস করতে হবে। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বিবেচনা করলে, এই অবস্থানটিতো দু’টি ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশিত রাষ্ট্রের অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের চিত্রকেই স্পষ্ট করে তোলে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন চিন্তাশীল নাগরিকদের কাছে এই অবস্থাটি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া, আধুনিক বিশ্বে, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, পাশাপাশি দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতর সমমর্যাদা-ভিত্তিক সৎ-প্রতিবেশীমূলক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাই বাঞ্ছনীয়। এ নিয়মের বিপরীতে, ভারতের প্রতি লীগের, অথবা অন্য যে-কোন রাজনৈতিক দলের, এক তরফা প্রায়োগিক-রাজনৈতিক কৃতজ্ঞতা নিশ্চয় বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বার্থের’ প্রতিকূল ‘পরিণাম’ উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে বাধ্য।

আধুনিক জমানায় কোনো দেশে যখন পর্যাপ্ত জনসমর্থন-বিবর্জিত কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন থাকে, সেই সরকারকে টিকে থাকার জন্য একদিকে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, যেমন জনবিচ্ছিন্ন ও সুবিধাবাদী আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রের নানা অস্ত্রশালী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, তেমনি এক বা একাধিক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় তার পররাষ্ট্রনীতি চর্চা করতে হয় – যা, শেষ বিচারে, সে দেশটির জনস্বার্থ-পরিপন্থী পরিণাম বয়ে আনতে বাধ্য।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগকে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, সামরিক-বেসামরিক আমলতন্ত্র, নানা নিরাপত্তা বাহিনীভুক্ত গোয়েন্দা সংস্থা ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের একটি স্থূল স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সক্রিয় সমর্থন আদায় করতে হয়েছিল, আর তার মূল্য হিসেবে লীগ সরকারকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, সংস্থা ও গোষ্ঠীদের ভেতর নানা অন্যায্য সুবিধা বিতরণ করা ছাড়াও, রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় নিয়মিত তাঁদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কবুল করতে হত এবং এ প্রক্রিয়ায় স্বভাবতই রাজনীতিতে রাজনীতিকদের প্রাধান্য তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে খর্ব হয়েছে।

অন্যদিকে, কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের, লীগের ক্ষেত্রে ভারতের, ভুয়া সনদের ভিত্তিতে যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘নির্বাচিত সরকার’ হিসেবে নিজের স্বীকৃতি অন্বেষণ করতে হয়, তখন জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ‘সুবিধা’ দিয়েই সনদ দানকারী রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে হয় – যা সদ্য ক্ষমতাচ্যুত লীগ-সরকার কর্তৃক ভারতের সাথে সম্পাদিত অনেকগুলো অসম চুক্তির ভেতর নিহিত রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত লীগ-সরকার ভারতকে বাংলাদেশে ওপর দিয়ে ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য, প্রায় বিনামূল্যে ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে স্থল, নৌ ও রেইল ট্রান্সশিপমেন্ট/ট্রানজিট সুবিধা দান করেছে, বঙ্গপোসাগর অঞ্চলে ভারতীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের একাধিক নৌবন্দরসহ অভ্যন্তরীণ নদীপথ ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় পণ্যোৎপাদন ও বিপণনের সুবিধার জন্য একাধিক ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। তাছাড়া, লীগ-সরকার ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, জ্বালানি, এমনকি গণমাধ্যমসংক্রান্ত কতকগুলি তথাকথিত ‘পারস্পরিক সহযোগিতামূলক’ চুক্তি সম্পাদন করেছে – যা শেষ বিচারে ভারতকেই অনেক বেশি লাভবান করবে, ইতিমধ্যেই করে চলেছে। লক্ষ করুন, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে আইনিভাবে ভারত বাংলাদেশে ৩৭,৮৬৮ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য রফতানি করেছিল। আর তার পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে ভারতসমর্থিত একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে, বাংলাদেশে ভারতের পণ্যবাজার বিপুল পরিমাণে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ইতিমধ্যে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত আরো একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে লীগ অব্যাহতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং ১০ বছরের মাথায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে, বাংলাদেশে আইনিভাবে, শুধু সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতের পণ্য রফতানির পরিমাণ দাড়িয়েছিল ৯৪,০৩৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও ভারতের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সবাই অবগত যে, বরাবরই আরো প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ভারতীয় পণ্য প্রতিবছর অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। স্পষ্টতই, লীগ শাসনামলের শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বাজার তিনগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। শেখ হাসিনা ঠিকই বলেছিলেন, ২০১৮ সালের ৩০ মে, “আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে।”

অন্যদিকে, এই সব অভূতপূর্ব দানের বিপরীতে, ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশ রোধ করার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অসঙ্গত পরিমাণ ট্যারিফ নির্ধারণ ছাড়াও, নানা ট্যারিফ-বহির্ভূত প্রতিবন্ধকতা জারি রাখে। বিভিন্ন বাংলাদেশী পণ্য যেমন ব্যাটারি, পাট ও পাটজাত পণ্য, গ্লাস ইত্যাদির ওপর ‘এন্টি-ডাম্পিং ডিউটি’ আরোপ ভারতীয় বৈরিতার কিছু অতিচেনা উদাহরণ। ভারতের প্রতি ক্ষমতাচ্যুত লীগ-সরকারের পূর্বোল্লোখিত দ্বিমাত্রিক ‘কৃতজ্ঞতার’ কারণে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বাধীন ও সাবলীল বিকাশের পরিপন্থী ভারতীয় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, স্বভাবতই, বাংলাদেশ পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রতিবাদ জানাতে ও প্রতিকার আদায়ে অসমর্থ হয়ে পড়েছিল। হাসিনা-সরকারের পতনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ড. মুহম্মদ ইউনুসের সরকারের যাত্রার শুরুতেই, ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ খানিকটা ঋজু দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে শুরু করেছে।

ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শৃংখল থেকে বাংলাদেশের মুক্তির পথ কী?

নূরুল কবীর: কোনো দেশে ইতিহাসবোধ-সম্পন্ন যথার্থ দেশপ্রেমিক ও সাহসী রাজনীতিকদের নেতৃত্বে যথাযথ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গড়ে ওঠা প্রকৃতই জনস্বার্থপরায়ণ এক বা একাধিক রাজনৈতিক শক্তির প্রবল উত্থান ও সক্রিয় উপস্থিতিই সে দেশের তরফে কোনো আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শোষণ-নিপীড়নমূলক আচরণ থেকে মুক্ত থাকার প্রধান পথ। ভারতের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্পের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্যও ভিন্ন কোনো পথ নেই।

দ্বিতীয়ত, ভারতের অপরাপর দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহে সক্রিয় দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ‘শক্তিসমূহের’ সাথে গণতান্ত্রিক সংহতি গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ভারত শুধু বাংলাদেশের প্রতিই স্বার্থান্ধ বৈরী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না, দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর ‘ছোট’ প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের প্রতিও অভিন্ন আচরণ করে থাকে। ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় শাসকশ্রেণির সহজাত পররাষ্ট্রনীতির ভেতরেই বহুযুগ ধরে নিহিত রয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে, স্বাধীন ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির একটি মূলমন্ত্র আহরণ করেছিল ২৫০০ বছরেরও বেশি পূর্বের ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতি তাঁর প্রিয়-সভাসদ চানক্যের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০-খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩) দেয়া উপদেশ থেকে: “আপনার প্রতিবেশী আপনার শত্রু, আপনার প্রতিবেশীর প্রতিবেশী আপনার বন্ধু।” চানক্যের এই প্রাচীন পররাষ্ট্রনীতি-তত্ত্বের প্রতি ভারতীয় শাসকশ্রেণির এতই ভক্তি যে, আধুনিক ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থাপনাটির নাম রাখা হয়েছে ‘চানক্যপুরী’। স্বভাবতই, বাংলাদেশ ছাড়াও, ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিটি ‘ছোট’ দেশই ভারতীয় চানক্যনীতির অন্যায্য শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই চিন্তাশীল দেশপ্রেমিক নাগরিকদের মধ্যে নিজ নিজ দেশের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ভারত-নীতির সোচ্চার সমালোচনা কর্ণগোচর হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের রাজধানী শহরে বসবাসরত সেদেশের দেশপ্রেমিক বিদ্বৎজনদের চোখেই ‘India is a big country, not a great one’; তাঁরা মনে করেন, ‘ভারত একটি ক্ষুদ্র হৃদয়সম্পন্ন বৃহৎ দেশ’ – যে নিজের স্বার্থে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে একতরফাভাবে নিতেই জানে, কিন্তু প্রতিবেশীদের ন্যায্য প্রতিদান দেয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের জনগণের একটি বিরাট অংশ ‘ভারত-খেদাও আন্দোলনে’ ইতিমধ্যেই প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে, আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার মালদ্বীপের জলসীমায় মোতায়েন করা ভারতীয় সৈন্যদের একটি বহর এ বছরের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া, শ্রীলংকায় নতুন করে অভিন্ন শ্লোগানের অধীনে স্বদেশে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ভারতীয় শাসকশ্রেণির ভেতর বোধদয়ের কোনো লক্ষণ নেই। ভারতীয় সীমান্তবর্তী নেপালের ‘অভ্যন্তরে’ কিছু এলাকার ওপর ভারতীয় দাবির বিরুদ্ধে নেপালি সরকারের প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণের প্রেক্ষাপটে, নেপালে প্রতিষ্ঠিত ‘গণতান্ত্রিক রিপাবলিক’ বাতিল করে ‘রাজতন্ত্র   ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হিসেবে নেপালকে পুনর্গঠিত করার দাবিতে, গত বছরের নভেম্বর থেকে, কাঠমণ্ডুতে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নেপালের গণতন্ত্রপরায়ন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এই ডানপন্থী পশ্চাদগামী সংগ্রামের ভেতর দিল্লীর গোপন ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন।

নিজের বিপুল ভৌগোলিক আয়তন, বিশাল জনগোষ্ঠী আর বৃহত্তর অর্থনীতির গুণে ভারত, স্বাভাবিকভাবেই, দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নাতীত নেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারতো; কিন্তু একদিকে চানক্য নীতির আলোকে সকল প্রতিবেশীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের জন্য, অন্যদিকে শত্রুবিবেচিত প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে নানা উপায়ে অন্যায্য সুবিধা আদায়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বভাবের কারণে, ভারতের পক্ষে তা হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ভারতের এই সহজাত স্বভাব সহসা বদলানোর সম্ভাবনাও নেই। ওদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় রাজনীতিতে বর্ণবাদক্লিষ্ট হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবল উত্থানের কারণে ভারতীয় জনগণের গণতন্ত্রপরায়ণ অংশও ভীষণ কোনঠাসা হয়ে পড়েছে।

এমতাবস্থায়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় শাসকশ্রেণীর আধিপত্যবাদী অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত নীতিমালার শিকার অপরাপর দেশগুলোর গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সাথে সংহতি গড়ে তোলার পাশাপাশি, ভারতের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রপরায়ণ সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি সমূহের ভেতরও মিত্র অন্বেষণ চালিয়ে যেতে হবে।

ভারতের প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের গণতন্ত্রপরায়ণ অংশের সাথে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায়সংগত উদ্বেগসমূহ তুলে ধরা জরুরি। কিন্তু এসব আলোচনার মাধ্যমে খুব দ্রুত কোনো সুফল আশা করা, অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থান্ধ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীগণ সহসাই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থের তরফে তৎপর হয়ে উঠবেন – এমন আশা পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, আমরা লক্ষ করেছি যে, ভারতের নানা অঞ্চলে বহু নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর ওপর কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারপন্থী জনগণ এবং উত্তর পূর্ব ভারতের স্বশাসন/স্বাধীনতাপন্থী নানা জাতি-গোষ্ঠী ছাড়াও বৃহত্তর দলিত জনগোষ্ঠী ভারত রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের বিরুদ্ধে এমনকি বাম ‘প্রগতিশীল’ বলে খ্যাত অনেক বুদ্ধিজীবীও কার্যকর প্রতিবাদ জ্ঞাপন করতে হামেশাই কুণ্ঠিত বোধ করেন। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী অপর দেশগুলির জনসাধারণের প্রতি দিল্লীর অন্যায্য বৈরিতার বিরুদ্ধে তাঁদের কাছ থেকে রাতারাতি কোনো কার্যকর তৎপরতা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। তথাপি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত রাষ্ট্রের অন্যায় আচরণের প্রতি ‘প্রগিতিশীল’ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশপ্রেমিক বর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।

তাছাড়াও, বহির্বিশ্ব জুড়ে ভারত যে সকল শক্তিমান ও প্রভাবশালী দেশগুলোর ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল, সেসব দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সামনে আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারতের আধিপত্যবাদী তৎপরতার স্বরূপ উন্মোচন করা এবং তার মাধ্যমে ভারতের ওপর গণতান্ত্রিক আচরণের জন্য চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মিত্র সমাবেশ ঘটানো গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে কোনো দেশের, বিশেষত আপাতদুর্বল কোনো দেশের, গণতন্ত্র ও শোষণ-মুক্তির সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার জন্য সংগ্রামী শক্তিকে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন শোষণ-নিপীড়নমূলক অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে নিজ ভূখণ্ডে লড়াই করলেই চলে না, তার বিদেশি মিত্র সরকারসমূহের বিরুদ্ধে সেইসব দেশের গণতন্ত্রপরায়ণ শক্তিসমূহের লড়াকু মিত্রতাও অর্জন করতে হয়। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার মাটিতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই সংগঠিত করা যেমন অত্যাবশ্যকীয় ছিল, বাংলার রণক্ষেত্রের বাইরে অপরাধী পাকিস্তান ও তার সমর্থনকারী বিদেশি সরকারগুলোর বিরুদ্ধে সেসব দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসূহের মিত্রসমাবেশ ঘটানোও অপরিহার্য ছিল। স্পষ্টতই, বাংলাদেশের স্বাধীন উত্থানে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত লড়াইয়ের পাশাপাশি, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি বিশ্বব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি গণতন্ত্রপরায়ণ শক্তিসূহের সক্রিয় সহানুভূতিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

তাহলে দাঁড়াল এই যে, আপন দেশে যথার্থ গণতন্ত্রপরায়ন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের চানক্য নীতির শিকার ছোট ছোট দেশগুলোর সংক্ষুব্ধ গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সঙ্গে সংহতি স্থাপন, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে অপরাপর প্রভাবশালী দেশের গণতান্ত্রিক সংগঠন ও সংস্থাসমূহের বন্ধুত্ব অর্জন ও তাঁদের সামনে এ অঞ্চলে ভারতের কদর্য পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি, ইত্যাদির সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে তার স্বাধীন পথ চলার রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।

ভারতীয় শাসকশ্রেণির আধিপত্যবাদী তৎপরতা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সর্বভারতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের মিত্র অন্বেষণে ভারতের পশ্চিম বাংলার বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কি বিশেষভাবে কোনো অবদান রাখতে পারে?

নূরুল কবীর: সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কারণে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ বর্ণভুক্ত ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের ভেতর মিত্র অন্বেষণ-প্রয়াস সহসা কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। কেননা, কলকাতাকেন্দ্রিক এই বিশেষ ‘বাবু’ সম্প্রদায় বিকশিত হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের গর্ভে, ঔপনিবেশিক শাসকদের দালালি করে, আর পুষ্টি লাভ করেছিল ব্রিটিশ-প্রবর্তিত শোষণ-নিপীড়নমূলক জমিদারী ব্যবস্থার নির্মম শিকার পূর্ব বাংলার ব্রিটিশবিরোধী দরিদ্র কৃষক সমাজের হাড়-মাংস নিংড়ানো শ্রমের সঞ্জিবনী জারক রসের উষ্ণতায় ও পরবর্তীকালে কংগ্রেসী রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় তার বিকাশ নিষ্পন্ন হয়েছিল। এই নিপীড়ক জমিদার সম্প্রদায় পূর্ববাংলা থেকে বলপূর্বক আহরিত খাজনার টাকা দিয়েই কলকাতায় বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করে নির্লজ্জ বিলাসী জীবন যাপন করেছে। ফলে, ইতিহাসের অন্য এক বিশেষ পর্বে, ১৯০৫ সালে, ব্রিটিশ প্রশাসন যখন পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে, পূর্বের সঙ্গে আসাম জুড়ে দিয়ে, নতুন বঙ্গাসাম প্রদেশ তৈরি করেছিল, তখন পশ্চিম বাংলার এই উচ্চবর্ণ ‘বাবু’ সম্প্রদায় বাংলা-বিভাজনকে ‘মাতার অঙ্গচ্ছেদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দীর্ঘ ছয় বছরব্যাপী নিরন্তর লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে, ১৯১১ সালে, বঙ্গভঙ্গ রোধ করেছিল। বঙ্গভঙ্গ রোধের ভেতর দিয়ে আসলে তারা নিজেদের পূর্ববঙ্গকেন্দ্রিক অনায়াস আয়-রোজগারের ব্যবস্থাকে নিরুপদ্রব রেখেছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ‘ধর্মের ভিত্তিতে’ ভারত বিভাজনের প্রাক্কালে, আবুল হাশিম-শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে সমন্বিত বাংলাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার রাজনৈতিক প্রকল্প উত্থাপিত হলে, এই ‘বাবু’ সম্প্রদায় নতুন করে বঙ্গ-বিভাজনের জন্য ধনুর্ভাঙ্গা পণ নিয়ে তা রুখে দিয়েছিল। কেননা, ততদিনে সারা বাংলায় নির্যাতিত মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে যাওয়ার ফলে শোষণ-নিপীড়নমূলক জমিদারি-ব্যবস্থা-জাত এই ‘বাবু’ সম্প্রদায় যুক্তবঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের সম্ভাবনায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। যখন নিজেরাই ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি-চর্চায় অভ্যস্থ, তথাকথিত ‘বঙ্গীয় রেঁনেসা’র সৃষ্টি এই ‘বাবু’ সম্প্রদায় প্রস্তাবিত যুক্তবঙ্গের রাজনৈতিক প্রকল্পকে ব্যর্থ করে দেয়। এমতাবস্থায়, পরবর্তিকালে, ১৯৪৬ সালে, পূর্ব বাংলার তৎকালীন নিপীড়িত কৃষক সমাজ মুসলিম লীগ কর্তৃক জমিদারী ব্যবস্থা বিলোপের অগ্রীম আশ্বাসে প্রেক্ষাপটে, লীগের পাকিস্তান প্রকল্পকে ভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে দেয়। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার মানুষ, অব্যাহত সংগ্রামের মাধ্যমে, ১৯৫০ সালে, জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে ‘আখেরে অনিচ্ছুক’ মুসলিম লীগকে বাধ্য করে।

কিন্তু ১৯৭১ সালে, পূর্ববাংলার মানুষ যখন পাকিস্তানি শাসন-নিপীড়নের শৃংখল ভেঙ্গে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, পশ্চিম বাংলার পুরনো ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের উত্তরসূরিদের একটি বিরাট অংশ তখন সেই স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন যোগায় – সম্ভবত এই আশায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরা তাঁদের পূর্বসূরিদের জমিদারি ফিরে পাবে, কিংবা তা না পেলেও, অন্তত জমিদারি ভাবাপন্ন স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগটা ফিরে পাবে। ইতিহাসবোধ-বিবর্জিত এই অতি উৎসাহী ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের হিসেব-নিকেশের মধ্যে একটি অপরিণামদর্শী ভুল ছিল, তারা বুঝতে পারেনি যে – বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ বহু পূর্বেই জমিদারি ব্যবস্থা উৎখাত করেছে, ফলে ‘প্রজা’র হীন মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি, বরং একটা আধুনিক ‘গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের’ ভেতর মুক্ত নাগরিকের সম্মানজনক মর্যাদা লাভই ছিল তাঁদের অনিষ্ট। কলকাতার এই বাবুরা আরো বুঝতে পারেননি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রধানত ঢাকা-দিল্লীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে ভারতের একটি প্রান্তিক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখার অবকাশ চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হয়ে যাবে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের পর, ধীরে ধীরে, কলকাতার ‘বাবু’ সম্প্রদায়ভুক্ত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীগণ যতই এ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে থাকেন, তাঁদের ভেতর ততই একটা হীনমন্যভাব জাগ্রত হতে থাকে, বাংলাদেশের প্রতি তাদের রাগ ও বিদ্বেষ ততই বাড়তে থাকে, যা এখনও অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। ফলে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সংগ্রামে, কিংবা ভারতীয় শাসকশ্রেণির আধিপত্যবাদী ও বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায়, প্রাক্তন জমিদারি ব্যবস্থার সুবিধাভোগী ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের কলকাতা-ভিত্তিক উত্তরসূরি রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা লাভের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

আমি ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক ‘যশোর আমাদের’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। আহমদ ছফা ১৯৭৩ এর আগস্টে প্রকাশিত তার পূর্বোল্লেখিত নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, এই পত্রিকাটিই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ‘রাজ্যপাল’ হিসেবে অভিহিত করেছিল, আর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এই বলে সমালোচনা করেছিল যে, তিনি ‘বাংলাদেশ রাজ্যটির প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে উঠেছেন’। ছফা আরো খেয়াল করেছিলেন যে, একই বছরে আনন্দবাজার গ্রুপের সাপ্তাহিক ‘দেশ-কেন্দ্রিক এক [পশ্চিম বঙ্গীয়] বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশকে ভারতের ‘উপ-দেশ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং কলকাতা-কেন্দ্রিক ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজার সে বছরের এপ্রিলে মুদ্রিত একটি নিবন্ধে, ‘বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থেই স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব ও জাতীয় একগুয়ে বোধ পরিহার করে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়া উচিৎ’, বলে উপদেশ বর্ষণ করেছিল।

এমতাবস্থায়, ভারতের বিশিষ্ট বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অশোক মিত্র লক্ষ করেছিলেন যে, একশ্রেণির পশ্চিমবঙ্গবাসী, যারা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের প্রেক্ষাপটে পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় চলে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ‘তাদের অনেকের মানসিকতা এমন দাঁড়াল, যেন জমিদারি ফিরে পেয়েছেন’।

কেউ কেউ বলতে পারেন, এ সমস্ত কথাই তো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরের ঘটনা, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-ভাবনার নিশ্চয় পরিবর্তন হয়েছে। আমি বলব – না, এখনও পশ্চিম বঙ্গের বিশেষত ‘বাবু’ সম্প্রদায়ভুক্ত জমিদার শ্রেণির উত্তরসূরি এক শ্রেণির রাজনৈতিক-বুদ্ধিজীবী স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ফলাফল উপলব্ধি করতে পারেননি। এই সেদিনও, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি, দিলীপ ঘোষ, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, তাঁরই ‘সম্মানে’ কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক প্রকাশ্য সভায়, বাংলাদেশের ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার শাসকশ্রেণির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ, এখনও, স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশকে, ভারতের অধিভুক্ত একটি ‘রাজ্য’ হিসেবে ভাবতেই আরাম বোধ করে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের জসস্বার্থপরায়ন গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রতি ভারতীয়, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বাবু সম্প্রদায়ের, বৈরীতা পোষণ করা একটি মজ্জাগত অসুস্থাতায় পরিণত হয়েছে। লক্ষ করুন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দেড়-দশক ব্যাপী স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ ছাত্র-জনতা তাঁর পদত্যাগ দাবি করলে, তিনি রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক সশস্ত্র সংগঠনগুলিকে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন এবং দেড় হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেন। হাসিনার এই হত্যাকাণ্ডে দেশের সকল স্তরের প্রায় সকল ভাবাদর্শী মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদী সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলে, লীগ-সরকারের বিরুদ্ধে এক বিস্ময়কর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় এবং একদা দাম্ভিক হাসিনা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে, তারই নিয়োগকৃত কয়েকজন সেনাপতির সক্রিয় সহযোগিতায়, দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আতিথ্য গ্রহণ করেন।

ভারতীয় অতিথি হিসেবে অবস্থান করে, ভারতীয় শাসকশ্রেণীর সহযোগিতায়, দিল্লী থেকে হাসিনা বাংলাদেশে ফেলে যাওয়া তাঁর দীর্ঘদিনের কুকর্মের সহযোগী সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, দলীয় সন্ত্রাসী ও লুটেরা নেতা-কর্মী, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও দালাল বুদ্ধিজীবী, প্রমুখের সাহায্যে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য সক্রিয় তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। অন্যদিকে, হাসিনার এই দেশদ্রোহী তৎপরতাকে জোড়দার করার জন্য, ভারতীয় গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে, ভারতীয় শাসকশ্রেনির কলকাতা-ভিত্তিক বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্রপরায়ন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে নানাবিধ কুৎসা রটনায় নিজেদের নিরন্তর নিয়োজিত রেখেছে।

তারপরও আমি বলব, পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ভেতর যাঁরা ইতিহাসের নির্মোহ পর্যালোচনায় আগ্রহী, ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবল বর্ণবাদী উত্থান রোধে তৎপর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাঁদের সাথে কার্যকর গণতান্ত্রিক সংহতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে চীনের প্রভাবও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, লীগ-সরকারের সাথেও চীনের ব্যাপক দহরম মহরম ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতিতে চীনের এই বিকাশমান প্রভাবের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ফলাফল কী বলে মনে করেন?

নূরুল কবীর: চীন এখন প্রশ্নাতীতভাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্র, যদিও পাওয়ার পারচেজ প্যারিটি (পিপিপি)’র মানদণ্ডে, এমনকি পশ্চিম-প্রভাবিত আইএমএফ এর হিসেব অনুসারে, চীনের জিডিপি’র আকার ২০১৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৪ সালে পিপিপি’র মানদণ্ডে চীনের জিডিপি ছিল ১৭.৬ ট্রিলিয়ন ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি’র আকার তখন ১৭.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। চীনের এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তার বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত ও সামরিক শক্তিরও ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে, আর তার সহজাত পরিণতি হিসেবে সারা পৃথিবীতে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাববলয়ও ব্যাপক পরিমাণে সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে, জগৎজুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, তা জারি রাখা ও সম্প্রসারণের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাম্প্রতিককালে তীব্র রূপ পরিগ্রহ করেছে – যা পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে তীব্রতর হয়েছে, জন্ম দিয়েছে এক নতুন ধরনের কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা।

এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত বঙ্গোপসাগরসহ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে রোধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চীনের সীমান্তবর্তী বৃহদাকারের উন্নয়নশীল দেশ ভারতকে মিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, চীনের বিরুদ্ধে ভারতের বন্ধুত্বের বিনিময়ে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর ভারতীয় একক রাজনৈতিক ‘ইজারাদারি’ কবুল করেছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের শক্তিতে বলিয়ান ভারত, আপন আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বশবর্তী থেকে, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক ছড়ি ঘোরানোর মাত্রা বৃদ্ধি করেছে – যা এই সব উন্নয়নশীল দেশের আত্মমর্যাদাবান জনগোষ্ঠীসমূহের মন ও মননে ভারত সম্পর্কে ব্যাপক বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণার সঞ্চার করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের দিক থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব জারি রাখার বেপরোয়া আকাক্সক্ষা থাকলেও, এই দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার স্বভাব ও সামর্থ্য ভারতের নেই। এমতাবস্থায়, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিমান চীন দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোতে আর্থিক সহায়তা, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমশই তার প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে। ওদিকে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তার ও জারি রাখার জন্য মার্কিন-ভারত আঁতাতের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলোর সাথে নানা পরিসরে মিত্রতার বিকাশ সাধন ছাড়া চীনের পথ নেই।

বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীন ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ হিসেবে প্রচুর টাকা ঋণ দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ-বিদেশের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে, চীন ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের’ আকারে বাংলাদেশকে ১.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। চীন একই অর্থবছরে বাংলাদেশে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করেছে। তাছাড়া, লীগ-সরকারের আমলে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে ২২.৯৪ বিলিয়ন ডলারের ‘নির্মাণ চুক্তি’ লাভ করেছে। তদুপরি, বাংলাদেশে চীনের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ এখন ৭.০৭ বিলিয়ন ডলার।

স্পষ্টতই, বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চীনের প্রভাব বেড়ে চলেছে, আর সেই পথ ধরে বাড়ছে তার রাজনৈতিক প্রভাবও। উল্লেখ্য, ক্ষমতাচ্যুত লীগ-সরকারের নিয়ন্ত্রিত বিগত তিনটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়াস ও প্রক্রিয়াকে, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পুরোপুরি পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও, চীন বরাবরই সমর্থন জুগিয়েছে। শুধু তাই নয়, চীন-সরকারের আন্তর্জাতিক মুখপত্র ‘গ্লোবাল টাইমস’, ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারিতে মুদ্রিত এক নিবন্ধে, ‘উন্নয়নের জন্য বহুদলীয় পার্লামেন্টারি পদ্ধতির নেতিবাচক প্রভাবের’ কথা উল্লেখ করে, ‘শক্তিমান সরকার, কার্যকর শাসন ব্যবস্থাপনা ও স্থিতিশীল নীতিমালা’র ওপর গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে, প্রকারান্তরে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে চীনের মতো একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছিল। লীগ অবশ্য, সাংবিধানিকভাবে না হলেও, প্রায়োগিক রাজনীতির প্রশ্নে কার্যত একদলীয় শাসনব্যবস্থাই কায়েম করতে সমর্থ হয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্রপরায়ণ মানুষের সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমেই এই ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে।

বাংলাদেশে লীগের অধুনালুপ্ত একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমে ভারতের অবদানের কথাও সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা। সেক্ষেত্রে, রাজনীতির প্রশ্নে এখানে চীনের অভিন্ন তৎপরতায় ভারতের অন্তত অখুশি হওয়ার তেমন কারণ ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শক্তিধর চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে, দুর্বল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিসম্পন্ন ভারতের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ফলে, চীন ও ভারতের সঙ্গে বিগত লীগ-সরকারের সম্পর্কের ধরন বাংলাদেশের জন্য দু’টি ভিন্ন রকমের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

একদিকে ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বিতৃষ্ণা, অন্যদিকে আপন আপন দেশের উন্নয়ন-তৃষ্ণা, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে বিত্তবান চীনের অতিরিক্ত পুঁজি প্রবাহের দিকে ঠেলে দিয়েছে। চীনের ঋণ ও উন্নয়ন-সহযোগিতায় এ অঞ্চলের কোনো কোনো দেশ উপকৃত হয়েছে বটে, কিন্তু কেউ কেউ আবার ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়ে বিপদগ্রস্থও হয়েছে – তাঁদের জাতীয় স্বার্থে স্বাধীনভাবে উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের অত্যাবশ্যকীয় স্বাধীনতা কিছুটা খর্বিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ঝুঁকি উড়িয়ে দেয়া যায় না।

আবার, চীনের সাথে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত বাংলাদেশের ওপর আপন প্রভাব ও আধিপত্য জারি রাখার জন্য আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারত ও চীনের ভেতর কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরো তীব্র রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য আখেরে ক্ষতিকর প্রমাণীত হতে পারে।

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন-ভারত কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তিস্তা নদীর উজানে ভারত-সরকার সিকিম ও পশ্চিম বঙ্গের নানা জায়গায় প্রায় ১৫টি বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ ও উত্তোলনের কারণে, বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বহু বছর ধরে বঞ্চিত রয়েছে। বহু বছর ধরে, বহু দ্বিপাক্ষিক বৈঠক আর আলাপ-আলোচনা শেষে, ২০১০ সালে, উভয় দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টনের জন্য একটি চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়। খসড়া চুক্তি অনুযায়ী, তিস্তার প্রবাহের ৪০ শতাংশ ভারত, ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ এবং বাকি ২০ শতাংশ নদীটির নাব্যতা বা প্রাণবান অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা।

কিন্তু খসড়া প্রণয়নের ১৪ বছরের মধ্যেও ভারত চুক্তিটি স্বাক্ষর করেনি। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের দিক থেকে তিস্তার তীরবর্তী মানুষ, কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখার জন্য বর্ষার প্রাকৃতিক জলধারা সংরক্ষণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে, চীন সেই প্রকল্পে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দানের আগ্রহ প্রকাশ করে, কিন্তু ভারত তাতে নারাজ। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন উপলক্ষে চীন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এবং তা ভারতের কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী -এই অজুহাতে ভারত-সরকার তিস্তা-প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে বাধা দিচ্ছে। তবে, তিস্তাচুক্তি সম্পাদনে ভারতের অনীহার মুখে বাংলাদেশের তরফে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই জেনে, ভারত সম্প্রতি, এ বছরের ৯ মে, নিজেই বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশগ্রহণের প্রস্তাব হাজির করেছে। রীতিমতো হাস্যকর নয় কি? বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্পর্কিত হওয়ার মধ্যে ভারত যদি সত্যি কোনো ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ খুঁজে পায়, তবে খসড়া-চুক্তিভিত্তিক তিস্তার পানি-বণ্টনের সমস্যা সমাধান করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সেটা না করে, চীনের সাহায্যে বাংলাদেশ যাতে নিজের সমস্যা সমাধান করতে না পারে, ভারত বরং তার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে।

ইতিমধ্যে, এ বছরের ২১-২২ জুন ভারত সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পর ২৫ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তিনি চীন ও ভারতের দুটি প্রস্তাবই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন। কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে মত প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘তিস্তা প্রকল্প ভারতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলেই সব সমস্যার সমাধান’ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের তরফে এটা ছিল একটি বিপজ্জনক অনুমান। কেননা, নানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, চীনের উপস্থাপিত প্রকল্প অনুযায়ী, প্রকল্পভুক্ত ১১০ কিলোমিটার এলাকায় নদী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ, ভূমি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন, পরিবহন ও নৌ চলাচল, প্রকল্প এলাকায় সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব প্রশমন এবং স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি বাস্তবায়ন করার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে। ওদিকে, ভারতের দিক থেকে তার পররাষ্ট্র সচিব, বিনয় মোহন কোয়াত্রা, ২২ জুন জানিয়েছেন, “আমরা বাংলাদেশের ভেতরে সুবিধামতো ঋণে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আমলে নিয়েছি।” খুবই বিমূর্ত প্রস্তাব। সর্বোপরী, ভারতের সৃষ্ট তিস্তা-সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশের ভেতর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমরা ভারতকে দেব কেন? এতো ‘শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার’ মতো নির্বুদ্ধিতা।

তাছাড়াও, চীন বাংলাদেশকে যে সর্বাঙ্গীন প্রস্তাব দিয়েছে -বিদেশে ঐ রকম একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কারিগরি ও আর্থিক, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিগত সামর্থ্য ভারতের আছে কি-না, তাও প্রশ্নাতীত নয়। একটি উদাহরণ দেয়া যাক: ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভারতীয় ঋণে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের জন্য দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, চুক্তি অনুযায়ী এ বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বিগত ৬ বছরে এই প্রকল্পটির মাত্র ১০.৫ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। ইতিমধ্যে, বাংলাদেশের তরফ থেকে বারবার যোগাযোগ করলেও ভারতের এক্সিম ব্যাংক চুক্তি অনুযায়ী ঋণের অর্থ ছাড় করেনি বা ছাড় করতে পারেনি। এহেন ভারতের সহায়তায় তিস্তা প্রকল্পের মতো ভারত-সৃষ্ট সমস্যার সমাধান খোঁজা নিশ্চয় দেশপ্রেমিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক কাজ হতে পারে না।

স্পষ্টতই, বাংলাদেশ তার নিজ ভূখণ্ডে নিজস্ব সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে ভারত ও চীনের সম্পর্কের টানাপড়েনের শিকারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থাটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার সাথে সঙ্গতিপরায়ণ নয়।

ভারতবাংলাদেশের ভেতর গত ২২ জুনে অনুষ্ঠিত শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চালের রাজ্যগুলোতে সরাসরি ট্রেন চলাচলের অনুমোদন দিয়ে একটি ‘সমঝোতা স্মারক’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের সাথে এই ‘সমঝোতা’ কি চীনের সাথে বাংলাদেশের বিকাশমান সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে?

নূরুল কবীর: আগেই বলেছি, যথার্থ অর্থে নির্বাচিত নয় – এমন কোনো সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তাকে, একদিকে, দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতাবলম্বী স্বাধীন বুদ্ধিজীবীতাকে যেমন রাষ্ট্রীয় নানা সংগঠনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে অবদমিত রাখতে হয়, অন্যদিকে, ‘নির্বাচিত সরকার’ হিসেবে কোনো কোনো শক্তিমান ও প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্রের ভূয়া সনদ যোগাড় করে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। একটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার লীগ-সরকার ইতিপূর্বে চীন ও ভারতের কাছ থেকে এই ‘সনদ’ সংগ্রহ করেছিল এবং তার বিনিময়ে দু’টি দেশকেই নানা অন্যায্য সুবিধা প্রদান করেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের একাংশ থেকে অপরাংশে সরাসরি ট্রেন চলাচলের অনুমোদন দান ভারতকে দেয়া লীগ-সরকারের এমন আরেকটি অন্যায্য সুবিধা প্রদান ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু ভারতকে প্রদত্ত এই বিশেষ সুবিধাটি বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে একটি বিপজ্জনক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ২৫ জুনের সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, এই রেল যোগাযোগ ভারত ও বাংলাদেশের উভয় জনগণের জন্য লাভজনক হবে। এই দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কেননা, উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সমঝোতা’ অনুযায়ী, ভারতীয় ট্রেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে শুধু ভারতীয় যাত্রী ও পণ্য সামগ্রী নিয়ে ভারতের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চলাচল করবে। বাংলাদেশের মানুষের এই ট্রেন ব্যবহার করার সুযোগ নেই। ওদিকে, ভারতকে এহেন একতরফা সুবিধা দানের ওপর ন্যায্যতা আরোপের জন্য তিনি যে ইওরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের ভেতর নাগরিকদের অবাধ চলাচলের উদাহরণ দিয়েছেন, তা বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কেননা, ভারত শুধু বাংলাদেশকে ঘিরে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াই স্থাপন করেনি, সীমান্ত অঞ্চলে প্রতিনিয়ত নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যাই করে না, বাংলাদেশী কিশোরীকে খুন করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখার অশ্লীল নজিরও স্থাপন করেছে। তাছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির একজন সাধারণ পর্যবেক্ষকও জানেন যে, এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর ভেতর পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাবে সালে গঠিত ‘সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়শন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন’ (সার্ক), প্রধানত, ভারতীয় অসহযোগিতার কারণেই নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। ভারত এই অঞ্চলের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর ভেতর সম-সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো সহযোগিতামূলক সম্পর্কে বিশ্বাস করে না। ফলে, সমদর্শী চেতনাসম্পন্ন ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের কোনো সদস্য-রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের তুলনা হতে পারে না।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতেক প্রদত্ত স্থল, নৌ কিংবা রেল পথে ট্র্যানজিট ও ট্র্যানশিপমেন্ট সুবিধা প্রধানত ভারতকেই উপকৃত করেছে। ভারতকে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর দু’টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহার করার সুযোগ দান বা ট্র্যানজিট ও ট্র্যান্সশিপমেন্ট সুবিধা দানের বিনিময়ে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক আয়ের লীগ-সরকার কর্তৃক পূর্বাহ্নে প্রাক্কলিত ও প্রচারিত চিত্রটিও ইতিমধ্যে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে।

বিগত জুনে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের জন্য ভুটান ও নেপালের ভেতর যাত্রী ও পণ্যবাহী রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের কথা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এলাকায় ‘উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা’ প্রকল্পের অধীনে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ব্যাপারে বিগত ১০ বছর যাবৎ বহু আলোচনা হয়েছে, বহুবার আমরা লিখিত-অলিখিত ভারতীয় প্রতিশ্রুতি শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্প বাস্তাবায়নের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

যাই হোক, বাংলাদেশ-ভারতের এই প্রস্তাবিত রেল প্রকল্পটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বিপজ্জনক পর্যায়ে অধপতিত করতে পারে। লীগ-সরকার এই প্রস্তাবিত রেল যোগাযোগকে ‘ট্র্যানজিট ব্যবস্থা’ হিসেবে দাবি ও প্রচার করলেও, এটা আসলে ভারতের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার জন্য ‘করিডোর’ ছাড়া কিছু নয়। কেননা, ‘ট্র্যানজিট ব্যবস্থার’ অধীনে একটি দেশ অন্য একটি দেশে যাওয়ার জন্য মধ্যবর্তী এক বা একাধিক দেশকে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু, বর্তমান ক্ষেত্রে ভারতের ট্রেন ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের গেঁদে অঞ্চল থেকে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে, ভারতীয় পণ্য বহন করে ভারতেরই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের ডালগাঁও অঞ্চলে প্রবেশ করবে। এটা চীনের জন্য একটা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কেননা, ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের প্রচুর লেন-দেন থাকা সত্ত্বেও, সীমান্ত নিয়ে এই দু’টি দেশের ভেতর বিরাজিত রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক সমস্যা বহুবার সামরিক সংঘর্ষে পর্যবসিত হয়েছে। চীনের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘অরুনাচল’ প্রদেশের ওপর বেইজিংয়ের দাবি ক্রমশই জোরদার হচ্ছে। এমতাবস্থায়, ঐ অঞ্চলে উভয় দেশের সম্ভাব্য সীমান্ত সংঘর্ষের সময় যদি ভারত তাঁর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্রুততর সময়ে সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পরিচালিত রেল-ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে, তাহলে বাংলাদেশ শক্তিমান চীনের কোপানলে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত তথ্য প্রতিমন্ত্রী, মোহাম্মদ এ আরাফাত, অবশ্য দাবি করেছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট সমঝোতা স্মারকে প্রস্তাবিত রেলপথে কোনো ‘রেড গুড্স’, অর্থাৎ বিপজ্জনক দ্রব্যাদি, অর্থাৎ সামরিক সরঞ্জাম, পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু ভারতের তরফে একাধিক বিশ্বাসভঙ্গের অতীত উদাহরণ থাকার কারণে, ভারতীয় প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা স্থাপন করা কঠিন। তদুপরি, ট্রেনের বগিভর্তি মালামালের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়মিত পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের এখতিয়ার ও পদ্ধতি সম্পর্কে সমঝোতা স্মারকে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তথাপি, আমরা ভারতের ওপর আস্থা রাখলেও, চীন ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে বিরাজিত ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত শীতল সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, সীমান্তবর্তী চীনের তরফে ভারতকে বিশ্বাস করা আরো কঠিন বৈকি। বাংলাদেশের ওপর দিয় ভারতের এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চল সংযোগকারী রেলপথ স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ হয়তো ভারত ও চীনের ভেতর বিদ্যমান স্নায়ু যুদ্ধের অসহায় শিকারে পরিণত হবে – যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভৌগলিক সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।

অন্যদিকে, ভারত-চীন সম্পর্ক যদি সাংঘর্ষিক পর্যায়ে না-ও পৌঁছায়, বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা/স্বশাসনপন্থী রাজনৈতিক শক্তিসমূহের রোষানলে পতিত হতে পারে। ভারতের দিল্লী-সরকার অতীতে বহুবার উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা/স্বশাসনপন্থী লড়াই-সংগ্রামকে দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ব্যবহার করেছে। ‘সাত-বোন’ নামে পরিচিত উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি প্রদেশের জনগণের রাজনীতি-সচেতন বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদেরকে দিল্লী-কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শিকার হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে, এই অঞ্চলে থেকে থেকে স্বাধীনতা বা স্বশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন ‘জাতিবাদী’ সংগ্রামকে দমনের জন্য দিল্লী যদি সমঝোতা স্মারকে বর্ণীত শর্তাবলী এড়িয়ে, গোপনে, রেলপথে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর প্রয়াস নেয়, তবে বাংলাদেশ ভারতের ঐ সব স্বাধীনতা/স্বশাসনপন্থী সংগ্রামী জনগোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। সর্বোপরি, কোনো স্বশাসনবাদী সংগ্রামী জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালাবার জন্য কোনো রাষ্ট্র-শক্তিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করার সুযোগ দেয়ার চিন্তাটিই বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের সাথে নৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানি নয়া-উপনিবেশবাদী শাসন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, স্বায়ত্ত্বশাসনবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ বেয়েই, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তার ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ প্রতিষ্ঠা করেছে।

স্পষ্টতই, পরিপূর্ণ ভারতীয় স্বার্থে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের একাঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রকল্পটি বাংলাদেশকে নানা ধরনের বিপজ্জনক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে।

বর্তমান এই জটিল জাতীয়, আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে স্বাধীনভাবে বাংলাদেশের অগ্রগমনের পথ কী?

নূরুল কবীর: রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে উত্থিত বাংলাদেশের ইতিহাস-নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রয়াসের মধ্যেই কেবল বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর সমাধান নিহিত রয়েছে। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশের ‘ইতিহাস-নির্দিষ্ট গন্তব্যটা’ কি এবং তা কীভাবে নির্ণীত হয়েছে, তা উপলব্ধি করা জরুরি।

বাংলাদেশে একটি যথার্থ সমতা-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা এবং সে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়নের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই বাংলাদেশের ইতিহাস-নির্দিষ্ট গন্তব্য। কেননা, বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা পত্রে’ লিখিত এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই এই দেশের সর্বস্তরের জনগণ, বিশেষত জনগণের গরিব অধিকাংশ, ১৯৭১ সালে তৎকালীন হানাদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং অপরিমেয় আত্মত্যাগের মাধ্যমে যুদ্ধজয় করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশে একটি যথার্থ সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায় ইতিহাসই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির নানা রাজনৈতিক দল ও সংগঠন দেশের সেই ইতিহাস-নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে, একদিকে যেমন ‘স্বাধীনতা’ থেকে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষ আশানুরূপ লাভবান হতে পারেনি, অন্যদিকে স্বাধীনতার পরিপূর্ণ সুফলভোগী স্বৈরতান্ত্রিক শাসকশ্রেণিটির নীতি-বিগর্হিত নানা তৎপরতার জন্য বাংলাদেশ নানা বিদেশি শক্তির কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নীরব লড়াইয়ের অসহায় লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।

ইতিপূর্বে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি শক্তিমান রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থগত প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখার যে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি, তা মূলত একটি ‘আত্মরক্ষামূলক’ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক প্রকল্প, কিন্তু কোনো দেশের অপ্রতিনিধিত্বশীল ও দুর্নীতিপরায়ণ কোনো সরকারের পক্ষেই সেদেশের জন্য কোনো যথার্থ ‘আত্মরক্ষামূলক’ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেননা, আগেই বলেছি, কৌশলগত ভূ-রাজনীতির এই সংবেদনশীল যুগে, এক বা একাধিক প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া অন্তত কোনো জনবিচ্ছিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে বছরের পর বছর রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সম্ভব নয়। আবার, একাধিক প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে বহুমাত্রিক ‘জাতীয় স্বার্থ’ বিকিয়ে দিয়েই কেবল কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের অন্যায্য সমর্থন লাভ করতে পারে। লীগ-সরকার বিগত দেড় দশক ধরে ঠিক তা-ই করে চলেছিল।

বিদেশি পরাক্রমশালী রাষ্ট্রসমূহের বৈরী প্রভাব এড়িয়ে বাংলাদেশসহ যেকোন অনগ্রসর দেশের স্বাধীনভাবে পথ চলার একমাত্র পথ হচ্ছে তার অন্তর্নিহিত ‘আত্মশক্তি’র উদ্বোধন ও বিকাশ নিশ্চিত করা। অন্য কথায়, ‘আত্মশক্তির’ যথার্থ বিকাশই কেবল শক্তিমান বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের বৈরী প্রভাব থেকে বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর দেশগুলোকে মুক্ত রেখে ‘আত্মরক্ষা’র নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, তার ‘আত্মশক্তি’ বিকাশের একমাত্র পথ হচ্ছে আপন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, অর্থাৎ বাংলাদেশে একটি সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছা’র যথার্থ প্রতিফলন হিসেবে জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গ-পরিচয় নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মানুষের ভেতর সম্পাদিত একটি ‘সামাজিক চুক্তি’ হিসেবে, একটি রাষ্ট্রীয় ‘সংবিধান’ রচনা করতে হয়। এদেশের প্রায় সকল শ্রেণি ও জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণে, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ বেয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্থান ঘটলেও, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘সংবিধান’ রচনায় তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক দলটি, আওয়ামী লীগ, অপর কোনো রাজনৈতিক দল বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা অনুমোদন করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধপূর্ব পরিস্থিতিতে, অখণ্ড পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতর, লীগের ৬-দফাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচিত সদস্যগণই এককভাবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ রচনা করেন। নতুন দেশে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো ‘সংবিধান সভা’ তখন গঠিত হয়নি। স্বভাবতই, একটি সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে এদেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও আকাক্সক্ষার যে বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধিত হয়েছিল, লীগ-প্রণীত নতুন সংবিধান তা পরিপূর্ণভাবে ধারণ করতে পারেনি। তাছাড়া, সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অবাঙালি জাতি-গোষ্ঠীসমূহের, বিশেষত পাহাড়ি জনগণের, উদ্বেগ ও আশা-আকাক্সক্ষাকে আমলেই নেয়া হয়নি। ফলে, প্রথম থেকেই বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রীয়’ সংবিধানটি দেশের সকল দল, শ্রেণি ও জাতি-গোষ্ঠী, তথা এদেশের সমগ্র জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছার দলিল হয়ে উঠতে পারেনি। তদুপরি, পরবর্তীকালে বাঙালি শাসকশ্রেনির বিভিন্ন দল ছলে, বলে ও অপকৌশলে বিভিন্ন সময়ে আপন আপন সংগঠনের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রের আলোকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে বারম্বার পরিবর্তন করেছে। ফলে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান ‘সংবিধান’ এদেশের জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছা’র প্রতিফলনমূলক দলিল কিংবা সকল শ্রেণি ও জাতি-গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের ভেতর সম্পাদিত ‘সামাজিক চুক্তি’ হিসেবে বিরাজ করে না। রাষ্ট্রীয় সংবিধান পরিবর্তনে জনগণের ‘সম্মতি’ গ্রহণের রাজনৈতিক উপায় হিসেবে ‘গণভোট’ গ্রহণের অপরিহার্য বিধানটিও বর্তমান সংবিধানে অনুপস্থিত। সর্বোপরি, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জনগণের ‘মৌলিক অধিকার’, যেমন অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা ও চিকিৎসা, বাংলাদেশের সংবিধানের যথাস্থানে যথাযোগ্য স্বীকৃতিই দেয়া হয়নি। রাষ্ট্রের তরফে সেগুলো বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক কর্তব্য হিসেবে এবং সে কর্তব্য পালনে সরকারি অনীহা কিংবা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে, আইন-আদালতের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করার গণতান্ত্রিক বিধান সংযোজন করা তো দূরের কথা।

এমতাবস্থায়, পৃথিবীতে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ বিকাশের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, যথার্থ নিয়মে নির্বাচিত একটি ‘সংবিধান সভা’র মাধ্যমে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার আলোকে, সকল শ্রেণি ও জাতি-গোষ্ঠীর আকাক্সক্ষাসমূহের সমন্বয় সাধন করে একটি জনস্বার্থপরায়ণ ‘সংবিধান’ প্রণয়নের ভেতর দিয়ে সমতা ও ন্যায়-ভিত্তিক ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ নির্মাণের জরুরি কর্তব্য আমাদের সামনে হাজির রয়েছে। সেই সংবিধানে স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ সরকার কর্তৃক বাস্তবায়নের আইনগত বাধ্যবাধকতার বিধানও সন্নিবেশিত থাকতে হবে।

রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, অর্থাৎ জাতীয় সংসদ, সংবিধান প্রদত্ত দিক-নির্দেশনার ভিত্তিতে ও জনপরিসরে প্রতিফলিত জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার আলোকে, নিজেদের ভেতর পর্যাপ্ত তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করবে।

নির্মিতব্য সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ একদিকে যেমন সকল প্রশাসনিক স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিজের কাজের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, রাজনীতি-সচেতন কিন্তু দলনিরপেক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতায়, সমাজ ও অর্থনীতির সমতাভিত্তিক বিকাশে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। সর্বোপরি, রাষ্ট্রের আইন ও নির্বাহী বিভাগের কোনো সংবিধান-পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের প্রতিকারের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগের উচ্চকিত উপস্থিতির সাংবিধানিক নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সামর্থের যথাযথ বিকাশের জন্য এই রাজনৈতিক প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনিবার্য। অর্থাৎ বাংলাদেশে, মুক্তিযুদ্ধের মৌল-চেতনার আলোকে, একটি ‘জনগণতান্ত্রিক রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য।

বাংলাদেশের প্রতিটি চিন্তাশীল ও চক্ষুষ্মান মানুষই এখন অবগত যে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কর্তৃপক্ষ ‘প্রজাতন্ত্রের’ আইনবিভাগ বা জাতীয় সংসদের ওপর আপন দলভুক্ত লোভাতুর ব্যবসায়ীদের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা, নির্বাহী বিভাগের পরিপূর্ণ দলীয়করণ ও বিচার বিভাগের ওপর অবিশ্বাস্য মাত্রার নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার মাধ্যমে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে প্রধানত রাজনৈতিকভাবে দুর্বিনীত, অর্থনৈতিকভাবে দুর্নীতিপরায়ণ ও সাংস্কৃতিকভাবে দুস্থ এক ক্ষুদ্র বিত্তবান শ্রেণির তরফে একটি শোষণ-নিপীড়নমূলক একদলীয় প্রতিষ্ঠানে অধপতিত করেছে।

তাছাড়া, দেশের নাগরিকদের কাছে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বদলে নাগরিকদেরই রাষ্ট্রের পদানতকরণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবন, ছোট-বড় নানা জাতি-গোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি দেশে অন্যদের ওপর বৃহত্তর জাতিসত্ত্বার উৎকৃষ্টতাবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈরী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ, ক্ষমতাসীন দল/সরকার-প্রধানকে দেশের নির্বিকল্প নেতা/নেত্রী হিসেবে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্যে তাকে ঘিরে ‘কাল্ট’ নির্মাণ, গোটা সমাজে মুক্ত-চিন্তার চর্চা ও তা প্রকাশে আইনি-বেআইনি নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, চালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরভুক্ত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে অবিরাম অপপ্রচার, এমনকি স্বাধীনভাবে চিন্তাশীল নির্দলীয় বুদ্ধিজীবীদের গায়ে হরেক রকমের দলীয় তকমা আঁটা, প্রভৃতি ফ্যাসিবাদী চিরায়ত রাজনৈতিক-ভাবাদর্শিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিলে, আওয়ামী লীগকে একটি নিকৃষ্ট ধরনের ফ্যাসিবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। আর, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এহেন একটি ফ্যাসিবাদী সংগঠনের কর্তৃত্বাধীনে থাকার করণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও একটি ফ্যাসিবাদী প্রতিষ্ঠানে অধঃপতিত হয়েছে। সদ্য-সংঘটিত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান দমনে লীগের হত্যাযজ্ঞ পরিচালনায় পুলিশ-র‌্যাব প্রভৃতির নৃশংস ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রের ফ্যাসিবাদী চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যই পরিস্ফুটিত হয়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত লীগ কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের দলীয়কৃত নির্বাহী বিভাগ, তথা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিশেষত সশস্ত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের অপরাধমূলক সহযোগিতায়, প্রহসনমূলক ‘জাতীয়’ নির্বাচনের মাধ্যমে একের পর এক জনপ্রতিনিধিত্বহীন ‘জাতীয় সংসদ’ গঠন করেছিল। তারপর সেই সব ‘জাতীয় সংসদ’কে ব্যবহার করে একদিকে দলীয় স্বার্থান্ধ নানা সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রকল্পের গায়ে ‘শাসনতান্ত্রিক ন্যায্যতা’ আরোপের জন্য, অন্যদিকে প্রতিবাদী বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমন-নিপীড়নের গায়ে ‘আইনগত বৈধতা’ দানের উদ্দেশ্যে, রাষ্ট্রীয় সংবিধানের যথেচ্ছ পরিবর্তন সাধন ও অসংখ্য নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করেছে। এহেন নানা স্বৈরতান্ত্রিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকেও লীগ কর্তৃপক্ষ যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে।

ওদিকে, রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বি বিরোধী রাজনৈতিক শিবির ও তার সমর্থকদের মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগ নিজেকে একটি চিন্তাশীল গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে সম্প্রসারিত করার পরিবর্তে বরং একটি স্বার্থান্ধ স্বৈরতান্ত্রিক পেশীশক্তি হিসেবে বিকশিত করেছিলেন। লীগ শাসনামলে ‘রাজনীতি’ হয়ে উঠেছিল অরাজনৈতিকভাবে অর্জিত রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ পন্থায় অসীম সম্পদ আহরণের এক অব্যর্থ অবলম্বন- ‘উন্নয়নমূলক’ জাতীয় অর্থনীতি চর্চার নামে দেশে কায়েম করেছিল লীগ-সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র একটি দুর্নীতিবাজ বিত্তবান শ্রেণির স্থূল ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার আর্থিক লুটপাটতন্ত্র। কোনো প্রকারে জাতীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য ‘নির্বাচিত’ হলেও, কয়েক বছরের মধ্যে তাঁদের অধিকাংশের, অনেক ক্ষেত্রে এমনকি তাদের নিকট পরিজনদেরও, তাঁদেরই দেয়া নির্বাচনী হলফনামা অনুসারে, সম্পদের পরিমাণ দু’শ/তিন’শ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। বিগত মে-জুনে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) দেখিয়েছে যে, পাঁচ বছর উপজেলা চেয়ারম্যান থাকার সময়কালে তাঁরা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এদের শীর্ষ দশজনের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২,১৫৭ শতাংশ থেকে ১১,৬৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার, এসব সম্পদ থেকে তাঁদের আয় ১,৬৫০ থেকে ১০,৯০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, উপজেলা পর্যায়ে রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ সাধারণত চেয়ারম্যান এর নেতৃত্বাধীন উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে/অংশগ্রহণে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, আর এই কথিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দকৃত জনগণের টাকার একটি বিরাট অংশ আত্মসাতের মাধ্যমেই এই তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় নির্মিত হয়েছে। স্পষ্টতই, নানা সামাজিক-ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের ভেতর থেকে উঠে আসা, জনগণের বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ণ ও অর্থনৈতিক সততার সঙ্গে তা বাস্তবায়নের ধারণাও লীগ নেতা-কর্মীদের মনোজগতে অনুপস্থিত।

এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন-খরচের তুলনায় দুই/তিনগুণ বেশি মূল্যে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প বাস্তাবয়নের মাধ্যমে, জনগণের করের টাকা ও জনগণের নামে সংগৃহীত বিদেশি ঋণের একটি বিরাট অংশ আত্মসাৎ করা সহ দেশি ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে অবৈধভাবে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করা এই লুটেরা অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। লক্ষ করুন, ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে লীগ-সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরের অর্থবছরে, ২০১৫-২০১৬ সালে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১.১৭ বিলিয়ন ডলার। তারপর আরো দুটি প্রহসনমূলক ‘জাতীয় নির্বাচনের’ ভিত্তিতে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা লীগ-সরকারের শাসনামলেই, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে, এই বিদেশি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ১০০.২৩ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। সেই সুদ পরিশোধের জন্য আবার নতুন নতুন ঋণ নিয়ে দেশের ভবিষ্যৎকেই ঋণগ্রস্থতার এক জটাজালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ওদিকে, প্রধানত লীগ আমলে ব্যাংক-ব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করার কারণে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৫৬,০৩৯ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে, আমদানি-রফতানির পরিমাণ ও মূল্যে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এভাবে, বিগত ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’র প্রতিবেদন আনুযায়ী, বাংলাদেশি থেকে প্রতিবছর ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে চলেছে।

এদিকে, ‘উন্নয়নের রাজনীতি’র গালভরা শ্লোগানের আড়ালে জনগণের টাকায় লীগ-সরকার কিভাবে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রভূত অন্যায় ও অন্যায্য আর্থিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে, তা বোঝার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের হরির লুট প্রকল্পের দিকে নজর দেয়া যেতে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে, বিগত প্রায় দেড় দশকে ব্যক্তিগত খাতে মোট ৮২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করেছে, যে প্রকল্পগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ২৬,৮৪৪ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। লীগ-সরকার ২০২৪ সালের প্রতিদিনের জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা নির্ণয় করেছে ১৭,৮০০ মেগাওয়াট, কিন্তু ব্যক্তিখাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর প্রত্যেকের সাথে সরকার এই মর্মে চুক্তি সম্পাদন করেছে যে, সরকার তার চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সংগ্রহ করবে কিন্তু কোম্পানিগুলোকে তার সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করবে। অর্থাৎ অল্প চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করেও চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন ক্ষমতার জন্য এই কোম্পানিগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে। এভাবে, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ প্রদত্ত ক্ষমতাচ্যুত বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে লীগ-সরকার এই বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো থেকে বিদ্যুৎ আহরণ না করেও মোট ১.০৪ লক্ষ কোটি টাকা ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে জনগণের করের টাকা থেকে পরিশোধ করেছে।

বর্তমান বছরের এপ্রিলের শেষে যখন বাংলাদেশে বাতাসের তাপমাতা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেল, তখন সরকার প্রতিদিন ১৭,৮০০ মেগাওয়াট সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা থাকবে বলে নির্ণয় করে। কিন্তু পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিদিন বাস্তবে সর্বোচ্চ ১৬,৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। ফলে, সারাদেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, প্রচণ্ড দাবাদহের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ বিদ্যুৎবিহীন দুর্বিসহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। এই প্রচণ্ড তাপ প্রবাহের সময় দেশের বহু হাসপাতালেও বিদ্যুৎপ্রবাহ না থাকার কারণে লীগ-সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসমূহকে রোগীদের জন্য, ৫ মে তারিখে, ‘হাতপাখা’ সরবরাহের লিখিত নির্দেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছিল। স্পষ্টতই, লীগের ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ যখন স্বল্প সংখ্যক মানুষকে জনগণের করের টাকায় অন্যায়ভাবে বিত্তশালী হতে সাহায্য করেছে, তখন জনগণের অধিকাংশই কথিত উন্নয়নের চাপে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। ধনী ও গরিবের ভেতর বিরাজিত বিভৎস মাত্রার আয়-বৈষম্যের কথাতো আগেই বলা হয়েছে।

স্পষ্টতই, ক্ষমতাচ্যুত লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পক্ষে তার ইতিহাস-নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হওয়া, অর্থাৎ সমতাভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের রাজনৈতিক প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না।

কিন্তু গদিচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে কি এখানে সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব? একথা সত্য যে, লীগ শাসনামলে জাতীয়তাবাদী দলের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে হামলা-মামলা, গুম-খুন সহ নানা ধরনের সরকারি অন্যায়-অবিচার ও উৎপীড়ন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ফলে, মূলধারার রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তার প্রতি অসংখ্য মানুষের ন্যায়সঙ্গত সহানুভূতি রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিকশিত জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা কি আদৌ এই জাতীয়তাবাদী দলের আরাধ্য কর্মসূচি?

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যূত করার সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী দল বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত একটি বিমূর্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করলেও, সেসব বাস্তবায়নের কর্মকৌশল সম্পর্কে দলিলটি পুরোপুরি নীরব। তাছাড়া, দলের নেতৃবৃন্দ তাঁদের দলীয় সভা-সমাবেশে সেই কর্মসূচির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করে দলের ভেতরে-বাইরে জনমত তৈরি করা তো দূরের কথা, সে সম্পর্কে কোথাও তাদের কোনো টু-শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সুস্থ বিকাশের পরিপন্থী লীগ-অনুসৃত নীতিমালার বিকল্প প্রস্তাবনা, ভয়াবহ আয়-বৈষম্য নিরোধের উপায়, বিদ্যমান লুটপাটতন্ত্রের হোতাদের সম্পর্কে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, পাঁচার হয়ে যাওয়া কোটি কোটি ডলার দেশে ফিরিয়ে আনার পথ ইত্যাদি সম্পর্কেও জাতীয়তাবাদী দল রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে দলটির এই নীরবতা সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে নানা সংশয় সৃষ্টি করতে বাধ্য। স্পষ্টতই, সমাজ ও রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির ‘গণতান্ত্রিক সংস্কারের’ ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী দলেরও কোনো স্বচ্ছ অবস্থান নেই – পতিত লীগ-সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী জনতার ক্ষোভ ও বিক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা পুনর্দখল করাই যেন দলটির অন্বিষ্ট।

এমতাবস্থায়, বিশেষত একটি অবিস্মরণীয় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী লীগ-সরকারের পতন ও পলায়নের পর, জনগণের ভোটাধিকারসহ অপরাপর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি, জনস্বার্থপরায়ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় গোটা শাসকশ্রেণির বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহজাত সীমাবদ্ধতা ক্রমাগত উন্মোচন করার ভেতর দিয়ে, সমতাভিত্তিক ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি বিকাশের পথ প্রশস্ত করাই আমাদের কর্তব্য। সেই পথ ধরেই এদেশের মানুষ ভবিষ্যতে একদিন তার ইতিহাস-নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।

বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক অভিযাত্রায় স্বৈরতান্ত্রিক লীগ-সরকারের বিরুদ্ধে সদ্য সংঘটিত বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান তার ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে?

নূরুল কবীর: অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই নিজেকে একটি সংস্কারবাদী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবাবলী উপস্থাপন করার জন্য বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে। তাছাড়া, সরকারের ভেতরে অভ্যুত্থানের ছাত্র-নেতৃত্বের যে প্রতিনিধিরা আছেন, তাঁরাও সেনাবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার ভিত্তিতে, একটি সংস্কারমূলক সরকার গঠনের পক্ষে মত প্রদান করেছেন এবং এই তিন পক্ষের পছন্দ অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। বিদ্যমান সরকারের সদস্যদের মধ্যে প্রায় কেউ কোনদিন কোনো প্রগতিশীল বৈপ্লবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না; এমন দাবিও তাঁরা কেউ কখনও করেননি। আবার, সামষ্টিকভাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেও নিজেকে ‘বিপ্লবী সরকার’ হিসেবে উপস্থাপন করেন না। ফলে, এই সরকারের কাছে বর্তমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কারসাধন ও পরবর্তীকালে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সংস্কার প্রস্তাবের বেশি আশা করা যৌক্তিক হবে না।

কিন্তু, আমরা লক্ষ্য করছি, ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার গঠিত হওয়ার পর কোন কোন ‘বুদ্ধিজীবী’ এই গণঅভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে, সংশ্লিষ্ট সংস্কারবাদী সরকারটিকে বিপ্লবের কৃত্রিম আলখাল্লা পরিয়ে, সেই সরকারটিকে দিয়ে বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির ‘বৈপ্লবিক রূপান্তর’ সাধনের আশা করছেন, আর সরকার তাতে কর্ণপাত না করায় তাঁরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন।

রাজনৈতিক-দার্শনিক অর্থে ‘বিপ্লব’ হল সেই বস্তু, যা কোন দেশে ইতিহাস-সচেতন রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে – নিরস্ত্র কিংবা সশস্ত্র, কিংবা উভয়বিধ – কোন পশ্চাদপদ শাসকশ্রেণীকে তার ইতিপূর্বে সংগঠিত রাষ্ট্রপাট ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাসহ উচ্ছেদ করে, পুরনো প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার ভগ্নস্তুপের ওপর বিজয়ী শাসিতশ্রেণীর স্বার্থের পক্ষাবলম্বী নতুন প্রগতিশীল রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ তৈরি করে।

লক্ষ্য করুন, ফরাসি বিপ্লব সেদেশের সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে, তৎকালে বিকশিত বিপ্লবী বুর্জোয়ার পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। রুশ বিপ্লব রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি-ব্যবস্থাসমেত শহরাঞ্চলে বিকশিত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাভিত্তিক রাষ্ট্রপাট ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে, আধুনিক শ্রমিক শ্রেনির তরফে ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতি প্রবর্তন ও গ্রামাঞ্চলে কৃষক সমাজের জন্য গণতান্ত্রিক ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ নির্মাণ করেছিল। ওদিকে, চীন-বিপ্লব সেদেশের সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে শ্রমিক-কৃষকের তরফে নয়া-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল।

এখানে একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, উপরোল্লেখিত ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ঘটনাগুলোর পেছনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক তৎপরতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক চর্চার প্রক্রিয়ায়, বিভিন্ন বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সেই সব বিপ্লবী সংগঠনগুলো রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেনির বিরুদ্ধে নিজেদের রাজনীতি-সচেতন সংগঠিত তৎপরতার মাধ্যমেই আপন আপন দেশে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিল – মোটেও তা কোন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা ও তাৎক্ষণিক তৎপরতার ফল ছিল না।

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট সময়কালে সংগঠিত শিক্ষার্থী-গণঅভ্যুত্থান, এদেশের বাস্তবতায়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক ঘটনা। কেননা, এই অভ্যুত্থান বিগত ১৫ বছরব্যাপী জনতার বুকে চেপে বসা আওয়ামী লীগের স্বৈরাতান্ত্রিক জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে দিয়েছে। এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর অনেক বৈপ্লবিক উপাদান লড়াকু তরুণদের কণ্ঠে উচ্চারিত স্লোগানের ভেতর থেকে থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে – রাজপথে অকাতরে আত্মদান ছাড়াও দেয়ালে অঙ্কিত প্রাফিতি ও কার্টুন এখনও তার স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কিন্তু এই সংগ্রামের নেতৃত্বের দিক থেকে কোন পূর্ব পরিকল্পিত বৈপ্লবিক চিন্তা ও কর্মসূচি ছিল না – ছিল না তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত কোন সুসংগঠিত বৈপ্লবিক সংগঠন।

সর্বোপরী, সরকারি চাকুরিতে বৈষম্যমূলক কোটা-ব্যবস্থার বিলোপের দাবিতে সূচিত আন্দোলনের উত্তঙ্গ পর্যায়ে, ২৮ জুলাই, ইতিমধ্যেই যখন লীগ-সরকারের ঘাতক বুলেটে কয়েকশ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তখন আন্দোলনের নেতৃত্বের দিক থেকে যে ৯-দফা কর্মসূচি ঘোষিত হয়, তার সর্বোচ্চ দাবি ছিল -‘ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘প্রকাশ্য ক্ষমা’ প্রার্থনা। হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে মুহূর্মুহূ স্লোগানে রাজপথ তখন প্রকম্পিত। কিন্তু সংগ্রামের নেতৃত্ব হাসিনার পদত্যাগের দাবি উত্থাপনের জন্য আগস্টের ৩ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, সংগ্রামরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়ার বিরুদ্ধে ঢাকা সেনানিবাসে সেনাপতিদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে, অর্থাৎ সেনাবাহিনী কর্তৃক খুনি হাসিনা সরকারের পক্ষত্যাগের পরিষ্কার ইঙ্গিত প্রকাশিত হওয়ার পর, ছাত্র-নেতৃত্ব ‘হাসিনার পদত্যাগের’ দাবি উত্থাপন করেছেন। সেদিন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করার সময়, ছাত্র-নেতৃত্ব ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ প্রবর্তনের আকাঙ্খা ব্যক্ত করলেও, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর কি ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, কারা সরকার গঠন করবেন, সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অভিপ্রকাশিত জন আকাক্সক্ষার ধরন কি, প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকার কিভাবে তা বাস্তবায়ন করবে, গোটা ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ’ করার পথ কি, কিভাবেইবা ‘নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ প্রবর্তিত হবে, ইত্যাদি জরুরি প্রশ্নে তাঁদের কোন রূপরেখাও ছিল না। স্বভাবতই, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরও তাঁর ও তাঁর শ্রেনির রাষ্ট্রপাট, আইন-কানুন ও নানা সংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ন রয়েছে। স্বৈরতান্ত্রিক হাসিনা-সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, পুরনো আমলের সকল প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি অক্ষত থাকার কারণে, হাসিনার লীগ-সরকারকে উৎখাতকারী মহান গণঅভ্যুত্থানটিকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই; আর যেখানে বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, সেখানে ‘বিপ্লবী সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিই অবান্তর। এটা অতএব মোটেই আশ্চর্যের কিছু নয় যে, কিঞ্চিত ব্যতিক্রমসহ বিদ্যমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক সংবিধানের ‘আলোকে’, সেই সংবিধানসৃষ্ট রাষ্ট্রপতি-প্রদত্ত শপথ গ্রহণের মাধ্যমে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠিত হয়েছে এবং সরকারের সদস্যরা বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় সংবিধান ‘সমুন্নত’ রাখার জন্য শপথবদ্ধ রয়েছেন। এই সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ আখ্যা দেয়া এবং তার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক রূপান্তরের আশা পোষণ করা একটি বাস্তবতা বিবর্জিত সুখস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়।

কিন্তু বিজয়ী ছাত্রনেতাদের কেউ কেউও সদ্য-সংঘটিত গণঅভ্যুত্থাকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন এবং ‘বিপ্লবোত্তর’ সময়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার যথার্থ অভিপ্রকাশ হিসেবে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে দেশে একটি যথার্থ ‘গণতান্ত্রিক রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করতে চান।

রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে একটি নতুন ‘রিপাবলিক’ নির্মাণের ভাবনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের একটি ছোট্ট পরিসরে রাজনৈতিক বিতর্ক হিসেবে বহুদিন ধরেই এই ডিসকোর্স হাজির রয়েছে। আমি নিজে, বিগত আওয়ামী দুঃশাসনের ভেতরেই, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম রিপাবলিকটির দৃশ্যমান ‘ব্যর্থতার’ পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন করে, ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতার পক্ষে নিবন্ধ লিখে প্রকাশ করেছি। তাছাড়া, সেই ১৯৯০-এর ‘গণতন্ত্রসম্ভবা ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক গর্ভপাত’ প্রত্যক্ষ করার সময় দেশে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সংবিধান সভা’ গঠনের ও তার মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার আবশ্যিকতা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছিলাম। অন্যরাও কখনো কখনো এ বিষয়ে লিখেছেন, কথা বলেছেন। আমরা জানি, কোন দেশে জনগণের সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কোন বিকল্প পথ নেই, কিন্তু এই ভাবনা এখনও পর্যন্ত আমাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজকে পর্যাপ্ত পরিমানে প্রভাবিত করতে পারেনি। ওদিকে, রাজনৈতিক পরিসরে কোন ‘চিন্তার’ পর্যাপ্ত প্রভাব সৃষ্টি ব্যতিত ও সে ‘চিন্তার’ পক্ষে সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠা ছাড়া কোন সমাজেই তা বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ করা যায় না।

সম্প্রতি সংঘটিত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-নেতৃত্বের একাংশের দিক থেকে উত্থাপিত ‘ফ্যাসিস্ট’ পুরনো সংবিধান বাতিল ও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রনয়নের দাবিটি, দৃশ্যতই, তাঁদের গণ-অভ্যুত্থানোত্তর ভাবনা – ইংরেজিতে যাকে ‘আফটার থট’ বলা হয়ে থাকে। সে যাই হোক, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের যথাযথ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য এই চিন্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের জন্য এই চিন্তার পক্ষে প্রয়োজনীয় নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি এই লড়াকু তরুণরা এখনও গড়ে তুলতে পারেননি – একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁরা তা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন মাত্র, যার সাফল্য এখনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি।

এমতাবস্থায়, একটি যথার্থ ‘গণতান্ত্রিক রিপাবলিক’ নির্মাণ করার জন্য সদ্যসংঘটিত বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের পেছনে অপরাপর যেসব রাজনৈতিক শক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাঁদের সাথে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো ছাড়া সংশ্লিষ্ট ছাত্র- নেতৃত্বের জন্য আপাতত কোন পথ নেই। সেক্ষেত্রে, প্রয়োজনীয় সমঝোতা গড়ে তোলার প্রয়াস ও প্রক্রিয়ায়, ছাত্র-নেতৃত্বের এটাও তাঁদের মনে রাখা জরুরী যে, এই শিক্ষার্থী-গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র সমন্বয়কদের মধ্যে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কিছু নেতাও জড়িত ছিল বলে শোনা যায়, আর ছাত্র-শিবিরভূক্ত এই তরুণদের রাজনৈতিক মুরুব্বী সংগঠন, জামায়াতে ইসলামী, রাজনীতি চর্চা ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ ধারণাই বিশ্বাস করে না। জামায়াতের প্রয়াত নেতা আব্বাস আলী খান তাঁর রচিত এক গ্রন্থে – জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস – পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী জনগণের স্বার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না’। এদেশে সক্রিয় অপরাপর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের কোনটিই ‘জনগণের সার্বভৌমত্বে’ বিশ্বাস করে না – তাঁদের দলীয় ও ব্যক্তিগত ভাবাদার্শ অনুযায়ী, আল্লাহর মধ্যেই কেবল জগতের সার্বভৌমত্ব নিহিত রয়েছে। স্বভাবতই, জামায়াতসহ অপরাপর ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলি ছাত্র-নেতৃত্বের এই গণতান্ত্রিক প্রকল্পকে সমর্থন করবে না।

অন্যদিকে, এই মুহূর্তে দেশের সর্ববৃহত রাজনৈতিক সংগঠন, জাতীয়তাবাদী দল, রাষ্ট্রপরিচালনায় নাগরিকদের জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা’ কাগজে-পত্রে স্বীকার করলেও, তার কথিত অন্তর্ভূক্তিমূলক ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ বাস্তবে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদে’ রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে, জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্ব বর্তমান বিপ্লববাদী ছাত্র নেতৃত্বের উত্থাপিত দাবি – ‘ফ্যাসিবাদী’ রাষ্ট্রীয় সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে চিরায়ত গণতান্ত্রিক ধারণার আলোকে একটি নতুন সংবিধান রচনা – পুরোপুরি গ্রাহ্য করবে বলে ধরে নেয়া কঠিন। কেননা, এই জাতীয়তাবাদী দলই, ১৯৯০ এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর, আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের জনস্বার্থপরায়ন গণতান্ত্রিক চেতনাকে, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষার নামে, পুরনো সংবিধানসম্মত ‘নৈর্বাচনিক স্বৈরতন্ত্রের’ চোরাবালিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এবার, বিগত ১৫ বছর লীগ শাসনামলের অধীনে জাতীয়তাবাদী দলের তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, বিদ্যমান সংবিধানে বিরাজিত লীগের কিছু কিছু ফ্যাসিবাদী চিহ্ন মুছে দিয়ে নিজস্ব সংস্কার ভাবনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণেই তাদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি।

ওদিকে, ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ভূক্ত ও মঞ্চবহির্ভূত বাম ও মধ্যপন্থী বলে পরিচিত রাজনৈতিক দল ও গ্রুপগুলির কেউ কেউ ছাত্র-নেতৃত্বের বৈপ্লবিক দাবির প্রতি নীতিগত সমর্থন যোগাতে পারে, কিন্তু তাঁদের সীমিত সাংগঠনিক সামর্থ্য এই মুহূর্তে এই দাবি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে না। তাছাড়া, বামপন্থীরা লীগ-বিরোধী আন্দোলনের পুরো সময় জুড়ে তৎপর থাকলেও, জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনের শিক্ষার্থী নেতৃত্ব তাদের সঙ্গে নিজেদের ‘কৌশলগত’ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছিল। ফলে, আরো কিছুকাল উভয় পক্ষের ভেতর একটা আস্থার সংকট জারি থাকার কথা। এমতাবস্থায়, সংশ্লিষ্ট ছাত্র নেতৃত্ববৃন্দকে তাঁদের ‘বৈপ্লবিক প্রকল্প’ নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে বৈকি।

যাই হোক, কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হোক কিংবা না হোক, স্বৈরতন্ত্র বিরোধী শিক্ষার্থী-গণঅভুত্থানের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সকলেরই এখন সজাগ থাকা জরুরি, যাতে আমাদের অতীতের মহান ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানগুলোর মত, এবারের এই রক্তাক্ত অভ্যুত্থান অন্তত যেন জনগণের হাতছাড়া হয়ে না যায় – অসংখ্য টগবগে তরুণ, কোমলমতি শিশু আর প্রৌঢ়ের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই রাজনৈতিক বিজয় যেন এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক স্বার্থ বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি জমানায়, ১৯৬৯ সালে, গণতন্ত্রকামী ছাত্র-শ্রমিক ও কৃষকের সম্মিলিত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন স্বৈরশাহীর পতনের পর, রাষ্ট্রক্ষমতা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার করতলগত হয়ে গিয়েছিল, যে সামরিক জান্তা ফের সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করে কিছুকালের জন্য জনগণের মৌলিক অধিকার চর্চার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন মঞ্জুর করলেও, নির্বাচনের রায় অবজ্ঞা করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর এক ভয়াবহ গণহত্যা পরিচালনা করে এবং একটি বিজয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়েই কেবল পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ থেকে পূর্ব বাংলার মানুষও নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে, ১৯৯০ সালে, ছাত্র ও শ্রমিক-কর্মচারীদের অভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর, আগেই বলেছি, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষার অজুহাতে, সংবিধানসম্মত ‘নৈর্বাচনিক স্বৈরতন্ত্রের’ কানা গলিতে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছিল – দীর্ঘ সংগ্রামের পথে পথে যে-সব দাবি-দফা সমাজে উত্থাপিত হয়েছিল, তার প্রায় কোনটিই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

এমতাবস্থায়, রক্তাক্ত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের বিজয় নেতৃত্বের আশু কর্তব্য হল, একদিকে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে নানা ফ্যাসিবাদী উপাদান থেকে মুক্ত করা, অন্যদিকে, বিগত কয়েক দশকের নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজের নানা স্তর থেকে যে-সব গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি উঠেছে এবং সেসব দাবির ব্যাপারে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভেতর ইতিমধ্যেই যতটুকু মতৈক্য দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, সেগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান নীতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের অন্তর্ভূক্ত করার প্রয়াস গ্রহণ। বিদ্যমান সংবিধানের প্রধান প্রধান ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী/উৎকৃষ্ঠতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাধ্যান্যকবলিত অপরাপর জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জাতি ও ধর্মগত অধস্থনতা, দলীয়কৃত ইতিহাসের ভুতুরে আলোয় নির্মিত একটি বিশেষ দল ও তার নেতার অন্যায় আধিপত্য এবং তার ভিত্তিতে প্রণীত বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী আইন, রাষ্ট্রের তাবৎ নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভবন, অভিন্ন ব্যক্তির হাতে আইনসভা, নির্বাহীবিভাগ ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব ন্যস্ত থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গণতান্ত্রিক পৃথকীকরণের বাস্তব প্রতিবন্ধকতা, দেশের জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময় জনগণের ‘মৌলিক অধিকার’ স্থগিত রাখার বিধান, ইত্যাদি।

আবার কিছু কিছু গণতান্ত্রিক উপাদানের অনুপস্থিতিতে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে একটি গণবিরোধী দলীলে অধিপতিত করে রেখেছে। যেমন, সংবিধানের কোন ধারা বা অনুচ্ছেদ পরিবর্তনে গণভোটের অপরিহার্যতার বিধানের অনুপস্থিতি, জনগণের ‘অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা’কে সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়ে সন্নিবেশিত না থাকা এবং এসব অধিকারগুলো সংবিধানস্বীকৃত অপরাপর মৌলিক অধিকারগুলোর মতই প্রয়োজনে আইন-আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য করার বিধানের অনুপস্থিতি, ইত্যাদি।

বাংলাদেশের যথার্থ গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থার যথাযথ সংস্কারেরও কোন বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সকল স্তরে নেতা-নেত্রী নির্বাচন ও গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আভ্যন্তরীন গণতন্ত্র চর্চার বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠিত না হলে, সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশে ইতিবাচক অবদান রাখা সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পক্ষে সম্ভব হবে না। এদিকে, স্থানীয় ও জাতীয় – উভয় পর্যায়ে স্বচ্ছ, অবাধ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে, গোটা নির্বাচন কমিশনকে তার কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অন্যায় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। লক্ষ্য করুন, বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে, নির্বাচন কমিশনকে ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দেয়া হলেও, নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ সকল স্তরের নির্বাচনেই রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন – সে-সব স্তরের নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অধীনে ন্যস্ত থেকে শেষোক্তদের ‘সহযোগিতা’ করেন মাত্র। নির্বাচন প্রক্রিয়ার যথার্থ গণতন্ত্রায়নের জন্য ব্যাপারটিকে ঠিক উল্টো হতে হবে- একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও যোগ্য কর্মকর্তাগণই সকল স্তরে নির্বাচনে ‘রিটার্নিং অফিসারের’ দায়িত্ব পালন করবেন, আর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাজে সহায়তা দান করবেন। সেক্ষেত্রে, স্বাধীন ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত মান, চাকুরির পদমর্যাদা ও সুবিধাদি বাড়িয়ে নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি স্বতন্ত্র ‘ক্যাডার সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

ওদিকে, নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় বিত্তবানদের একাধিপত্য দূর করার জন্য নির্বাচনী ব্যয় হ্রাস ও নির্বাচনে অবৈধ টাকা ও পেশীর ব্যবহার বন্ধ করার কোন বিকল্প নেই।

উপরোল্লিখিত এসব অত্যাবশ্যকীয় গণতান্ত্রিক সংস্কার নিষ্পন্ন করার জন্য বিজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয় তরুণদের নিশ্চয় সমাজে সক্রিয় অপরাপর গণতন্ত্রপরায়ন রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জবানের পক্ষ থেকে

নূরুল কবীর : আপনাদের প্রতিও আমার শুভেচ্ছা থাকলো।

 

 

 

 

সম্মৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য চাই উন্নত চিন্তা। গনতান্ত্রিক দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শুধু তথ্যযুদ্ধ এবং ইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া নয়, দরকার মননশীল সাংবাদিকতা। একতরফা ভাবনা বা মতের প্রতিফলনের বাইরে সত্য ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশ ঘটাতে বিশ্লেষণী সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই উদ্যোগ আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। ডোনেট করুন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাতিগঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশীদার হোন।

মোবাইল ব্যাংকিংঃ Bkash & Nagad (personal): 01677014094
Paypal https://paypal.me/jobanmedia

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নাম *